কপিলকৃষ্ণের পরিবার। রয়েছেন বড়মা-ও। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।
প্রয়াত তৃণমূল সাংসদ তথা মতুয়া মহাসঙ্ঘের সঙ্ঘাধিপতি কপিলকৃষ্ণ ঠাকুরের প্রয়াণের পরে রবিবার স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠানে দেখাই মিলল না জেলা বা রাজ্য স্তরের নেতাদের। মতুয়াদের সঙ্গে তৃণমূলের দীর্ঘ সখ্যের নিরিখে যা নিতান্ত অস্বাভাবিক ঠেকছে দলের একাংশের কাছেই। এর পিছনে রাজনৈতিক তাৎপর্যও খুঁজে পাচ্ছেন তাঁরা। সরাসরি কিছু না বললেও বিষয়টি নিয়ে বিব্রত ঠাকুরবাড়ির লোকজনও।
ছাপানো কার্ডে তৃণমূলের রাজ্য ও জেলা নেতৃত্বের অনেকের কাছে অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্র গিয়েছিল বলে ঠাকুরবাড়ির একটি সূত্র জানাচ্ছে। তা হলে কোন প্রেক্ষিতে আচমকাই অনুষ্ঠান থেকে নিজেদের দূরে রাখলেন নেতারা?
তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের অধিকাংশই এ দিন কলকাতায় দলীয় বৈঠকে ব্যস্ত ছিলেন। সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় গিয়েছেন উত্তরবঙ্গে। অন্যত্র ব্যস্ততাকেই তৃণমূলের তরফে আনুষ্ঠানিক ভাবে ঠাকুরবাড়িতে না যেতে পারার কারণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে। তবে জেলা তৃণমূল নেতাদের কেউ কেউ একান্তে স্বীকার করছেন, ঘটনা এত সহজ নয়।
কপিলকৃষ্ণের মৃত্যুর পর থেকে তাঁর ভাই মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুরের বড় ছেলে সুব্রতের সঙ্গে ইদানীং বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বের কোনও যোগাযোগ তৈরি হচ্ছে কি না, তা নিয়ে চাপা গুঞ্জন আছে এলাকায়। উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্বের প্রশ্নে বিজেপি নেতৃত্ব নানা সময়ে সোচ্চার হয়েছেন। একই দাবিতে দীর্ঘ দিন আন্দোলন চালাচ্ছেন মতুয়ারাও। বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনকে সামনে রেখে সম্প্রতি উদ্বাস্তুদের নিয়ে আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন সিপিএমের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক গৌতম দেব। তার প্রেক্ষিতে উদ্বাস্তু প্রশ্নে নতুন করে সরব হয়েছে বিজেপিও। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিজেপির সঙ্গে মতুয়াদের একাংশের ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠার সম্ভাবনা আছে বলে মনে করছেন তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশ। যে কারণে ঠাকুরবাড়ির অনুষ্ঠান থেকে এ দিন দূরত্ব বজায় রাখা হয়েছে বলে তৃণমূলের একাংশের ব্যাখা।
সুব্রতবাবুও কী তেমনটাই মনে করছেন? সরাসরি এ প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গিয়েছেন মঞ্জুল-পুত্র। তাঁর কথায়, “আমার প্রতি বিজেপি, তৃণমূল বা অন্য যে কোনও দল আগ্রহ দেখাতেই পারে। সামাজিক আন্দোলন করেন যারা, সেই সব সংগঠনও আমার প্রতি আগ্রহী হতে পারে। এ নিয়ে আর কোনও মন্তব্য করব না।”
সুব্রতবাবুর আরও কিছু সাম্প্রতিক আচরণে সন্তুষ্ট নন তৃণমূলের জেলা নেতৃত্বের একটি অংশ। দলের কারও সঙ্গে আলোচনা না করে আচমকাই গাইঘাটা পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য পদ থেকে সুব্রতর ইস্তফা দেওয়ার ফেসবুক-ঘোষণা তৃণমূলের অনেকেই ভাল চোখে দেখছেন না। কপিলবাবুর মৃত্যুর পরে বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রে আসন্ন উপনির্বাচনে দলের মধ্যে গুরুত্ব বাড়িয়ে নিতে চেয়েই সুব্রত এমন পদক্ষেপ করে থাকতে পারেন বলে মনে করছেন দলের ওই অংশটি। প্রয়াত সাংসদের স্ত্রী মমতাবালা এবং ভাইপো সুব্রতর মধ্যে ভোটের টিকিট পাওয়াকে কেন্দ্র করে টানাপড়েন দিন দিন আরও বাড়বে, তা এক রকম স্পষ্ট। ঠাকুরবাড়ির মধ্যে এই অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এড়াতে চাওয়াও এ দিন শাসক দলের শীর্ষ নেতৃত্বের গরহাজিরার অন্যতম কারণ হতে পারে বলে তৃণমূলের একাংশের বক্তব্য।
গত ১৩ অক্টোবর কপিলকৃষ্ণের মৃত্যু দিনে কিন্তু ঠাকুরবাড়ির ছবিটা ছিল একেবারেই আলাদা। তৃণমূলের রাজ্যস্তরের নেতা-মন্ত্রীদের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। যে পুলিশি নিরাপত্তা দেখা গিয়েছিল ঠাকুরনগরে, তা-ও ছিল এক কথায় নজিরবিহীন। কিন্তু কপিলের মৃত্যুর সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে ছবিটা এমন আমূল বদলে যাবে, ভাবা যায়নি। স্থানীয় কয়েক জন তৃণমূল নেতা-বিধায়ক অবশ্য ব্যক্তিগত ভাবে রবিবার ‘স্মৃতিচারণ ও মহাপ্রসাদ বিতরণ অনুষ্ঠান’-এ হাজির থেকেছেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন বনগাঁ দক্ষিণ কেন্দ্রের বিধায়ক সুরজিৎ বিশ্বাস, হরিণঘাটার বিধায়ক নীলিমা নাগ, প্রাক্তন বিধায়ক গোপাল শেঠ প্রমুখ। সুরজিৎবাবু বলেন, “আমি দলীয় ভাবে আসিনি। এলাকায় থাকি। ব্যক্তিগত সম্পর্কের জায়গা থেকেই প্রয়াত সাংসদকে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছি।”
তৃণমূল নেতৃত্বের অনুপস্থিতি প্রসঙ্গে সুব্রত ঠাকুর কোনও মন্তব্যই করতে চাননি। তিনি বলেন, “মতুয়াদের ব্যাপার, মতুয়ারাই এসেছেন।” পাশাপাশি তাঁর সংযোজন, “কে কাকে কী ভাবে আমন্ত্রণ করেছেন, তা মতুয়া মহাসঙ্ঘ বা আমাদের পরিবারের কেউ জানে না।” মতুয়া ভক্তেরা নিজেরাই এ দিনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন বলে দাবি করেছেন মমতাবালাদেবী। তাঁর কথায়, “অনেককেই আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। নেতাদের অনেকে কাজে ব্যস্ত থাকায় আসতে পারেননি বলে জানিয়েছেন।”
আর কী বলছেন তৃণমূল নেতৃত্ব? জেলা তৃণমূল সভাপতি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলেন, “বসিরহাটে দলীয় কর্মী খুন হয়েছেন। সে সব নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। সে জন্যই যেতে পারিনি। তবে ওঁদের পরিবারের উপরে সম্পূর্ণ সমবেদনা আছে। ওঁরা যেন নিজেদের বিচ্ছিন্ন না ভাবেন।” এ দিন ঠাকুরবাড়িতে মতুয়া ভক্তদের হাজিরা অবশ্য ছিল চোখে পড়ার মতো।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy