Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

সমুদ্র ও সবুজের কানাকানি

সপ্তাহান্তে ছোটখাটো ট্রিপের জন্য ওড়িশার কাছে বিচিত্রপুর হতে পারে আপনার পছন্দের।সপ্তাহান্তে ছোটখাটো ট্রিপের জন্য ওড়িশার কাছে বিচিত্রপুর হতে পারে আপনার পছন্দের।

নৌবিহার।

নৌবিহার।

গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ এপ্রিল ২০১৯ ০০:০৬
Share: Save:

সূর্য এখন পশ্চিমে ঢলছে। ম্যানগ্রোভের আঁকিবুকি দিয়ে যতটা দৃশ্যমান হয় খাঁড়ির জল, তা আদিগন্ত লাল। এই লাল আভার এক অন্য রূপ। দিন আর রাতের সন্ধিক্ষণটা এখানে বড় মোহময়। সূর্যের রূপও এ তল্লাটে এখন ক্ষণে ক্ষণে বদলে যাচ্ছে। এক সময় মনে হচ্ছিল, এখন ভোর নয় তো? সমুদ্রের জল তখন এতটাই লাল। নিজেকে চিমটি কেটে, সঙ্গিনীর হাতঘড়িটার দিকে তাকিয়ে সময়ের ভ্রম কাটে।

টানা সমুদ্রের খাড়ি বেয়ে আসতে আসতে দু’পাশে জলে নুয়ে পড়া ম্যানগ্রোভ যেন নতজানু হয়ে বিচিত্রপুরে আমাদের স্বাগত জানাচ্ছিল। জলের সঙ্গে গাছেদের এই কানাকানি এক অদ্ভুত দৃশ্য রচনা করে। আর উপরে এক সরলরেখায় সারিবদ্ধ সবুজ ম্যানগ্রোভ নীল আকাশপানে যেন নিরাসক্ত ভাবে চেয়ে থাকে। নাম না জানা ঘরে ফেরা পাখির ডানায় ভর করে দিনের আলোটুকু তখন ফুরিয়ে আসছে। স্পিড বোটে ভ্রমণ আপাতত স্থগিত। পাড়ে নৌকো ভিড়ালেন সারেং। ম্যানগ্রোভকে আঁকড়ে ধরে উপরে আমাদের ডাঙা মিলল।

আমাদের জন্য বালিয়াড়ির অস্থায়ী দোকানে কফি তৈরিই ছিল। এল পটেটো চিপস। জলভ্রমণের শেষে কফিতে লম্বা চুমুক। তবে সেই চুমুক স্বস্তি দিল না। দিনের আলো থাকতে থাকতেই সবটুকু শুষে নিতে চাইছিল দু’চোখ। তাই চুমুক মারার ফাঁকেই দূরে লাল রঙের আভায় দোলযাত্রায় সমুদ্রস্নানের দৃশ্য দেখে আমরা যেন স্থির থাকতে পারলাম না। এ এক অন্য পৃথিবী। একেবারে অচেনা। এখন আমরা সমুদ্র দর্শনে।

ম্যানগ্রোভে জলের দাগ জানান দিচ্ছিল ভরা কোটালে ঢেউ ছুঁয়ে যায় এই গোটা চত্বর। ম্যানগ্রোভের জঙ্গলের সমস্ত গাছই এখানে ঈষৎ বাঁয়ে হেলা। দিনকতক আগের ঝড় তার স্মৃতিচিহ্নটুকু এখানে রেখে গিয়েছে। ম্যানগ্রোভের সঙ্গেই ক্যাসুরিনা এখানকার জঙ্গলকে এক অন্য মাত্রা দিয়েছে। সব রইল পিছনে পড়ে। সমুদ্রের দিকে আমরা টানা হেঁটে চলেছি। প্রকৃতিবিজ্ঞানীরা বলতে পারবেন, এখানে সম্ভবত সমুদ্রের গ্রাস থেকে ম্যানগ্রোভই বাঁচিয়ে রেখেছে টানা বালিয়াড়ির এই তল্লাটকে। তটের সঙ্গে কানাকানির আকুতিতে সমুদ্র এগিয়ে আসায় এখানকার বালি ভিজে। তাই আমাদের আরও খানিক যেতে হবে ভিজে বালি মাড়িয়ে। হোক না খানিক দূরে সমুদ্র! তা তো আপনাকে টানবেই। এখন সমুদ্র অনেকটাই ধীর স্থির। সম্ভবত ভাটার দুলকি চালে তার ভয়সুন্দর রূপটা অনেকটাই অনুপস্থিত।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

সারেং জানালেন, খাঁড়ি যেখানে সমুদ্রে মিশছে, সেখানে জলের ওঠাপড়া অনেকটাই বেশি। তাই পর্যটকদের সেখানে যেতে তাঁরা উৎসাহ দেন না। তবে মৎস্যজীবীদের নৌকো ওই পথেই সমুদ্রে যাচ্ছে অহরহ। এখানে অবশ্য সমুদ্রের গর্জন আর ঝড় থেকে আড়াল খুঁজতে খাঁড়িতে জেলেদের বড় বড় মাছ ধরার নৌকো বিশ্রামে আসে। মাঝিমাল্লারা নানা রঙের নৌকোয় তাঁদের জাল বিছিয়ে শুকিয়ে নেওয়ার কাজ সারছেন রুটিন মেনে। রং-বেরঙের সাজানো নৌকোয় খাঁড়ির এই জায়গা অনেকটাই যেন সমুদ্র বন্দরের চেহারা নিয়েছে।

টুকিটাকি

কী ভাবে যাবেন
ট্রেনে ওড়িশার জলেশ্বর স্টেশন থেকে ৪৮ কিলোমিটার। সড়ক পথে এক ঘণ্টা সময় লাগে। হাওড়া থেকে ট্রেনে দিঘা। তার পরে সড়ক পথে ১২ কিমি। তাজপুর থেকে সড়ক পথে যেতে হলে দূরত্ব মোটামুটি ২০ কিলোমিটার।

বাংলোর বারান্দা থেকে

সকালে সূর্যকে সাক্ষী করে তাজপুর থেকে শঙ্করপুরের পথে টানা আট কিলোমিটার মেরিন ড্রাইভ বিচ ছুঁয়ে আমরা হোটেল থেকে রওনা দিয়েছিলাম। এই পথে ভূষণ্ডেশ্বরের মন্দির। মাটি থেকে ওঠা এই মহাদেশের সবচেয়ে বড় শিবলিঙ্গ দর্শনও আমরা সেরে ফেলেছি। ওড়িশার তালসারি, চন্দনেশ্বর ছুঁয়ে সোজা বিচিত্রপুর ম্যানগ্রোভের টানে। বিচিত্রপুর ইকো-টুরিজ়ম প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে খ্যাত। প্রশিক্ষণ না বলে অবশ্য নিরীক্ষণও বলা যায়। ভূগোল বলছে, ৫৬৩ হেক্টর বিস্তৃত এই বালির চরাচর। এখানে শীতের আবেশে বহু পরিযায়ী পাখি আতিথ্য গ্রহণ করে গাছে গাছে। সমুদ্রের পাড়ে তাদের খাওয়ার মস্ত আয়োজন। হরেক রকমের মাছ। তার সঙ্গেই থাকে এলাকার পাখি (রেসিডেন্ট বার্ড)। বালির মধ্যে স্থায়ী বাসিন্দা নানা প্রজাতির কাঁকড়া। ওড়িশা পর্যটন কেন্দ্রের বাংলোয় এখানে থাকার দিব্যি ব্যবস্থা আছে। তবে ম্যানগ্রোভের জঙ্গল গাছগাছালি আর পাখির নিরাপদ আশ্রয়ের কাছে সরাসরি পৌঁছতে এখানে ভরসা সরকারি ব্যবস্থা।

সকাল ৯টা থেকে অন্তত ১০টি সরকারি স্পিড বোট ছাড়ে। হয় খুব সকালে, আর না হলে দুপুর গড়িয়ে বিকেলটাই এখানে প্রকৃতি নিরীক্ষণের মোক্ষম সময়। কেউ শুধু মাত্র নিরিবিলি চাইলে কলকাতা থেকে ট্রেনে দিঘা এসে গাড়িতে সওয়ার হয়ে সোজা পৌঁছে যেতে পারেন বিচিত্রপুরে। আবার কলকাতা থেকে সরাসরি গাড়িতে আসাও যায়। সমুদ্রের চুপচাপ আস্বাদ নিতে। পরিবারের সবাইকে নিয়ে ঝুপ করে নেমে পড়া বালিয়াড়িতে। তবে আমরা গিয়েছিলাম স্রেফ জ্যোৎস্না দেখতে। এর জন্য আপনাকে হোটেলে ফিরতে হবে একেবারে শেষের স্পিড বোটে। এক দিকে ম্যানগ্রোভের জঙ্গল আর অন্য দিকে জ্যোৎস্নার আধো আলো আধো অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া। পাশের জঙ্গলে হঠাৎ অজানা জীবজন্তুর গা ছমছমে আওয়াজ! পরিবেশের এক বাড়তি মজা আছে এই চত্বরে।

তবে বেড়ানো কিন্তু এখানেই শেষ নয়। আছে আরও। রাতে গাড়িতে ফের শঙ্করপুরের মেরিন ড্রাইভ বিচ হয়ে সমুদ্রকে ডান হাতে রেখে ফেরা। চাঁদের ভরা জ্যোৎস্নায় চিকচিক করছে সমুদ্রে ঢেউয়ের মাথাগুলো। এখনই হোটেলে ফিরলে কিন্তু রাতটাই মাটি। গাড়ি সোজা নেওয়া হল তাজপুরের বিচে। রাতের খাবারের মেনু সমুদ্র পাড়ের হোটেলে বলে এসে, চুপচাপ জ্যোৎস্না ভরা সমুদ্রের মুখোমুখি চেয়ার নিয়ে বসা। চাঁদ এখন উজাড় করে তার সবটুকু আলো ঢেলে দিচ্ছে সমুদ্রের জলে। চোখ ফেরানো কঠিন। ঠিক তখনই আমাদের এক বন্ধু আবৃত্তি করতে শুরু করলেন—

সব পাখি ঘরে ফেরে

সব নদী

ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন

থাকে শুধু অন্ধকার

মুখোমুখি বসিবার

বনলতা সেন...

অন্য বিষয়গুলি:

Travel Weekend Tour Odisha Bichitrapur
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE