মুম্বইয়ের মধ্যে এ এক অন্য শহর যার নাম ধারাভি। ছবি: রয়টার্স।
শহরের নাম মুম্বই ঠিকই। তবু মুম্বইয়ের মধ্যে এ এক অন্য শহর। যার নাম ধারাভি। মাহিম স্টেশনের ফুটব্রিজে দাঁড়িয়ে বিদেশি পর্যটকদের বোঝাচ্ছিলেন দীপা। কলেজ পড়ুয়া। তারই ফাঁকে পর্যটকদের বিদেশি গাইডের কাজ করেন। গেটওয়ে অব মুম্বই বা জুহুর সৈকত নয়। দীপা ঘুরিয়ে দেখান তাঁর নিজের জন্মভূমি— ধারাভি। এশিয়ার বৃহত্তম বস্তি।
ফুটব্রিজের উপর থেকে নীল রঙের পলিথিনে ঢাকা হাজারে হাজারে ঝুপড়ি দেখা যাচ্ছে। তার মাঝে মাঝে ছোট ছোট পাকা বাড়ি। একতলা থেকে দোতলায় উঠতে সিঁড়ি নয়, লোহার মই ভরসা। বিদ্যুৎ, পানীয় জল মেলে। কিন্তু নিকাশি ব্যবস্থা বলে প্রায় কিছু নেই। ধারাভির অলিগলিতে আবর্জনা, দুর্গন্ধ নিত্যসঙ্গী। তবু তিন বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বেসরকারি হিসাবে ১০ লক্ষ মানুষের বাস।
উত্তরপ্রদেশ থেকে তামিলনাড়ু— সব রাজ্যের মানুষ মিলে ধারাভি এক টুকরো ভারত। চামড়া, জামাকাপড়, প্লাস্টিক, কার্ডবোর্ড, রিসাইক্লিং, পাউরুটি, মিষ্টি, বিস্কুট, পাঁপড় তৈরির এক কামরার কারখানা। যার সংখ্যা অন্তত ১২ হাজার। মুম্বইয়ের যাবতীয় ছোট দোকানের মিষ্টি, বিস্কুট না কি এই ধারাভিতেই তৈরি হয়। অন্তত আড়াই লক্ষ মানুষ কাজ করেন এইসব ক্ষুদ্র শিল্পে। দীপার কথা শুনে বিদেশি পর্যটকরা শুনে হতবাক—এই বস্তি-শহরের জিডিপি বা মোট উৎপাদিত পণ্যের মূল্য বছরে ১০০ কোটি ডলার!
রাত পোহালেই মহারাষ্ট্র বিধানসভা নির্বাচনের ভোটগ্রহণ। যেন তেন প্রকারেণ বিজেপি মহারাষ্ট্র দখলে রাখতে মরিয়া। কারণ, মহারাষ্ট্র হাতছাড়া হওয়ার অর্থ দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বই হাতছাড়া হওয়া। লোকসভা ভোটের বিজেপির আসন কমে যাওয়ার পরে মহারাষ্ট্রে হারলে জাতীয় রাজনীতিতে তার ধাক্কা লাগবে। একই কারণে রাহুল গান্ধী, শরদ পওয়ার, উদ্ধব ঠাকরেরাও মহারাষ্ট্র জিততে জান লড়িয়ে দিচ্ছেন। সেই নির্বাচনে অন্যতম প্রধান বিষয় হয়ে উঠেছে এই ধারাভি ও দেশের প্রথম সারির শিল্পপতি গৌতম আদানি।
২০২২-এর জুনে উদ্ধব ঠাকরের শিবসেনা ভেঙে তাঁর সরকার ফেলে দিয়ে একনাথ শিন্দে-দেবেন্দ্র ফডণবীসের নেতৃত্বে বিজেপি জোট মহারাষ্ট্রের ক্ষমতায় আসে। তার পাঁচ মাসের মধ্যেই গৌতম আদানির সংস্থার হাতে ধারাভি পুনরুন্নয়ন প্রকল্পের বরাত তুলে দেওয়া হয়। আদানি সংস্থা ও মহারাষ্ট্র সরকারের যৌথ উদ্যোগে তৈরি হয় ধারাভি রিডেভলপমেন্ট প্রজেক্ট লিমিটেড সংস্থা। যার ৮০ শতাংশ মালিকানা আদানিদের হাতে। বিরোধীদের অভিযোগ, ৫,০৬৯ কোটি টাকায় প্রকল্পের বরাত পেয়ে আদানি ১ লক্ষ কোটি টাকা মুনাফা করতে চলেছেন। ধারাভির বস্তি ভেঙে মুম্বইয়ের কেন্দ্রস্থলে নতুন নগরী তৈরি হবে। বাণিজ্যিক ও আবাসিক বহুতল তৈরি করে তা বেচে কোটি কোটি টাকার মুনাফা করবেন আদানি। ধারাভির আদি বাসিন্দাদের জন্য মাত্র ৩০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট বরাদ্দ হবে। তা-ও শুধু ২০০০ সালের আগের বাসিন্দাদের জন্য। তার পরে যাঁরা ধারাভিতে এসেছেন, তাঁদের ঘর মিলবে অন্যত্র। তবে সবই নতুন করে সব কিছু ঢেলে সাজানোর পরে। আপাতত ধারাভির বাসিন্দাদের সরে যেতে হবে সমুদ্রের ধারে লবণাক্ত জলা জমিতে বা দেওরানের ‘ধাপার মাঠে’। ধারাভির এখন রাত কাটে বুলডোজারের দুঃস্বপ্নে।
ধারাভির ছোট ছোট ঘর, এক কামরার কারখানা এখন লাল কালিতে দাগানো শুরু হয়েছে। একইসঙ্গে অলিগলিতে শুরু হয়েছে ‘ধারাভি বাঁচাও আন্দোলন।’ দীপার বাবা দীনেশ কুঞ্চিকোর্ভের প্রশ্ন, ‘‘ধারাভির বাইরে সরিয়ে দিলে রোজগার চলবে কী করে? খাব কী? ছেলেমেয়েদের স্কুল-কলেজ কী করে হবে?” পাউরুটির বেকারির মালিক আশরফ জানতে চান, ‘‘ওঁরা কি বুলডোজার দিয়ে ধারাভি ভেঙে দেবে? আমরা তা হলে বুলডোজ়ারের সামনে শুয়ে পড়ব।’’
কবে থেকে কাজ শুরু হবে, ধারাভির কেউই জানেন না। মাহিম রেলস্টেশন থেকে বেরিয়ে ধারাভির অলিগলি পেরিয়ে মাটুঙ্গা স্টেশনের কাছে পৌঁছলে বাসিন্দারা দেখিয়ে দেন, সেপ্টেম্বরে ভোর রাতে আরপিএফ ময়দানে ধারাভি পুনরুন্নয়ন প্রকল্পের শিলান্যাস হয়েছে। বিশাল পুলিশ পাহারায়। প্রতিবাদের ভয়ে। ‘ধারাভি বাঁচাও আন্দোলন’-এর আইনজীবী রাজু কোরডের মতে, ‘‘এটা প্রতারণা।’’
ধারাভি বিধানসভায় মহা বিকাশ আঘাড়ীর হয়ে কংগ্রেস প্রার্থী জ্যোতি গায়কোয়াড়ের বিরুদ্ধে একনাথ শিন্দের শিবসেনার রাজেশ খানডারে লড়ছেন। উদ্ধব ঘোষণা করেছেন, আঘাড়ী ক্ষমতায় ফিরলে ধারাভি প্রকল্প বাতিল হবে। জ্যোতি বলেন, ‘‘ধারাভির প্রায় ছ’শো একরের জমিতে পুনরুন্নয়নের কাজের জন্য আদানিদের আরও দেড় হাজার একর জমি দিয়েছে মহারাষ্ট্র সরকার। সমুদ্রের ধারে লবণাক্ত জলা জমিতে ধারাভির বাসিন্দাদের অস্থায়ী ভাবে সরানো হবে। সেখানে আবাসন তৈরি হলে ম্যানগ্রোভ কাটা পড়বে। ওই জমি মুম্বইকে বন্যা থেকে বাঁচাতে সাহায্য করে। দেওরানে ধারাভির মানুষকে নিয়ে যাওয়া হবে। ওখানকার বিষাক্ত গ্যাসে বাসিন্দারা এমনিতেই ফুসফুসের অসুখে ভোগেন।’’
উল্টো দিকে, বিজেপি, একনাথ শিন্দের শিবসেনার অভিযোগ, বিরোধীরা মিথ্যে প্রচার করছেন। ধারাভির কাজ শেষ হলে সেখানেই রাস্তা, নিকাশি থেকে স্কুল, হাসপাতাল, সমস্ত পরিকাঠামো তৈরি হবে। ছোট কারখানার জন্যও জায়গা থাকবে। ধারাভির পাশেই বান্দ্রা-কুর্লা কমপ্লেক্স। মুম্বইয়ের অন্যতম প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র। মাহিম স্টেশনের ফুটব্রিজে দাঁড়িয়ে দীপা সে দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে, ধারাভিতেও ওই রকম ঝাঁ চকচকে বহুতল তৈরি করার পরিকল্পনা চলছে। বিদেশি পর্যটকেরা প্রশ্ন করেন, ‘তা হলে তোমরা কোথায় থাকবে?’ দীপা উত্তর খুঁজে পান না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy