তপন
পুনর্ভবা নদীর সেতু পেরিয়ে বেলা দশটা নাগাদ গৌড় এক্সপ্রেস পৌঁছে দিল গঙ্গারামপুর স্টেশনে। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ‘এই বৃষ্টি’ আর ‘নেই বৃষ্টি’র মধ্যেই এই যাত্রা দু’দিনের ছোট্ট ছুটিতে। যাত্রীদের নামিয়ে ঝমঝমিয়ে ট্রেন চলে গেল দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার বালুরঘাটের দিকে। ইতিহাস ও কিংবদন্তীর গল্পগাথায় আকর্ষণীয় উত্তরবঙ্গের এই অ়ঞ্চলে আসার ইচ্ছেটা ছিল অনেক দিনেরই। কিন্তু ফলপ্রসূ হল এ বারেই। স্টেশন থেকে ভাড়া গাড়িতে মিনিট পনেরোর মধ্যেই পৌঁছে গেলাম তপন। ঠিক করেছি তপন থেকেই ঘুরে নেব আশপাশের দর্শনীয় জায়গাগুলি। ঠাঁই নিয়েছি তপনের রাধাগোবিন্দ মন্দির সংলগ্ন অতিথিশালায়। তপনে থাকার হোটেলগুলি জনপদের মধ্যেই। কোলাহলের তাড়না থেকে মুক্তি পেতে নেওয়া সিদ্ধান্তটা যে এমন যুৎসই হবে আগে ভাবিনি। মন্দির সংলগ্ন অতিথিশালাটি সদ্যনির্মিত। অবস্থানটিও চমৎকার। ধানখেতের চোখজুড়নো সবুজ বিস্তৃতি, পুকুর, দিঘি, গাছপালা দিয়ে ঘেরা জায়গাটি প্রথম দর্শনেই মুগ্ধ করল।
পুনর্ভবা নদী
চার বিঘা জমির উপর গড়ে ওঠা বিশাল মন্দিরটি এখন তপনের এক অন্যতম দর্শনীয় স্থান। দ্বিতল মন্দিরে দেব অধিষ্ঠান উপরের তলায়। সেখানে রাধাকৃষ্ণ, জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রা, কালী, দুর্গা সমেত বহু মূর্তি অধিষ্ঠিত। মন্দির দর্শন করতে গিয়েই দেখা হল মহারাজের সঙ্গে। সৌম্যদর্শন, সন্ন্যাসী মানুষটির সঙ্গে আলাপচারিতায় জেনে নিলাম তপন, গঙ্গারামপুর-সহ পুরো এলাকার অনেক তথ্য। পরে যেটা ঘোরার ক্ষেত্রেও পথ দেখানোর কাজ করল অনেকটাই । জায়গার নাম যে তপন, এটা এসেছে তর্পণ শব্দ থেকে। কথিত আছে, সেন বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা লক্ষণ সেন প্রায় এক কিলোমিটার দৈর্ঘের এক দিঘি খনন করিয়েছিলেন পূর্বপুরুষের স্মৃতিতে তর্পণ করার উদ্দেশ্যে। তর্পণের উদ্দেশ্যে সৃষ্ট সেই তর্পণ দিঘির নাম কালে কালে হয়ে দাঁড়ায় তপন দিঘি। আর এলাকার নামটিও সেই নামের অনুসারী হয়েই রূপ পায় তপনে।
মধ্যাহ্নভোজের পরেই বেরিয়ে পড়লাম বানগড়ের উদ্দেশ্যে। কিংবদন্তী অনুসারে, মহাভারতের সময়কালে বানাসুর বা বানরাজার সাম্রাজ্য ও রাজধানী ছিল এখানেই। সেই পরাক্রমশালী শিবভক্ত বানাসুর, যার কন্যা ঊষা কৃষ্ণপুত্র অনিরুদ্ধের প্রেমে পড়েন। বিয়েও হয় তাঁদের। তার পরেই ঘটে ধুন্ধুমার কাণ্ড। ক্রুদ্ধ বানাসুরের সঙ্গে প্রবল যুদ্ধ হয় শ্রীকৃষ্ণের। সৃষ্টি রসাতলে যাওয়ার উপক্রম। শিবের বরপ্রাপ্ত বানাসুরকে বধ করতে না পেরে কৃষ্ণের সুদর্শনচক্র বানাসুরের হাতের আঙুলগুলি কেটে দেয়। বানাসুর বশ্যতা স্বীকার করেন।
আরও পড়ুন: হিমাচলের জালোরি পাস হয়ে অল্পচেনা রূপকথার সোজা গ্রামে
বিশাল জায়গা নিয়ে রাজমহল বা রাজপ্রাসাদের চারপাশ ঘিরে নাকি ছিল পরিখা, যাতে কুমির ছাড়া থাকত শত্রুকে বাধা দেওয়ার জন্য। এক দিকে এখনও সেই পরিখার জলের বিস্তৃতি দেখতে পেলাম। বাকি দিকগুলি অবশ্য শুকিয়ে গিয়েছে। যে দিকটা পরিখার জল দেখতে পেলাম সেই দিকটা ধরে কিছুটা এগিয়ে গাড়ি পৌঁছে দিল আর এক আকর্ষণীয় জায়গায়। ঊষা-অনিরুদ্ধর বিবাহস্থল। একটা পাথরের চাতাল যার চারপাশে রয়েছে চারটি উঁচু স্তম্ভ। এখানেই নাকি বিয়ে হয়েছিল ঊষা ও অনিরুদ্ধের, এমনটাই হল লোকগাথা। যুগ যুগ ধরে এই স্তম্ভগুলিই নাকি সেই মঙ্গলানুষ্ঠানের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। গেস্ট হাউসে ফেরার পথে মড়কাভদ্রা কালীমন্দিরে নিয়ে গেলেন গাড়িচালক। কলেরার প্রকোপে মড়ক লেগে বহু মানুষ একসময় মারা গিয়েছিল এই অ়ঞ্চলে। সেই ভয়ঙ্কর প্রকোপের হাত থেকে বাঁচার জন্য মড়কাভদ্রা কালী পূজিত হন এই ছোট্ট মন্দিরটিতে। মন্দিরের পাশের জমি খুঁড়ে পাওয়া যায় দ্বাদশ শতকের (সেনযুগের) চতুর্ভুজ বিষ্ণুর অনবদ্য এক মূর্তি, যেটি বর্তমানে এই মন্দিরের এক বিশেষ দ্রষ্টব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তপন রাধাগোবিন্দ মন্দিরে যখন এলাম, তখন পশ্চিম আকাশ অস্তরাগের রঙে রঞ্জিত। সেই রক্তিম আভায় লাল হয়ে উঠেছে পুষ্করিণী। অতিথিশালার সামনে থেকেই এক অপরূপ সূর্যাস্ত চোখে পড়ল।
রাধাগোবিন্দ মন্দির
সন্ধ্যায় মহারাজের সঙ্গে আবার সাক্ষা়ৎ হল মন্দির চত্বরে। জানালেন, রথ এখানে ধুমধাম করে পালিত হয়। কাঠের তৈরি তিনটি বড় সুদৃশ্য রথ আজ সকালেই চোখে পড়েছে এখানে পা দিয়ে। রথের সময়ে তপনের আবালবৃদ্ধবনিতার ভিড় হয় এখানে। বড় এক মেলাও এখানে বসে সে সময়। কথায় কথায় মহারাজ জানালেন পুরীর মন্দিরের কাছাকাছি উচ্চতার এক বিশাল জগন্নাথ মন্দির তাড়াতাড়িই গড়ে উঠবে এখানে। প্রায় দেড়শো কোটি টাকা ব্যয়ে এই জগন্নাথ মন্দিরটির নির্মাণপর্ব শেষ হলে দূরদুরান্ত থেকে বহু মানুষের ভিড় যে বাড়বে তপনে, তাতে সন্দেহ নেই। মহারাজই বললেন, এক বার বালুরঘাট মিউজিয়ামটিও দেখে নিতে। বানগড় খননকার্যের পর যে সব মূর্তি পাওয়া গিয়েছে, তার বেশির ভাগই প্রদর্শিত হয়েছে বালুরঘাট মিউজিয়ামে।
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙল তাড়াতাড়ি। নির্জন, নিস্তব্ধ পরিবেশে পাখির আনাগোনা শুরু হয়ে যায় ভোর থেকেই। প্রাতরাশ সেরে বেরিয়ে পড়লাম আশপাশের দ্রষ্টব্য জায়গাগুলি দেখে নেওয়ার জন্য। এই অঞ্চলে বলতে গেলে মাটির উপরে যতটা ইতিহাস রয়েছে, মাটির তলায় বোধ করি সেঁধিয়ে রয়েছে তার থেকেও বেশি ইতিহাস। সেই গরিমাকে অনুভব করার এক অমোঘ আকাঙ্খা নিয়েই তো আছি এখানে। প্রথমেই গেলাম ভায়োর-এর ঘণ্টেশ্বরী মন্দিরটি দেখতে। আদি মন্দির এবং দেবীমূর্তিটি ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল কুখ্যাত সেই কালাপাহাড়। দেবী মূর্তির ভাঙাচোরা যেটুকু অংশ এখনও চোখে পড়ে মন্দির প্রাঙ্গণে, তার অনুপম স্থাপত্যই জানান দেয়, ভাঙার আগে কি অসাধারণ রূপই না ছিল এই দেবীমূর্তির! ভায়োর মন্দির দেখে পৌঁছলাম ইসলামি সাধক মৌলানা আতা শাহের দরগায়। এই অঞ্চলে দু’টি বড় ও সুদৃশ্য দিঘি রয়েছে। কালদিঘি ও ধলদিঘি। এই ধলদিঘির উত্তরপাড়েই আছে মধ্যযুগের ইসলামিক সাধক মৌলানা আতাউদ্দিন শাহের দরগা ও মসজিদের ধ্বংসাবশেষ। অতীতে এই অঞ্চলেই নাকি ছিল বিখ্যাত দেবীকোট বৌদ্ধবিহার, যে বিহারে অধ্যয়ন করতেন অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান।
বানগড়
পরবর্তী দর্শনীয় স্থান হরিরামপুরে অবস্থিত বৈরাট্টাগ্রামে। জনশ্রুতি অনুসারে, মহাভারতে বর্ণিত বিরাট রাজার প্রাসাদ ছিল এখানেই। আর বিরাট নামের থেকেই নাকি পরবর্তী কালে এই বৈরাট্টা নামটি এসেছে। পান্ডবরা অ়জ্ঞাতবাসে থাকাকালীন অনেকটা সময় কাটিয়েছেন এখানে। বিশাল এক শমীবৃক্ষ দেখালেন গাড়িচালক, যে গাছের ডালপালার ফাঁকে পান্ডবরা লুকিয়ে রেখেছিলেন তাঁদের অস্ত্রশস্ত্র, নগরে প্রবেশের আগে। তেমনটাই শুনলাম। ইতিহাস ও কিংবদন্তীর মেলবন্ধনে এই গোটা অঞ্চলটাই যেন হয়ে দাঁড়িয়েছে পুরাতাত্ত্বিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিক বিস্ময়।
তৈরী হচ্ছে মিষ্টি দই
এই অঞ্চলের আর এক বিখ্যাত জিনিস হল নয়াবাজারের মিষ্টি দই। দুধ এবং ক্ষীর এই দু’য়েরই দই পাওয়া যায়। এখানে ৪০-৫০টি পরিবার তাদের ঘরেই তৈরি করে এই অসাধারণ দই।
গাড়ি এগিয়ে চলল বালুরঘাটের উদ্দেশে। মিউজিয়াম তো না দেখলে চলবে না। পথে থামলাম এক বারই। বিদ্যেশ্বরী কালীমন্দিরে। খুবই পবিত্র এই শক্তিপীঠে সাধক বামাক্ষ্যাপা তারাপীঠ থেকে এসেছিলেন বহু বার। এটাও শোনা যায় যে আত্রেয়ী নদী দিয়ে বজরা করে ডাকাতির উদ্দেশ্যে যখন কোথাও যেতেন দেবী চৌধুরানি ও তাঁর গুরু ভবানী পাঠক, তখন এই মন্দিরে পুজো দিয়েই যেতেন তাঁরা। মন্দির দর্শন করে আবার শুরু হল পথচলা। আত্রেয়ী নদীর সেতু পেরিয়েই বালুরঘাটের প্রবেশপথ। বর্ষায় প্রশস্ত নদী বয়ে যাচ্ছে যথেষ্ট উচ্ছ্বাস নিয়েই। মাঝে একটা দ্বীপের মতো তৈরি হয়েছে, তাকে মাঝখানে রেখে দু’দিক পানে আলাদা হয়েছে জলাধারা। জেলা সদর বালুরঘাটে পৌছে মিউজিয়ামে ঢুকে পড়লাম (সোমবার বন্ধ, বাকি দিনে সকাল ন’টা থেকে বিকাল পাঁচটা অবধি খোলা থাকে)। মৌর্য আমলে পুন্ড্রবর্ধন, গুপ্তযুগে কোটিবর্ষ, পালযুগে দেবকোট— এ সব আলাদা নামকরণ থাকলেও, বানগড় ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা প্রাচীন বাংলায় যে এক অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ ও মহিমান্বিত জায়গা ছিল সে ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই। বানগড় ও আশপাশের এলাকা থেকে খননকার্যের ফলে পাওয়া মূর্তি ও অন্যান্য জিনিস নিয়েই গড়ে উঠেছে দ্বিতলবিশিষ্ট এই মিউজিয়ামটি। যে মূর্তিগুলি প্রদর্শিত আছে তাদের সময়কাল খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতক থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত। মূলত বেলেপাথর ও কষ্ঠিপাথর নির্মিত এই মূর্তিগুলির স্থাপত্য ও শিল্পসুষমা বিশেষ ভাবে তারিফযোগ্য। কৃষ্ণ-যশোদা, লোকেশ্বর বিষ্ণু, অষ্টভুজ গণেশ, লক্ষ্মী-নারায়ণ, চণ্ডী, অর্ধনারীশ্বর, মহিষাসুরমর্দিনী ইত্যাদি অভিনব মূর্তিগুলি যে অসাধারণ শৈল্পিক দক্ষতার সাক্ষ্য বহন করে, তা দেখলে সত্যিই বিস্মিত হতে হয়। এ সব কারুকার্যময়, সুন্দর মূর্তিগুলি ছাড়াও প্রাচীনকালের বাঁশের পুঁথি, তালপাতার পুঁথি, পোশাক, রৌপ্যমুদ্রা দেখবার মতো।
খননকার্যে উদ্ধার হওয়া দুর্গামূর্তি
মিউজিয়াম দেখার পরই শেষ হল দক্ষিণ দিনাজপুরের এই অঞ্চল দেখার পালা, এ বারের মতো। দু’দিনের ছোট্ট ছুটির অবকাশে, ইতিহাস, কিংবদন্তীর স্পর্শ গায়ে মাখার জন্য বাংলার যে প্রান্তে এসেছিলাম সেখানে পর্যটক এখনও বড় একটা আসে না। কিন্তু দর্শনীয় ও আকর্ষণীয় গন্তব্যের বিচারে অচিরেই এই জায়গা যে পর্যটন তালিকায় একটা বিশেষ জায়গা করে নেবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে প্রাচীন পুঁথি
আরও পড়ুন: সিকিমের নাথাং ভ্যালির পরনে যেন মেঘের পাগড়ি
কোথায় থাকবেন: তপনকে কেন্দ্র করে ঘুরে নিতে পারেন এই অঞ্চলের দর্শনীয় জায়গাগুলি। রাত্রিবাস করতে পারেন সুন্দর পরিবেশে অবস্থিত রাধাগোবিন্দ মন্দির সংলগ্ন গেস্ট হাউসে। এসি দ্বিশয্যা ঘরের ভাড়া ৬০০ টাকা। নন এসি দ্বিশয্যা ঘরের ভাড়া ৪০০ টাকা, ডরমিটরির ভাড়া ১৫০ টাকা (প্রতি শয্যা)।
বুকিংয়ের জন্য যোগাযোগ: ৯১৫৩১৯৫৭৭১
ওয়েবসাইট: tapanradhagobindasebashram@gmail.com
ছবি:লেখক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy