সেই মুহূর্ত। ভিসির পদত্যাগের কথা ঘোষণা করলেন মুখ্যমন্ত্রী। নিজস্ব চিত্র
তিনি ভেবেছিলেন এগোবেন। কিন্তু হঠকারী পদক্ষেপ তাঁকে অনেকটা পিছিয়েই দিল।
সোমবার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য অপসারণ-পর্বে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকা এটাই প্রমাণ করছে। অভিজিৎ চক্রবর্তীর পদত্যাগের দাবিতে চার মাস ধরে চলা পড়ুয়াদের আন্দোলন অনশন পর্যন্ত পৌঁছেছিল। আট দিনের মাথায় সেই অনশন মঞ্চে পৌঁছে মমতা শুধু উপাচার্যের পদত্যাগের ঘোষণাই করলেন না, জানিয়ে দিলেন, তাঁর সঙ্গে উপাচার্যের কথা হয়েছে। এবং উপাচার্য তাঁকে পদত্যাগের কথা জানিয়েছেন। শিক্ষাক্ষেত্রে রাজনীতির এমন বহিঃপ্রকাশ নজিরবিহীন বলে মনে করছেন শিক্ষা জগতের সিংহভাগই।
সোমবার বিকেল সওয়া পাঁচটার পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। ঘণ্টাখানেকের মাথায় মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসকে নিয়ে পৌঁছন মুখ্যমন্ত্রী। আধ ঘণ্টা পরেই মমতা নিজে মাইক হাতে ছাত্রদের মধ্যে দাঁড়িয়ে জানিয়ে দেন, উপাচার্য পদত্যাগের ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। অর্থাৎ? যে আন্দোলনকে মমতার দল ‘মাও-মাকু ও মাদকাসক্তদের’ আন্দোলন বলে প্রচার করেছিল, যে ‘হোক কলরবে’র পাল্টা ‘হোক ক্যালানো’ এবং ‘হোক গর্জন’-এর স্লোগান তুলে পথে নেমেছিল, রাতারাতি এ দিন তাদের পাশে গিয়ে মমতা বলে এলেন, “আপনাদের ছাত্র আন্দোলনকে আমি সম্মান করি। এখানকার ছাত্রছাত্রীরা প্রতিভাশালী।” উপাচার্যের পদত্যাগের ‘কৃতিত্ব’ও ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়ে দেন, “আমার কোনও কৃতিত্ব নেই। পুরো কৃতিত্বই আমার ছাত্রছাত্রী বন্ধুদের।”
কেন হঠাৎ এই ভোলবদল? এই প্রশ্নে রাজনৈতিক শিক্ষা এবং নাগরিক সমাজ যখন আলোড়িত, তখনই সামনে এসেছে আরও এক প্রশ্ন। তা হল, বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকাণ্ডে সরাসরি মাথা গলিয়ে মুখ্যমন্ত্রী যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন, তা আগামী দিনে শিক্ষাক্ষেত্রকে আরও বেশি অস্থির করে তুলবে না কি? শিক্ষক মহলে অনেকেরই আশঙ্কা, সেটাই ঘটবে। ফলে মুখ্যমন্ত্রী যাকে সাফল্য বলে মনে করছেন, আসলে তা তাঁর অবিবেচক সিদ্ধান্ত। যা আখেরে ব্যুমেরাং হয়ে ফিরে আসবে।
বেছে বেছে সোমবারই উপাচার্যকে সরানোর এই সিদ্ধান্ত ঘোষণার পিছনে রাজনীতির অন্য এক খেলাও দেখছেন অনেকে। তাঁদের মতে, এ দিনই মুকুল রায়কে ডেকে পাঠিয়েছে সিবিআই। ফলে দলের এত বড় ধাক্কা থেকে সাধারণ মানুষের চোখ কিছুটা সরাতেই মমতা যাদবপুরের ‘তৃণমূল-পুষ্ট’ উপাচার্যকে সরিয়ে চার মাসের আন্দোলনকে স্বীকৃতি দিলেন।
তবে সরকার যে কোনও নির্ণায়ক পদক্ষেপের কথা ভাবছে, সেটা গত ক’দিন ধরেই বোঝা যাচ্ছিল। নিজে ছাত্র আন্দোলন করে উঠে আসা মমতা ক্রমশ বুঝতে পারছিলেন, যাদবপুরের আন্দোলন ক্রমেই হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। যে মমতা নিজে সিঙ্গুর নিয়ে ২৬ দিন অনশন করেছিলেন, সেই অনশন-অস্ত্রই ধীরে ধীরে তাঁকে বিহ্বল করে তুলছিল। কোনও পড়ুয়া যদি মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়তেন, সেই ধাক্কা সামলানোর ক্ষমতা এই মুহূর্তে যে তৃণমূলের নেই, তা দলের অন্দরে অনেকেই স্বীকার করছিলেন। সুগত বসুর মতো সাংসদ, সুব্রত মুখোপাধ্যায়-সাধন পাণ্ডের মতো মন্ত্রীরা মুখ খুলছিলেন। সামনেই পুরনির্বাচন। তার আগে শহুরে শিক্ষিত সমাজকে আরও বেশি ক্ষিপ্ত করে তোলা উচিত হবে না, এমনটাই ছিল দলের বর্ষীয়ানদের মত।
দলীয় সূত্রের খবর, গত রবিবার মুখ্যমন্ত্রীর কালীঘাটের বাড়িতে দলের কোর কমিটির বৈঠকেই উপাচার্য-বিদায় মোটামুটি সাব্যস্ত হয়ে যায়। সেই কারণেই সোমবার উপাচার্যকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতেও বারণ করা হয়। মুখ্যমন্ত্রী আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের সামনে ওই ঘোষণা করার সময়ে উপাচার্য যেন বিড়ম্বনায় না-পড়েন, তার জন্যই এই ব্যবস্থা। এমনকী, অভিজিৎবাবুর বাড়ির নেমপ্লেটের জন্য ‘প্রাক্তন উপাচার্য’ লেখাও তৈরি হয়ে যায়। সোমবার নবান্ন থেকে বেরিয়ে গঙ্গার ধারে সাগরযাত্রীদের তাঁবু ঘুরে মুখ্যমন্ত্রীর কনভয় সোজা যাদবপুরের পথ ধরে।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রের খবর, মুখ্যমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী প্রথমে আন্দোলনকারী পড়ুয়াদের উপস্থিতিতে রেজিস্ট্রার ও অন্য কয়েক জন পদাধিকারীর সঙ্গে কথা বলেন। জানতে চান, উপাচার্যকে যদি সরাতে হয়, তার জন্য আইনে কী ব্যবস্থা রয়েছে। সরকারের পক্ষে যে উপাচার্যকে সরানো সম্ভব নয়, তা-ও বোঝানো হয় মমতাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্তা মুখ্যমন্ত্রীকে সরাসরি উপাচার্যের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। এর পরে রেজিস্ট্রার এর পরে অভিজিৎবাবুকে মোবাইল ফোনে ধরেন। মুখ্যমন্ত্রী সেই ফোন নিয়ে পাশের ঘরে গিয়ে কথা বলেন। মিনিট দুয়েকের মধ্যেই ফিরে আসেন ‘থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ’ বলতে বলতে। পড়ুয়াদের বাইরে অপেক্ষা করতে বলেন। সূত্রের খবর, এর মধ্যে শিক্ষামন্ত্রীর ফোনেও অভিজিৎবাবুর এসএমএস এসে যায়। বিদায়ী উপাচার্য এসএমএস-এ লেখেন, ‘যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে অচলাবস্থা চলছে এবং এখনই এর সমাধান প্রয়োজন। তাই আমি ইস্তফা দিতে চাই।’
এর একটু পরেই ছাত্রছাত্রীদের কাছে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “আমাকে উনি (অভিজিৎ চক্রবর্তী) জানিয়েছেন, যে হেতু একটা আনরেস্ট চলছে এবং তিনিও চান পড়াশোনা ঠিক মতো চলুক, শান্তি ফিরে আসুক, তাই তিনি নিজে রেজিগনেশন দিচ্ছেন।” তাঁর নিজের অনশন-আন্দোলনের কথা উল্লেখ করে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “আমার মন আমাকে এখানে ডেকে এনেছে। নিজের বিবেকের তাগিদে আমি এখানে এসেছি।”
কিন্তু শিক্ষা মহলের বড় অংশেরই মত হল, রাজনীতির হিসেব কষে ‘বিবেকের তাগিদে’ সাড়া দিতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী যা করলেন, তা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বশাসনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী এবং শিক্ষায় রাজনীতির অনুপ্রবেশের আর এক চরম উদাহরণ। উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে সরব হওয়া যাদবপুরের শিক্ষক সংগঠন জুটার সাধারণ সম্পাদক নীলাঞ্জনা গুপ্ত নিজে বলছেন, “খারাপ দৃষ্টান্ত। কে উপাচার্য হবেন, কে পদত্যাগ করবেন, মুখ্যমন্ত্রী তা নির্ণয় করে দিতে পারেন না।” তৃণমূল সূত্রের অবশ্য দাবি, মুখ্যমন্ত্রী কোনও নির্দেশ দেননি। উপাচার্যের বক্তব্য সকলকে জানিয়েছেন মাত্র। কিন্তু শিক্ষা জগতের মত হল, উপাচার্য নিয়োগ এবং অপসারণ, সর্বত্রই শাসকের ইচ্ছাই যে সর্বেসর্বা, এ দিনের ঘটনা সেটাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে অচলাবস্থা কাটাতে উপাচার্যকে যদি সরাতেই হয়, তার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম-বিধি মেনেই ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারত। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী নিজে বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজির হয়ে যে ভাবে উপাচার্যের ইস্তফা ঘোষণা করলেন, তা বাম জমানার অনিলায়নকেও পিছনে ফেলে দিল বলে মনে করছেন অনেকে।
এক ছাত্রীর শ্লীলতাহানির অভিযোগ এবং তার সঠিক তদন্তের দাবিতে যাদবপুরে শুরু হয়েছিল আন্দোলন। ঘেরাও থেকে মুক্তি পেতে পুলিশ ডাকেন উপাচার্য। তাঁর বক্তব্য ছিল, তিনি নিজের প্রাণহানির আশঙ্কা করছিলেন। ১৬ সেপ্টেম্বর রাতে ক্যাম্পাসে ঢুকে বিক্ষোভরত পড়ুয়াদের ব্যাপক মারধর করে পুলিশ। এর পরেই উপাচার্যের ইস্তফার দাবিতে আন্দোলন এক ভিন্ন মাত্রা পায়। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককুল এবং তার সঙ্গে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় অভিজিৎবাবুর অদক্ষতা নিয়ে সরব হতে শুরু করেন। সেই সময় রাজ্য সরকার অবশ্য কারও কথায় কর্ণপাত করার প্রয়োজন মনে করেনি। আন্দোলনের ভরা মরসুমেই শাসক দলের কাছের লোক বলে পরিচিত অভিজিৎবাবুকে অস্থায়ী থেকে স্থায়ী উপাচার্য নিয়োগ করে দেওয়া হয়। বিদ্বজ্জনেদের একটা বড় অংশ বারবার আপত্তি করা সত্ত্বেও তার অন্যথা হয়নি। রাজ্য সরকার জানায়, সার্চ কমিটির পছন্দের তালিকায় অভিজিতের নাম এক নম্বরে।
এর পরে ছাত্র-শিক্ষকদের আন্দোলন আরও দানা বাঁধে। অভিজিৎবাবু ছাত্রছাত্রীদের সন্তানবৎ বলে উল্লেখ করে বা ১৬ সেপ্টেম্বরের রাতে পুলিশি নিপীড়নকে দুর্ভাগ্যজনক বলে মন্তব্য করেও নিজের গ্রহণযোগ্যতা প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন নিয়েও তৈরি হয় অভূতপূর্ব জট। ওই অনুষ্ঠানে আচার্যের কাছ থেকে শংসাপত্র নিতে অস্বীকার করেন এক ছাত্রী। পড়ুয়াদের অধিকাংশের অনুপস্থিতিতেই কার্যত সমাবর্তন অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। অনুষ্ঠানের মাঝপথে বেরিয়ে যান উপাচার্য। এর পরেও রাজ্য সরকার উপাচার্যের পাশেই ছিল। উপাচার্য নিজে দাবি করেছিলেন, “ফাবলিক আমাকে চায়।’’
কিন্তু ক্রমশ তৃণমূলের অন্দরেই শুরু হয় বিতর্ক। মুখ খোলেন পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়, ক্রেতা সুরক্ষামন্ত্রী সাধন পাণ্ডে। দলের লাইনের বিপক্ষে কথা বলেন সাংসদ সুগত বসুও। যাদবপুর যে তাদের সুনাম হারাচ্ছে সেই বিষয়ে মুখর হন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী, প্রাক্তন উপাচার্যেরাও। মুখ খোলেন বিজ্ঞানী বিকাশ সিংহ এবং অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুও। গত সপ্তাহ থেকে আমরণ অনশন শুরু করেন পড়ুয়ারা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে শিক্ষামন্ত্রী ডেকে পাঠান উপাচার্য, শিক্ষক সংগঠন জুটা এবং ছাত্র প্রতিনিধিদের।
রাজ্য সরকার যাদবপুরের অচলাবস্থা কাটাতে উদ্যোগী হচ্ছে বলে জানান পার্থবাবু। অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ছাত্রদের দেখতেও যান তিনি। পাশাপাশি, আচার্য রাজ্যপালও সম্প্রতি বিবৃতি দিয়ে উপাচার্যের প্রতি নিজের অসন্তোষ গোপন রাখেননি।
অবশেষে উপাচার্য সরে যাওয়ায় আন্দোলনকারী পড়ুয়ারা স্বাভাবিক ভাবেই উল্লসিত। সমাবর্তনে পদক ফেরানো প্রতিবাদী ছাত্রী গীতশ্রী সরকার বলেন, ‘‘এটা আমাদের লড়াইয়ের জয়।” ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র সংসদের নেতা চিরঞ্জিত ঘোষের কথায়, “কোনও দল বা নেতানেত্রীর সাহায্য ছাড়া অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে যাদবপুর নতুন দিগন্ত খুলে দিল। এই জয় ছাত্রছাত্রীদের।”
ছাত্রছাত্রীদের না হয় জয় হল, শেষ মুহূর্তে আসরে নেমে মুখ্যমন্ত্রী জিততে পারলেন কি? পোড় খাওয়া রাজনীতিকদের একাংশ বলছেন, মুখ্যমন্ত্রী জিততে চেয়েছিলেন। কিন্তু কার্যত তাঁর অস্ত্র ব্যুমেরাং হয়ে ফিরে এল। তিনি যে কতটা চাপে আছেন, তিন মাসের মধ্যে নিজের পছন্দের লোককে ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়ে সেটা সকলকে দেখিয়ে দিলেন। আর যে পদ্ধতিতে ফিরিয়ে নিলেন, তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব পরিসরে মাথা গলিয়ে রাজনীতির অনুপ্রবেশকেই বেআব্রু করে দেওয়া হল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy