রথীন দণ্ডপাটের বাড়ির সামনে মিছিল নেতাইয়ে। ছবি: দেবরাজ ঘোষ।
পড়ন্ত বিকেলে বিবর্ণ গোলাপি দোতলা বড়িটার সামনে দাউদাউ করে জ্বলছে নেতাই হত্যাকাণ্ডে ‘অধরা’ অনুজ পাণ্ডের কুশপুতুল। সে দিকে থুতু ছিটিয়ে দিলেন কেউ কেউ। তরুণ প্রজন্মের অনেকে উল্লাসে লাঠি পেটা করছেন জ্বলন্ত খড়ের মণ্ডটাকে।
মঙ্গলবার দুপুরের মধ্যে নেতাই গ্রামের বাসিন্দারা জেনে যান, নেতাই-কাণ্ডের ‘ফেরার’ আট অভিযুক্তের মধ্যে পাঁচ জনকে অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে গ্রেফতার করেছে সিআইডি। কিন্তু ধৃতদের মধ্যে মূল অভিযুক্ত সিপিএমের বিনপুর জোনাল কমিটির সম্পাদক অনুজ পাণ্ডে নেই শুনে কিছুটা হতাশ তাঁরা। তবু পদযাত্রা, বাজি-পটকা, বাদ পড়েনি কিছুই।
নেতাইয়ের জীবন যেন থমকে গিয়েছিল তিন বছর আগে। দিনটা ছিল ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি। গ্রামের সিপিএম কর্মী রথীন দণ্ডপাটের বাড়িতে থাকা সশস্ত্র শিবিরের সামনে জমায়েত করে বাসিন্দারা বলতে গিয়েছিলেন, গ্রামের যুবকরা অস্ত্রশিক্ষা নেবেন না। সিপিএমের সশস্ত্র বাহিনীর জুলুমের বিরুদ্ধে সে দিন প্রতিবাদ করেছিলেন নেতাইবাসী। তখনই ওই বাড়ির ছাদ থেকে ছুটে আসা ঝাঁকে ঝাঁকে গুলিতে নিহত হন চার মহিলা-সহ ৯ গ্রামবাসী। জখম হন ২৮ জন।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক দ্বারকানাথ পণ্ডা এখন ‘নেতাই শহিদ স্মৃতি রক্ষা কমিটি’র সভাপতি। তাঁর কথায়, “টানা ৩৯ মাস শোক আর যন্ত্রণার সঙ্গে যুদ্ধ করে যাওয়া পরিবারগুলি এ দিনই কিছুটা স্বস্তির শ্বাস নিলেন। কেন্দ্রের সিবিআই যা করতে পরেনি, রাজ্যের সিআইডি তা করে দেখিয়েছে। ঘটনার মূল পাণ্ডা অনুজ পাণ্ডেও এ বার ধরা পড়বে বলে আমরা আশাবাদী।” এ দিন বিকেলে গ্রামে গিয়েছিলেন তৃণমূলের জেলা সভাপতি দীনেন রায়। নেতাই গ্রামের শহিদ বেদিতে শ্রদ্ধা জানান তিনি।
এ দিন বিকেলে শহিদ স্মৃতি রক্ষা কমিটির উদ্যোগে পদযাত্রায় নিহতদের পরিজনদের সঙ্গে আহতেরাও পা মেলান। নেতাই গ্রামের ভীমচক থেকে পদযাত্রাটি সিপিএম কর্মী রথীন দণ্ডপাটের বাড়িটির সামনে আসতেই জনতার একাংশ সেখানে কুশপুতুল পোড়ানোর আয়োজন করেন। কুশপুতুলে আগুন দেন দ্বারকানাথবাবু। বাজি-পটকা ফাটিয়ে কিশোর-তরুণেরা তখন উল্লাসে মত্ত। লালগড় ব্লক তৃণমূলের সভাপতি বনবিহারী রায় ও ব্লক যুব তৃণমূলের সভাপতি তন্ময় রায় বললেন, “যে যন্ত্রণা নেতাইবাসী গত তিন বছর ধরে ভোগ করেছেন, তাতে এই উল্লাস সঙ্গত।” নিহত শ্যামানন্দ ঘোড়ইয়ের ছেলে শান্তনু ঘোড়ই বললেন, “ঘটনার মূল চক্রীরা এত দিন গ্রেফতার না-হওয়ায় আমরা খুবই হতাশার মধ্যে ছিলাম। পাঁচ জনকে সিআইডি ধরায় আমরা কিছুটা নিশ্চিন্ত বোধ করছি। বিচারে সব দোষীরা উপযুক্ত শাস্তি পাবে বলে আশা করছি।” নিহত সৌরভ ঘোড়ইয়ের স্ত্রী শম্পা ঘোড়ই, নিহত ধ্রুবপ্রসাদ গোস্বামীর ছেলে ব্রজগোপালের মতো অনেকেই অভিযুক্তদের চরম (ফাঁসি) শাস্তির দাবিতে সরব হন। স্বামীহারা শম্পাদেবী বললেন, “আমার তো কিছুই রইল না। ছ’বছরের ছেলেটার মুখ চেয়ে কোনও মতে দিন কাটাচ্ছি।”
তিন বছরে অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে নেতাই গ্রামের। রাস্তার কাজ হচ্ছে। শহিদ বেদির সামনে পরিস্রুত পানীয় জলের ব্যবস্থা হয়েছে। নিহতদের পরিজনেরা সবাই চাকরি পেয়েছেন। তবে দু’টি পরিবারের মাত্র তিন জন স্থায়ী চাকরি পেয়েছেন। বাকি সাতটি পরিবারের সাত জন সদস্য পূর্ত বিভাগে অস্থায়ী চাকরি করছেন।
গোটা গ্রাম যখন পদযাত্রায় সামিল, তখন এক বৃদ্ধ গ্রামের বাগানপাড়ায় বাড়ির ঠাকুরঘরে বসেছিলেন। দু’চোখ বেয়ে জল রঞ্জিত পাত্রের। তিন বছর আগে শীতের সকালে অজস্র বুলেট এ-ফোঁড় ও-ফোঁড় করে দেয় তরতাজা উনিশ বছরের অরূপ পাত্রের শরীর। অরূপের বাবা রঞ্জিতবাবুর লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতেই নেতাই মামলাটি দায়ের করেছিল লালগড় থানার পুলিশ। পরে সিআইডির হাত থেকে তদন্ত ভার নিয়েছিল সিবিআই। রঞ্জিতবাবু বলেন, “চোখের সামনে ছেলেটাকে গুলি খেয়ে ছটফট করতে করতে শেষ হয়ে যেতে দেখেছিলাম। তারপর থেকে আর কিছু ভাল লাগে না। বড় ছেলে কার্তিক একটা অস্থায়ী চাকরি পেয়েছে। ছেলের মৃত্যুর ক্ষতিপূরণও মিলেছে। কিন্তু ছেলেকে তো আর ফিরে পাব না।” বাজির আওয়াজও চাপা দিতে পারে না ভারী দীর্ঘশ্বাসকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy