জেএমবি জঙ্গিদের টাকার উৎস ও সেই টাকা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়েছে তার খোঁজে নেমে এ বার তৃণমূলের রাজ্যসভার সদস্য আহমদ হাসান ইমরানের সঙ্গে যোগসূত্র মিলেছে বলে দাবি করেছেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা।
সম্প্রতি অসমের বরপেটায় পুলিশের হাতে ধরা পড়ে ফেরার জেএমবি (জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ) নেতা শাহনুর আলম। পুলিশের দাবি, বাংলাদেশ থেকে অসম হয়ে পশ্চিমবঙ্গে জেএমবি মডিউলের কাছে যে টাকা আসত, শাহনুর ওরফে ডাক্তার ছিল তার জোগানদার। এনআইএ এবং অসম পুলিশ তাকে জেরা করে ইতিমধ্যেই অসম ও উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন শহর থেকে বেশ কয়েক জনকে আটক করেছে। তাদের জেরা করেই এক কালে সিমি (স্টুডেন্ট ইসলামিক মুভমেন্ট অব ইন্ডিয়া)-র সঙ্গে যুক্ত চার জনের নাম মিলেছে, যারা মূলত বাংলাদেশ থেকে আসা বিপুল টাকা নিজেদের হেফাজতে রেখে বিলিবণ্টন করত। গোয়েন্দা দফতর সূত্রের দাবি, তাদের কাছে নিয়মিত যাতায়াত ছিল আহমদ হাসান ইমরানের। কেন্দ্রীয় এক তদন্তকারীর কথায়, “তৃণমূলের এই সাংসদ নিজে সিমি-র প্রাক্তন প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। সেই সূত্রে অসমের এই সন্দেহভাজনদের সঙ্গে ইমরানের পরিচিতি তো ছিলই, নিয়মিত যাতায়াতও ছিল বলে তদন্তে উঠে এসেছে। এমনকী নিজের সংবাদপত্র ‘কলম’কে সামনে রেখে ইমরান এদের কাছ থেকে অর্থ নিয়েছেন বলে প্রাথমিক তদন্তে আমরা প্রমাণ পেয়েছি।”
অভিযোগগুলি নিয়ে ইমরানের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনও প্রশ্নের উত্তর দিতে রাজি হননি। বলেন, “পরে ফোন করুন।” পরে তিনি আর ফোন ধরেননি। এসএমএসেরও জবাব দেননি। সারদার টাকায় ইমরানের সংবাদপত্রটি দৈনিক আকারে প্রকাশের সময়ে ঘটা করে তাঁর উদ্বোধন করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, “মা-মাটি-মানুষের খবর রাজ্যের সংখ্যালঘুদের কাছে পৌঁছে দেবে ‘কলম’।”
তদন্তে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা জানতে পেরেছে, ইমরানের ‘কলম’ সংবাদপত্রটি আদতে ১৯ নম্বর দরগা রোডে সিমি-র অফিসের ঠিকানা থেকেই সংগঠনের মুখপত্র হিসেবে ১৯৮১ সালে প্রকাশিত হয়। পরবর্তী কালে জঙ্গি কার্যকলাপের জন্য সিমি নিষিদ্ধ হয়। কিন্তু ইমরান পত্রিকাটি একই রেজিস্ট্রেশন নম্বরে সাপ্তাহিক হিসেবে প্রকাশ করতে থাকেন। গোয়েন্দাদের দাবি, এই কাগজে বিপুল অর্থ ঢেলেছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা-বিরোধী মৌলবাদী দল জামাতে ইসলামির নেতারা। নিয়মিত কাগজ চালানো ও বাংলাদেশ থেকে কলকাতায় আসা জঙ্গিদের আশ্রয় দেওয়ার জন্যই অসম থেকে কয়েক দফায় টাকা নিয়ে এসেছেন ইমরান বলেই দাবি করেছেন গোয়েন্দারা। মৌলবাদী ও জামাতি ভাবধারা প্রচারের জন্যই তাঁকে এই টাকা দেওয়া হয়েছে বলে তাঁদের ধারণা।
পুলিশের বক্তব্য, পশ্চিমবঙ্গের আগে থেকেই জেএমবি-র অসম মডিউলটি সক্রিয় রয়েছে। শাহনুরের পাশাপাশি জাহিদ নামে আরও এক জঙ্গিরও খোঁজ চালাচ্ছে এনআইএ। শাহনুর জানিয়েছে, জাহিদই তাকে জেএমবি-তে এনেছে। বরপেটার এক তরুণীকে বিয়ে করে ভারতের নাগরিকত্ব নিয়েছে জাহিদ। খাগড়াগড় বিস্ফোরণের পর থেকেই সে সস্ত্রীক নিরুদ্দেশ। সে বাংলাদেশে পালিয়ে গিয়ে থাকতে পারে বলে পুলিশ মনে করছে। বাংলাদেশ থেকে অসম হয়ে পশ্চিমবঙ্গে অর্থ আসার বিষয়টিতেও জাহিদের যোগাযোগ পাওয়া গিয়েছে বলে পুলিশের দবি।
অসমেই ইমরানের শ্বশুরবাড়ি। পুলিশ সূত্রের দাবি, সেখানে খোঁজ নিয়ে পুলিশ ও গোয়েন্দারা প্রধানত দু’টি বিষয় জেনেছেন। এক, প্রাক্তন এই সিমি নেতার শ্বশুরবাড়ির লোকজন আদতে বাংলাদেশি। দুই, বাংলাদেশে তাঁর শ্বশুরবাড়ির তরফের আত্মীয়দের অনেকেই জামাতে ইসলামি ও তাদের বিভিন্ন শাখা সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। গোয়েন্দাদের অভিযোগ, তাঁদের মাধ্যমেও জামাতের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে টাকা সংগ্রহ করেছেন ইমরান। কেন্দ্রীয় তদন্তকারীদের একটি সূত্রের দাবি, সাংসদ হওয়ার আগে ইমরান প্রতি বছর ঈদের সময়ে বাংলাদেশে গিয়ে জামাত নেতা ও তাদের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বিপুল টাকা সংগ্রহ করতেন, যা অসমের পথেই কলকাতায় আনা হতো। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ থেকে বেআইনি ভাবে অর্থ সংগ্রহের অভিযোগটি ইমরানকে নিয়ে তৈরি কেন্দ্রীয় আইবি-র ফাইলেও রয়েছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রের খবর, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যসভায় দলীয় প্রার্থী হিসেবে ইমরানের নাম ঘোষণার পরে নবান্নে এসে এই ফাইলই মুখ্যমন্ত্রীর হাতে তুলে দিয়ে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার অনুরোধ জানান কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব অনিল গোস্বামী। কিন্তু মমতা সিদ্ধান্ত বদলাননি।
সারদা কেলেঙ্কারির তদন্তে জেরার জন্য ইতিমধ্যেই ইমরানকে ডেকেছে সিবিআই। কেন্দ্রীয় এই গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে খবর, বাংলাদেশ থেকে দফায় দফায় টাকা আনার বিষয়ে তথ্য পাওয়ার পরে তৃণমূলের এই সাংসদের বিরুদ্ধে ‘ফেমা’-য় (ফরেন এক্সচেঞ্চ ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট) অভিযোগ দায়ের করার বিষয়টিও বিবেচনা করা হচ্ছে।
তাঁর ‘কলম’ সংবাদপত্রটি ইমরান বেশ কয়েক কোটি টাকায় সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেনকে বিক্রি করেছিলেন বলে অভিযোগ। তবে সিবিআইয়ের কাছে সুদীপ্ত দাবি করেছেন, দফায় দফায় টাকা দিলেও শেষ পর্যন্ত ‘কলম’-এর মালিকানা তাঁকে দেওয়া হয়নি। ইডি সূত্রের খবর, সারদা মিডিয়ার এক কর্মী তাদের কাছে এজাহারে জানিয়েছেন, ইমরানের টাকার বায়নায় বিরক্ত হয়ে সুদীপ্ত সেন এক বার প্রকাশ্যেই তাঁকে বলেন “আপনাকে আর অফিসে আসতে হবে না। বাড়িতে বসেই মাইনে পেয়ে যাবেন! রোজ রোজ এত টাকা দেওয়া যাবে না!”
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সূত্র দাবি করেছে, অসমে ধৃত প্রাক্তন সিমি নেতারাও জেরায় জানিয়েছেন, একই কারণে তাঁরা ইমরানের ওপর বিরক্ত। এমনকী তাঁদের কাছ থেকে নেওয়া টাকার কতটা তিনি কাগজ চালানো ও ‘ছেলে’দের আশ্রয় দেওয়ার কাজে ব্যবহার করেছেন, আর কতটা আত্মসাৎ করেছেন তা নিয়েও ইমরানের ‘সিমি-বন্ধুরা’ সন্দিহান। কারণ ইমরান যে কলকাতায় তাঁর সাপ্তাহিক সংবাদপত্রের কর্মীদের নিয়মিত বেতন দিতেন না, সে খবর তাঁরা পেয়েছেন। আবার কলকাতা থেকে ছেলেরা ফিরে গিয়ে এঅভিযোগও করেছেন তাদের ঠিকমতো দেখভাল করেননি ইমরান। এমনকী টাকা নেওয়ার বিনিময়ে যে মাত্রায় জেহাদি প্রচার করা উচিত ছিল, ইমরান তাঁর সংবাদপত্রে তা করতেন না বলে অসমে সিমি-র প্রাক্তন নেতারা এনআইএ-র কাছে নালিশ করেছেন বলে গোয়েন্দা সূত্রের দাবি। ওই নেতাদের নালিশ, বিভিন্ন জনের কাছে থেকে টাকা নেওয়ার ফলে ইমরান তাঁর কাগজে কাউকেই চটাতে চাইতেন না।
যদিও তার পরেও বিভিন্ন সূত্রে ‘কলম’-এর ফাইল সংগ্রহ করে তাতে জামাতে ইসলামি ও মৌলবাদী প্রচারের বহু নমুনা পেয়েছেন কেন্দ্রীয় তদন্তকারীরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy