খেলা দেখে যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন থেকে বেরিয়ে আসছেন মদন মিত্র। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস
এক জন মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচ দেখলেন জেলের টিভি-তে।
অন্য জন দেখলেন খাস যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে হাজির থেকে।
এক জন ক্রীড়াকর্তা। ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের ফুটবল দলের কর্ণধার দেবব্রত সরকার ওরফে নিতু।
অন্য জন ক্রীড়ামন্ত্রী মদন মিত্র।
ক্রীড়াপ্রেম ছাড়াও মিল আছে দু’জনের মধ্যে। সারদা গোষ্ঠীর আর্থিক কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত হিসেবেই নিতুর ঠিকানা আপাতত আলিপুর সেন্ট্রাল জেল। আর ওই কেলেঙ্কারিতে কোনও কোনও শিবির থেকে আঙুল উঠছে মদনবাবুর দিকেও।
চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মোহনবাগানের বিরুদ্ধে ম্যাচে নিতু মাঠে নেই, এমনটা কখনও হয়েছে বলে ময়দানের তাবড় কর্তারা মনে করতে পারছেন না। অথচ রবিবার সেটাই হল। নিতু এই প্রথম বড় ম্যাচ দেখলেন কারাগারের অন্তরালে। টেলিভিশন থেকে বেশ খানিকটা দূরে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। তা-ও পুরো ম্যাচ দেখার সুযোগ মিলল না। জেলের লক-আপে ঢোকার সময় হয়ে যাওয়ায় বিকেল সাড়ে ৫টা নাগাদই নির্দিষ্ট কুঠুরিতে চলে যেতে হয় তাঁকে। স্বস্তি এটুকুই যে, মরসুমের প্রথম ডার্বি ম্যাচে তাঁর দল ইস্টবেঙ্গল তখনই ৩-১ গোলে এগিয়ে ছিল। তাই খানিকটা নিশ্চিন্তেই ছিলেন তিনি। সেলে নিয়ে যাওয়ার পথে এক জেলরক্ষী তাঁকে বলেন, “দল তো মনে হচ্ছে জিতেই যাবে!” জবাবে কিছুই বলেননি নিতু। শুধু মুচকি হেসে, মাথা নেড়ে সেলে ঢুকে গিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত খেলার ফল অবশ্য ওটাই ছিল।
দেবব্রতবাবু যখন জেলের উঠোনে দাঁড়িয়ে খেলা দেখছিলেন, তখন যুবভারতীতে খোশ মেজাজে মরসুমের প্রথম ডার্বি ম্যাচ উপভোগ করছেন ক্রীড়ামন্ত্রী মদনবাবু। কয়েক দিন আগেও যিনি ভর্তি ছিলেন হাসপাতালে। সারদা কেলেঙ্কারিতে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল উঠলেও খেলা দেখার পরে সেই বিতর্ক এড়িয়েই যান মন্ত্রী। শুধু বলেন, “সুস্থ বলেই তো হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছি। তা ছাড়া খেলা দেখার জন্য নয়। যুবভারতীতে এসেছি খেলার তদারক করতে। ক্রীড়ামন্ত্রী হিসেবে এটা আমার নৈতিক দায়িত্ব।”
মন্ত্রীর মতো মোটেই খোশ মেজাজে ছিলেন না নিতু। খেলা নিয়ে যে তাঁর চাপা টেনশন রয়েছে, সেটা বোঝা যায় দুপুরেই। সেই উৎকণ্ঠা থেকেই জেল-কর্তৃপক্ষের কাছে টিভি-তে খেলা দেখার অনুমতি চেয়ে বসেন তিনি। জেলের এক অফিসারকে নিতু বলেন, “জানেন তো, আমি ইস্টবেঙ্গল-কর্তা। আজ মোহনবাগানের বিরুদ্ধে খেলা। টিভি-তে ম্যাচটা দেখতে পেলে ভাল হতো।”
কড়া নিরাপত্তায় থাকা নিতুর অবশ্য সেলে বসে টিভি-তে খেলা দেখার অনুমতি মেলেনি। কারণ, আলিপুর জেলে নিতু ছাড়াও সুদীপ্ত সেন-সহ সারদা মামলার আরও চার জন বিচারাধীন বন্দি রয়েছেন। তাঁদের কারও ঘরেই টিভি নেই। নিয়মও নেই টিভি দেওয়ার। তাই নিতু চাইলেও জেল-কর্তারা তাঁকে কোনও সেলে টিভি দেখার অনুমতি দিতে পারেননি।
সারদা কেলেঙ্কারিতে অন্যতম অভিযুক্ত হিসেবে গত শুক্রবার রাতে সিবিআইয়ের হেফাজত থেকে জেল-হাজতে পাঠানো হয় নিতুকে। রাখা হয়েছে আলিপুর জেলের কড়া নিরাপত্তায় মোড়া এক নম্বর সেলে। মার্কিন তথ্যকেন্দ্রে হামলার মূল চক্রী আফতাব আনসারির পাশের ঘরে।
কারা দফতরের এক কর্তা বলেন, “আলিপুর জেলে ফাঁসির আসামি আর রাজনৈতিক বন্দিদের ঘরেই টিভি আছে। এ ছাড়া আদালতের নির্দেশে আফতাবের ঘরে টিভি-র ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর কোনও বন্দির ঘরেই টিভি নেই। তাই দেবব্রতবাবুই বা তাঁর সেলে টিভি পাবেন কী করে?”
তা হলে কি নিজের দলের বড় ম্যাচ দেখা হবে না ইস্টবেঙ্গল-কর্তার?
শেষ পর্যন্ত উপায় বার করেন নিতুই। তাঁর পাশের সেলেই আছে আফতাব। আর সেই ঘরের সামনের বারান্দায় আছে টিভি। এক নম্বর সেলের উঠোনে দাঁড়ালে সেই টিভি দেখা যায়। নিতু জেলরক্ষীদের বলেন, “আমি ওই উঠোনে দাঁড়িয়ে কিংবা পায়চারি করতে করতে তো খেলা দেখতেই পারি!” জেল সূত্রের খবর, নিতুর ওই ইচ্ছাপূরণে আপত্তি করেননি জেল-কর্তৃপক্ষ। শেষ পর্যন্ত উঠোনে দাঁড়িয়েই খেলা দেখেন তিনি। ইস্টবেঙ্গলের প্রথম গোল মোহনবাগান শোধ করে দেওয়ার পরে তাঁর চোখেমুখে টেনশন দেখা গিয়েছে। উঠোনে পায়চারিও করতে শুরু করে দেন। তা ছাড়া বাকি সময়টা ভাবলেশহীন মুখেই খেলা দেখেছেন। কর্তব্যরত জেলকর্মীরা মাঝেমধ্যে মন্তব্য করেছেন। কিন্তু তার কোনও উত্তর দেননি ইস্টবেঙ্গল-কর্তা।
সাধারণ ভাবে সন্ধ্যা ৬টায় বন্দিদের সেলে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। তার আগে সেলে সেলে তল্লাশি চলে। সেই জন্য ‘হাই প্রোফাইল’ বন্দিদের সাড়ে ৫টা নাগাদই কুঠুরিতে ঢুকে যেতে হয়। নিতুর ক্ষেত্রেও এ দিন সেটাই হয়েছে। তাতে অবশ্য নিতু বিশেষ আপত্তি করেননি। মুচকি হেসে নির্দিষ্ট সেলে চলে গিয়েছেন।
এর মধ্যেই অবশ্য নিতুকে জেলের হাসপাতাল থেকে সেদ্ধ ডিম আর কলা দিতে গিয়ে জেল-কর্তৃপক্ষের কোপে পড়েছেন এক রক্ষী। শুক্রবার রাতে জেলে ঢোকার পর থেকে শনিবার পর্যন্ত সে-ভাবে সেখানকার খাবার মুখে তোলেননি নিতু। জেল সূত্রের খবর, এক রক্ষী শনিবার রাতে নিতুকে হাসপাতালের ‘ভাল খাবার’ দেন। এই বেআইনি কাজের জন্য ওই জেলরক্ষীকে ইতিমধ্যে শো-কজ করা হয়েছে।
জেল সূত্রের খবর, এ দিন নিতু জেলের খাবারই খেয়েছেন। সকালে ভাত-ডাল-সব্জি, মাছ। রাতে রুটি ও ডিমের ঝোল। এক কারাকর্তা বলেন, “ধীরে ধীরে জেলের পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিচ্ছেন দেবব্রতবাবু।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy