Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
Travel tips

বেতলার অরণ্যপথ বেয়ে ক্ষীণকটি কোয়েলের কাছে

জঙ্গলের বুকে সোনাঝুরির গা চুঁইয়ে হলুদ সোনা। সে সোনা আলোয় পেখম ছমছমিয়ে ময়ূরটা হারিয়ে গেল সঙ্গিনীকে নিয়ে। লিখছেন অঞ্জন সরকারআমাদের গন্তব্য ঝাড়খণ্ডের লাতেহার জেলায় ছোটনাগপুর মালভূমির ২২৬.৩৩ বর্গ কিলোমিটারের বেতলা জাতীয় উদ্যান।

বারশিঙ্গাটা ছিটকে এল পাশের জঙ্গল থেকে, রাস্তা পার হল দ্রুত। ছবি: অঞ্জন সরকার

বারশিঙ্গাটা ছিটকে এল পাশের জঙ্গল থেকে, রাস্তা পার হল দ্রুত। ছবি: অঞ্জন সরকার

শেষ আপডেট: ২৬ জুলাই ২০১৯ ২১:২১
Share: Save:

রাত ১টা ২০ মিনিট... শক্তিপুঞ্জ এক্সপ্রেস বারওয়াদি স্টেশনে আমাদের যখন নামিয়ে দিয়ে চলে গেল, তখন গোটা স্টেশনটা ঘুমের মোড়কে ঢাকা। আমরা পাঁচ মূর্তিমান ব্যাগপত্তর নিয়ে স্টেশনের বাইরে এসে দাঁড়ালাম। আসলাম ভাই তো ফোনে তাই বলে দিয়েছিলেন, ‘একটু দাঁড়ান, আমি গাড়ি নিয়ে আসছি’। এ বার আমাদের গন্তব্য ঝাড়খণ্ডের লাতেহার জেলায় ছোটনাগপুর মালভূমির ২২৬.৩৩ বর্গ কিলোমিটারের বেতলা জাতীয় উদ্যান। স্টেশনের হাতায় দাঁড়িয়ে টুকটাক গল্পের মাঝেই জিপ হাজির। মালপত্র সমেত উঠে বসি। আধ ঘণ্টায় পৌঁছে যাই ন্যাশনাল পার্কের মূল ফটকে। গাড়ি পার্ক করে পথ দেখিয়ে আমাদের জঙ্গলের মাঝে গাছবাড়িতে (ট্রি হাউস) পৌঁছে দিয়ে সে দিনের মতো বিদায় নিলেন আসলাম, পরদিন ব্রেকফাস্টের পরে আসবেন বলে। একটু ফ্রেশ হয়ে আমরাও ঘুমের দেশে।

জঙ্গলের মধ্যে গাছবাড়ি

ভোর সাড়ে পাঁচটায় যখন ঘুম ভাঙল, জানলা দিয়ে বাইরে চোখ মেলে দেখি গাছবাড়ির সামনে ফাঁকা জায়গাটায়, যার পিছনে জঙ্গলের শুরু সেখানে প্রচুর হরিণ আর হনুমানের দল। দুটো শেয়াল জঙ্গল থেকে ছুটে বাইরে এসে আবার ঢুকে গেল জঙ্গলে। অজস্র ঘুঘু আর দোয়েলের ব্যস্ততা, তাদের মাঝে বেমানান একটা ল্যাপউইং। পাপিয়ার ডাকে মন ভাসিয়ে আর জঙ্গলের নিস্তব্ধতায় ঝরা পাতার শব্দ শুনতে শুনতে আমরা দিনের প্রথম জঙ্গল সাফারির প্রস্তুতি শুরু করলাম। শুরুতেই অজস্র হনুমান আর বাঁদরের দল নানা ভঙ্গিমায় ফ্রেমবন্দি হওয়ার অপেক্ষায়। হরিণেরা ইতিউতি। বাঁদর ছানাদের খুনসুটি দেখতে দেখতেই জিপ উধাও। এ জঙ্গলে শাল, সেগুন, মহুয়া, কেন্দু, ইউক্যালিপ্টাসের আধিক্য। ‘ড্রাই ডেসিডুয়াস ফরেস্ট’। মে মাসের শেষে এই প্রখর গরমে (৪৪-৪৫ সেলসিয়াস) জঙ্গল প্রায় শুকনো। গাইডের কথায়, হরিণের জোরে ছুটে চলাতেও এই শুকনো পাতায় আগুন ধরে যেতে পারে। ওয়াটার হোলে জল খেতে আসা শিকরাটা জিপের আওয়াজে ডানা মেলে দিল, বসল গিয়ে একটা কেন্দুর ডালে। বারশিঙ্গাটা ছিটকে এল পাশের জঙ্গল থেকে, রাস্তা পার হল দ্রুত। ছোট্ট বাঁদরছানাটা মুখ লুকাল মায়ের কোলে।

হাওয়ায় ভেসে এল একটা আঁশটে গন্ধ। জিপ থমকাল। রাস্তার ডান দিকে জঙ্গল ছুঁয়ে নরম মাটিতে একটা বুনো শুয়োরের দেহ। ঘাড়টা এক দিকে হেলে, পেটটা ফালা হয়ে আছে...। অভিজ্ঞ চালক আর গাইডের কথামতো— চিতাবাঘের শিকার। পাশের জমিতে তার পায়ের ছাপ। ক্যামেরায় ধরে রাখি। নিচু এক জলাধারের গায়ে ঘুরে বেরনো বনমোরগ। একটু দূরে জলের গায়ে জলছবি হয়ে থাকা হাঁড়িচাচা।

সারপেন্ট ঈগলের শ্যেন দৃষ্টি...

ওয়াচ টাওয়ারের গা দিয়ে গাড়িটা ঘুরতেই একটা নীলকণ্ঠ শুকনো জঙ্গলের ক্যানভাসে ফিরোজা নীল ডানা মেলল। ছবি হয়ে গেল পাখিটা। চাকা গড়াতেই বনবিভাগের গাড়ির সঙ্গে দেখা। ৪ নম্বর রাস্তায় বাইসন (গাউর) দেখা গেছে। সুতরাং দে দৌড় সে পথে। পৌঁছে দেখি একটা ওয়াটার হোল আর সল্ট লিক-এর কাছের জঙ্গলে ছ’টা বাইসনের একটা দল। আশ মিটিয়ে ছবি তুলি। জঙ্গলের বুকে সোনাঝুরির গা চুঁইয়ে হলুদ সোনা। সে সোনা আলোয় পেখম ছমছমিয়ে ময়ূরটা হারিয়ে গেল সঙ্গিনীকে নিয়ে। গরম হাওয়ার হলকা আমাদের মুখে। সারপেন্ট ঈগলের শ্যেন দৃষ্টি...। গজেন্দ্র গমনে গজরাজ আর তার পরিবার...। মনের মণিকোঠায় আর ক্যামেরার স্মৃতি-কার্ডে ধরা থাকে টুকরো-টুকরো ছায়াছবি। প্রচণ্ড গরমে পাখিরাও ক্লান্ত, ডাকতে ভুলেছে। ফিরছি যখন সাঁঝের আকাশ আকাশের দিকে হাত বাড়ানো গাছেদের শুকনো ডাল ছুঁয়েছে। ‘ডাস্কি ঈগল আউল’টা ঘাড় ফেরাল আমাদের দিকে, শেষ সূর্যের আলো ওর চোখে। কমলা-হলুদ সূর্যটা মায়া বুনছে বেতলার মাটিতে... আমরা জঙ্গল ছেড়ে বাইরে আসছি। ‘ইন্ডিয়ান গ্রে হর্নবিল’ মুখ বাড়াল মহুয়ার পাতার আড়াল থেকে।

গজেন্দ্র গমনে গজরাজ

পরের দু’দিন আবারও এসেছি জঙ্গলে। তবে তার ফাঁকে ফাঁকে দেখতে ভুলিনি আশপাশটা। কখনও মারোমার জঙ্গলের শুনশান আর তার মাঝে প্রজাপতির ওড়াউড়ি। কৃষ্ণচূড়ার হাসি নিয়ে সুগাবাঁধ। তার পাথুরে ঢাল বেয়ে বয়ে চলা জলের জলতরঙ্গ... লোধ জলপ্রপাতের উচ্ছ্বলতা... পদ্মগন্ধী কমলদহ..., মহুয়াটাঁড়ের পথে পালামৌ-এর নতুন আর পুরনো কেল্লার খণ্ডহর... তার মাঝে হারিয়ে থাকা ইতিহাসের গন্ধ..., সত্যজিৎ রায়ের স্মৃতি জড়ানো কেঁচকির বাংলোবাড়ি (অরণ্যের দিনরাত্রি সিনেমার বাংলো)...।

কেঁচকি সঙ্গমে

কেঁচকি সঙ্গমে আফরোজ যখন আমাদের জিপ ঘোরাল, চাকার ধুলো মিশল ঘরে ফেরা গোরুদের পায়ের ধুলোয়, গোধূলিতে... সূর্য ডুবছিল জঙ্গলের আড়ালে। ভেজা বালিতে পায়ের ছাপ পিছে ফেলে রেখে ঘরমুখো গ্রামের মেয়েরা, মাথায় দিনযাপনের জ্বালানি কাঠির বোঝা... একটা দারুণ পিকটোরিয়াল কম্পোজিশন... পশ্চিমের সূর্যাস্তের আকাশ। সুন্দর বললেও কম বলা হয়। তার লাজুক হাসি, মুখ লুকায় তিরতির করে বয়ে চলা ক্ষীণকটি কোয়েলের বুকে... কোয়েল যে খুঁজে ফেরে ঔরাঙ্গাকে...। জীবনের খোঁজে...।

লোধ জলপ্রপাত

কী ভাবে যাবেন: কলকাতা/হাওড়া থেকে ডালটনগঞ্জ/বারওয়াদি স্টেশনে যাওয়ার গোটা ছ’য়েক ট্রেন আছে। ১৩০২৫, ১৯৪১৪, ১৯৬০৫, ১১৪৪৮, ০৩১৩৭ আর ১৯৬০৭ আপ। স্টেশনে নেমে গাড়িতে বেতলা। কখন যাবেন: অক্টোবর থেকে মার্চ সব থেকে ভাল সময়। গরম সহ্য করতে পারলে মে মাসেও যেতে পারেন। কোথায় থাকবেন: জঙ্গলের ভিতর বনবিভাগের ট্রি হাউস। জঙ্গলের বাইরে ঝাড়খণ্ড ট্যুরিজমের ‘বনবিহার’। এ ছাড়া ট্যুরিস্ট লজ অথবা আরাধ্যা হোটেল। তবে ট্রি হাউস কিংবা বনবিহার-ই নির্ভরযোগ্য। যোগাযোগ: ১) সি সি এফ/ফিল্ড ডাইরেক্টর অব ফরেস্ট, ফোন: ০৬৫৬২-২২২৬৫০

২) পি সি সি এফ ওয়াইল্ড লাইফ এবং সি ডব্লিউ এল ডব্লিউ

ফোন: ০৬৫১-২৪৮১৭৪৪, ই মেল:pccfwljharkhand@gmail.com

৩) ঝাড়খণ্ড ট্যুরিজম। ওয়েবসাইট: jharkhandtourism.gov.in

৪) বেতলা ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলস, ফোন: ৯৯৫৫৫২৭৩৭১

আরও পড়ুন: চা-বাগানের রোমাঞ্চ ও নিখাদ অবসরের টানে চলুন অসমে

অন্য বিষয়গুলি:

travel tips betla forest tree house
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy