সোনার পাহাড়: তিশচুলে থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা
পালমাজুয়া। ধোতরে থেকে শ্রীখোলা যাওয়ার পথে পাহাড়ের গায়ে লেগে থাকা এক টুকরো গ্রাম। কয়েক ঘর মানুষের বাস। বেশিটা জুড়েই সদ্য গজিয়ে ওঠা হোমস্টে আর লজ। যত দূর তাকানো যায়, শুধুই পাহাড়। পাশেই তিরতিরে নদী। তার উপরে একরত্তি লোহার ব্রিজ— রোদে চকচক করে। সামনে— ‘এ গাছ ও গাছ উড়ছে পাখি, বলছে পাখি...’
ডিসেম্বরের শীত মেখে বেরিয়ে পড়েছিলাম। ঠিক ছিল, একটা দিন দার্জিলিঙে কাটিয়ে তার পর পালমাজুয়া। সোনারোদ গায়ে মেখেই এনজেপিতে নেমেছিলাম। রোহিণীর পথ ধরে এগিয়ে কার্শিয়াঙের রাস্তায় বিস্তর ট্রাফিক। গাড়ি ঘুরিয়ে অন্য রাস্তা ধরতে গিয়ে মিস হয়ে গেল মার্গারেটস ডেক-এ দুপুরের খানা।
দার্জিলিঙে পৌঁছতেই ছোবল মারল ঠান্ডা। শিরদাঁড়া পর্যন্ত জমে যাওয়ার জোগাড়। বিকেলে ম্যালে হাঁটাহাঁটি আর গ্লেনারিজ়ে হট চকলেটের গ্লাস শেষ হতে না হতেই বৃষ্টি নামল। ছাতা সুটকেসে। অগত্যা ভেজা। বৃষ্টিকে পাল্লা দিচ্ছে ঠান্ডা। সর্বস্ব মুড়ে সে রাতটা কাটিয়ে পরদিন ভোরে উঠে দার্জিলিং চিড়িয়াখানা, ঘুম মনাস্ট্রি আর বাতাসিয়া লুপ দেখেই রওনা দিলাম পালমাজুয়ার পথে।
দার্জিলিঙে মেজাজ ভাল ছিল না আকাশের। এই নিদারুণ শীতে একটুখানি নীল রোদলা আকাশের জন্য মন একেবারে ছটফট। বোধহয় দয়া হল আকাশের দেবতার। ক্রমশ প্রকট হলেন সূর্যদেব।
পাইনে ঢাকা ঘন জঙ্গল। কোথাও তেরছা করে এই উঁকি দিল রোদ্দুর তো, পরমুহূর্তে মেঘ জমানো অন্ধকার আর কুয়াশা। লেপচাজগৎ ছাড়িয়ে গাড়ি ছুটল ধোতরের পথে। বাকি পথটুকু ভারী সুন্দর। আলো-আঁধারি রাস্তা। কোথাও নিমেষে পাখির মেলা, তো এই উধাও। গাড়ি দেখে একছুট্টে ঝোপে লুকোয় কালিজ ফেজ্যান্ট। বাংলায় এই পাখির নাম নাকি মথুরা। কেন কে জানে!
ধোতরে ছাড়িয়ে আরও ১৩ কিলোমিটার। সন্ধের দিকে এ রাস্তায় মাঝেসাঝেই টহল দেয় লেপার্ড। ড্রাইভার গাড়ির গতি বাড়িয়ে দেন। পাহাড়ি বাঁক ঠেলে গাড়ি পৌঁছয় পালমাজুয়া।
চারপাশ জোড়া পাহাড়। জঙ্গল আর মরসুমি ফুলে ঘেরা জাঙ্গল লজ। গ্রামের ভিতরে যেন আরও একটা গ্রাম। ছলছল করে কানে এসে ডাক দেয় পাহাড়ি একটা ঝর্না। বিকেলে দেখাও হল তার সঙ্গে। কাছেই বাঁশের মাথায় বসা হিমালয়ান ব্লু-টেলের উজ্জ্বল নীল রংটা আরও একটু আবছা হল। সন্ধে নামছে। ঘরে ফিরছে পাখি...
আগুন আরও একটু উস্কে দিল জীবন রাই। এখানে জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ একা সামলান রোগা চেহারার মানুষটি। ঠান্ডার চাদর আরও একটু জড়িয়ে ধরল শরীর। রাতে আকাশে এক থালা চাঁদ আর সারা রাত নদীর শব্দ।
পরদিন ভোরে উঠে বেরিয়ে পড়লাম তিশচুলের উদ্দেশে। তিনচুলে শুনেছি, এ আবার কোন জায়গা! গাড়ি থামল একটা পাহাড়ি সরু পথের সামনে। আশপাশে ঝোপের উপরে হালকা বরফের চাদর। পায়ে হাঁটা জঙ্গলের পথ। একটাও বসতি নেই। মাঝেমধ্যে শুধু কাঠ কুড়োতে যায় কেউ কেউ। দূরে বাঁশের ঝোপে একটা তীব্র নীলরঙা পাখি তিড়িং করে লাফিয়েই হারিয়ে গেল। ওর পিছনে এগোতেই সামনে দেখি বরফে ঢাকা সোনার পাহাড়— কাঞ্চনজঙ্ঘা। জায়গাটা কাঞ্চনজঙ্ঘা থেকে এত কাছে যে, ওটাকে কাঞ্চনজঙ্ঘা বলে মনেই হয় না। পাহাড় ঠেলে পাখি-সাম্রাজ্যে এগিয়ে গেলাম। পাখির ঝাঁকের ডানায় চকচকে রোদ পাইনের গা বেয়ে নেমে আসছে জনপদে। এ পাহাড়ে এই রোদ, তো এই মেঘ। পাখির ঝাঁক উধাও হলে আমরাও পায়ে পায়ে ফিরি।
পাখি দেখার নেশা থাকলে এ জায়গার জবাব নেই। ফেরার পথে ধোতরে থেকে ফের দেখা মিলল কাঞ্চনজঙ্ঘার। গাড়ি থামিয়ে চট করে ঘুরে দেখা হল মিরিকের পাইন আর কুয়াশাঘেরা গোপালধারা টি-এস্টেট। ব্যস, এক যাত্রায় আর কী চাই!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy