Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪
Travel

পাহাড়ি গ্রামে দিনযাপন

কুমায়ুনী গ্রাম কাসারে সন্ধে নামে সূর্যের রঙিন তুলি বুলিয়েঅবশেষে কাসার এসে পৌঁছলাম। রাস্তার দিক নির্দেশনামা দেখে বুঝলাম, বিনসর বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছি প্রায়।

স্বর্গীয়: ছায়া চরাচর জুড়ে পাহাড়ি উপত্যকা

স্বর্গীয়: ছায়া চরাচর জুড়ে পাহাড়ি উপত্যকা

সৌম্যদীপ পাঁজা
শেষ আপডেট: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০০:১৬
Share: Save:

নৈনিতাল আগেও গিয়েছি, তবে এ বার কাজের সূত্রেই যাওয়া। হিসেব কষে দেখলাম, হাতে আছে অতিরিক্ত দু’দিন। অপেক্ষাকৃত জনপ্রিয় টুরিস্ট স্পটগুলোর পাশে লাল ক্রস দিতে দিতে চোখ যেটায় আটকাল, তার নাম কাসার। রাস্তা জানা নেই। অগত্যা গুগলকে ভরসা করে মোটামুটি একটা অভিমুখ নির্ণয় করেই বেরিয়ে পড়া।

লোকজন, বাজার, বসতির ছায়া পেরোতে সময় লাগল আধ-এক ঘণ্টার মতো। তার পরেই চোখে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল হলুদ আর সবুজ পাইনে গাঁথা একের পর এক পাহাড়। যাচ্ছিলাম নৈনিতাল-আলমোড়ার রাস্তা ধরে। যদিও বর্ষা শেষ, তবু দু’-এক পশলা ঝরিয়ে দিয়ে যাচ্ছে মেঘগুলো। বেশ কিছু পাহাড়ের ঢাল আর রাস্তার বাঁক পেরিয়ে এক সময়ে অদূরের হিমাবৃত কুমায়ুন হিমালয়ের কোলে ধরা দিল ছবির মতো শৈলশহর আলমোড়া। সেখানকার শহুরে ছাপ এড়াতেই গাড়িচালককে নির্দেশ দিলাম আরও এগিয়ে যাওয়ার।

অবশেষে কাসার এসে পৌঁছলাম। রাস্তার দিক নির্দেশনামা দেখে বুঝলাম, বিনসর বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছি প্রায়। গাড়ি থেকে নামতেই শীতের আমেজ। পাশাপাশি সবুজ ও শান্তির সেই যথার্থ পাহাড়ি বিন্যাস! আমার থাকার বন্দোবস্ত আরও কিছুটা উপরে। সেখানে ভেজা বার্চ, দেওদার আর পাইনে ঘেরা কটেজ। আর তার লাগোয়া একফালি ঘাসজমি। যেখানে ব্লু হুইসলিং থ্রাশ, চড়ুই, শ্রাইক, মনার্ক আর কাঠঠোকরাদের অবাধ বিচরণ। চায়ের কাপ হাতে যখন সেখানে এসে দাঁড়ালাম, আধো মেঘ-চোখে সূর্য উঁকি দিচ্ছে পাইনের ফাঁক দিয়ে। সে অনুভূতি অনাবিল!

রোদ পিঠে নিয়ে মধ্যাহ্নভোজন সেরে যখন হাঁটতে বেরোলাম, আবার মেঘ জুটেছে আকাশে। দূরের নন্দাদেবী আর ত্রিশূল মুখ ঢাকছে ঝাপসা পর্দায়। সূর্যাস্ত দেখতে না পেলেও পাহাড়ে সন্ধে হওয়া দেখব বলেই ছাতা হাতে চড়াই ধরে উঠতে শুরু করলাম। বেশ কিছুটা ওঠার পরে পৌঁছে গেলাম কাসার দেবীমন্দিরে। ভক্ত সমাগম, প্রসাদের কাড়াকাড়ি নেই, পূজারিকেও চোখে পড়ল না। দীর্ঘকায় পাইনদের প্রহরায় নিস্তব্ধতায় মোড়া এই মন্দির। পাহাড়ের গা বেয়ে গুহা আর তা ঘিরেই দেবীর অবস্থান। সাইন বোর্ড থেকে যা আত্মস্থ করলুম তা হল, ভূপৃষ্ঠের যে গুটিকয়েক স্থানে ভূ-চৌম্বকত্বের শক্তির প্রভাব তুলনামূলক ভাবে বেশি অনুভূত হয়, এটি তার মধ্যে একটি। অর্থাৎ পেরুর মাচু-পিচু বা ইংল্যান্ডের স্টোনহেঞ্জের মতো এই স্থানটিও ভ্যান অ্যালেন বেল্টের অন্তর্গত। স্বামী বিবেকানন্দ এখানে এসে ধ্যানস্থ হয়ে কঠিন দিব্য সাধনা করেছিলেন। তার পরে অ্যালফ্রেড সরেনসেন, বব ডিলানের মতো আরও অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব এই গ্রামে পা দিয়েছিলেন সম্ভবত ওই একই কারণে। তবে তীব্র মাধ্যাকর্ষণ বা ভূ-চৌম্বকত্বের জন্য কি না জানি না, চোখে পড়ল প্রচুর ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা ব্যালান্সিং রক। দৃশ্যত এমন সুন্দর জায়গার অস্তিত্বের স্পর্শ পেয়ে মন তখন গভীরে সৃষ্টিকর্তার দরজায় বারবার ধন্যবাদের শব্দে কড়া নাড়ছে।

মন্দির থেকে সোজা কিছু সিঁড়ি উপরে উঠে গিয়েছে। সেখানে ভৈরব মহাদেবের মন্দির। উচ্চতার কারণেই প্রতি ধাপ সিঁড়ি ওঠার সঙ্গে সঙ্গে দূরের পার্বত্য উপত্যকার রূপ একটু একটু করে ফুটে উঠছে। মন্দিরে ঢোকার আগে ফুসফুসের দাপাদাপিকে কমাতে থামতেই হল। চোখ গেল দিগন্তপানে। নিভে যাওয়ার আগে মেঘের সব ক’টি স্তর পেরিয়ে বিকেলের শেষ আলো ধুয়ে দিতে এসেছে পিলখা দিনাপানি উপত্যকাকে। আলোর রশ্মিছটা যেন আপন তুলিতে হলুদ, কমলা আর লাল মিশিয়ে পাহাড়ি পাইন, দেওদার, ধাপ কাটা চা বাগান আর ছোট ছোট বাক্সের মতো ঘরবাড়ির দেওয়ালগুলোয় রঙিন আলো-ছায়া এঁকে গিয়েছে। কতক্ষণ যে নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম, জানি না। তাল কাটল যখন কিছু উড়ো মেঘ এসে যবনিকা টেনে দিল। ঝুপ করে সন্ধে নামল পাহাড়ে। মন্দির ঘুরে ধীর পায়ে আমিও নামতে শুরু করলাম। আশপাশের গাছ থেকে তখন রাতপাখির আড়মোড়া ভাঙার শব্দ। দূরে পাহাড়ে একটা-দুটো করে জ্বলজ্বলে তারা নেমে আসছে।

রিসর্টে ফিরে দেখি সন্ধের আলো জ্বলে উঠেও যেন ওই প্রৌঢ় গাছগুলোর গা থেকে অন্ধকার সরাতে পারছে না। গায়ে চাদর জড়িয়ে, চেয়ার টেনে সন্ধের শীত গড়িয়ে আসা বারান্দায় বসলাম। আর চায়ের প্রথম চুমুকের সঙ্গেই মিলেমিশে গেল অদ্ভুত প্রশান্তি। এ সবও আমার জন্য ছিল! পরদিন সকালে পাখি দেখার নেশায় আবার গেলাম মন্দিরের রাস্তায়। চোখে পড়ল গ্রিন টিট, নাটহ্যাচ,

ব্ল্যাক লোরড টিট, লাফিংথ্রাশ, একঝাঁক চুকার পার্ট্রিজ। নৈনিতাল ফেরার পথে রাস্তায় পড়ল ধোকনে জলপ্রপাত। কুমায়ুন পাহাড়ের কোলে, সবুজের ছায়া ধরে ধাবমান উচ্ছল জলধারা। ইট, কংক্রিট আর ধুলোর জগতে ফেরার আগে, রোমকূপে ভরে নিলাম হিমালয়ের শীতল স্পর্শ।

অন্য বিষয়গুলি:

travel tourism Aparajito
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy