পায়ে পায়ে লিটল আন্দামানের সাগর তীরে
আশমানী নীল গাঢ় হয়ে ধরা দিয়েছে চোখের তারায়। তাকে ছুঁতে পারছি মন দিয়ে। সে-ও কেমন বশ মেনেছে পর্যটকদের যাদুটোনায়। ছুড়ে ফেলে সব শরীরী লজ্জা প্রকৃতিও নেশায় বুঁদ। প্রতিটি পর্যটকও যেন প্রকৃতিকে আপন করে নিয়েছে আলেয়ার মায়াটানে। দ্বিতীয় পর্বের ভ্রমণসূচি আয়তনে বড়। প্রথম পর্বের সঙ্গে জুড়তে হবে আরও কয়েকটি দিন। তাই সময় আর অর্থ, দু’য়েরই জোগান চাই পর্যাপ্ত। প্রথম পর্বের বিস্তারিত বিবৃতিগুলি এখানে আর দু’বার করে বলার অবকাশ নেই। তাই সোজা ঘোরার কথায় চলে আসি।
প্রথম দিন: সকালে বিমানে আন্দামানের রাজধানী পোর্ট ব্লেয়ারে নামা। বিকেলে ঐতিহাসিক জাতীয় স্মারক সেলুলার জেল দেখে নিয়ে, সন্ধেবেলায় লাইট-অ্যান্ড-সাউন্ড শো দেখা।
দ্বিতীয় দিন: সারা দিনের লঞ্চ সফরে ঘুরে ঘুরে দেখে নিন রস, ভাইপার, নর্থ-বে আইল্যান্ড।
তৃতীয় দিন: আজ জারোয়া রিজার্ভের মধ্য দিয়ে যাত্রা। বারাটাং পৌঁছে স্পিড বোটে করে দেখে আসুন লাইমস্টোন কেভ। ফিরে গাড়িতে করে মাড ভলক্যানো দেখে এগিয়ে চলা। রঙ্গতে আমকুঞ্জ বিচ দেখে, পথে মরিসডেরা দেখে মায়াবন্দরে রাত্রিবাস।
আরও পড়ুন: পোর্ট ব্লেয়ার-রস-বে আইল্যান্ড-হ্যাভলক-নীল- জলি বয়
(রাত থাকতে পোর্টব্লেয়ার থেকে বের হতে হবে। লাইমস্টোন কেভ ও মাড ভলক্যানো দেখে রঙ্গতে লাঞ্চ সেরে নিন। তার পর চলুন আমকুঞ্জ বিচে। পর্যটকের অভাবে এলোমেলো বিচ। পাথরে মৃত কোরালের অবয়ব। ঢেউ ভাঙছে পাথরের গায়ে। অর্ধচন্দ্রাকৃতি বিচ। ১২ কিমি দূরে পথের ধারে মরিসডেরা, সমুদ্র খার ভিউ পয়েন্ট। সঙ্গে বসার জায়গা। পথের ধারে খানিক বিশ্রাম। চারপাশে হাওয়ায় ভাসে শুধু সমুদ্রের গর্জন। এখান থেকে মায়াবন্দরে গিয়ে রাত্রিবাস।)
চলুন ঘুরে আসি এলিফ্যান্টায়
চতুর্থ দিন: প্রথমে চলুন নির্জন কারমাটাং বিচে। বসার জায়গা পরিপাটি করে সাজানো। তার পর ডিগলিপুরের এরিয়াল বে জে়টি থেকে বোটে করে চলুন রস এন্ড স্মিথ যমজ আইল্যান্ডে। অপূর্ব দৃশ্যপট। ফিরে আরও এগিয়ে কালিপুরে রাত্রিযাপন।
(এ কথা স্বীকার করতেই হবে, আন্দামানের এই উত্তর অংশে পর্যটক সমাগম বেশ কম। অনবদ্য কারমাটাং বিচ দেখে ডিগলিপুরে এসে দুপুরের আহার সেরে নিন। অনুমতি সাপেক্ষে এরিয়াল বে জেটি থেকে স্পিড বোট ছাড়ে। ৬-৮ জনের যাতায়াতের খরচ ২,৫০০ টাকা। গন্তব্য রস অ্যান্ড স্মিথ আইল্যান্ড। এই যমজ দ্বীপ দু’টি বালির বাঁধ দিয়ে সংযুক্ত। দু’পাশে দুই রঙের ঢেউ। স্নান করার আদর্শ পরিবেশ। ফিরে আরও খানিকটা এগিয়ে কালিপুর বিচে রাত্রিবাস। দেখে নিন আন্দামানের উচ্চতম পাহাড় সাডেল পিক। রাতে কালিপুর বিচে সামুদ্রিক অলিভ রিডলে কচ্ছপরা সুদূর পথ পাড়ি দিয়ে এই তটে ডিম পাড়তে আসে। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি অমাবস্যা বা পূর্ণিমায় এদের দেখার সম্ভাবনা বেশি। এ ছাড়া সব সময় গার্ড কাম গাইডরা ডিম পাহারা দেয়। বাচ্চা ফুটলে তা সমুদ্রে ছেড়ে দেয়, আপনিও আলাপ জমিয়ে জেনে নিন অনেক অজানা তথ্য।)
লিটল আন্দামানের একমাত্র জেটি হাট বে
পঞ্চম দিন: পায়ে পায়ে কালিপুর বিচে প্রাতঃভ্রমণ। টিফিন খেয়ে কালিপুর ছেড়ে চলে আসুন। ডিগলিপুরে লাঞ্চ সারুন এ বার স্বাদ বদল। ইকো ট্যুরিজম স্পট ধানি নালা ম্যানগ্রোভ ওয়াকে দেখে নিন কাথবার্ট বে বিচ। রাতে রঙ্গতে থাকা।
(যদি কোনও কারণে গতকাল রস এন্ড স্মিথ আইল্যান্ড না গিয়ে থাকেন, তবে আজ সকালে তা ঘুরে নিন। চুটিয়ে স্নানের মজা নিন। এ বার ধানি নালা ম্যানগ্রোভ অরণ্য। সংরক্ষণের জন্য ৭০০ মিটার লম্বা কাঠের সেতুর উপর দিয়ে পদযাত্রা। অনন্য অনুভূতি। চারপাশে চেপে আছে সবুজ ম্যানগ্রোভ, পাম, শ্বাসমূল, হাতিকান অর্কিড-সহ নানা লবণাক্ত উদ্ভিদ। সেতুর ও পারে ধানি নালা বিচ লাগোয়া কাথবার্ট বে বিচ। এই বিচেও মরসুমে কচ্ছপরা ডিম পাড়তে আসে।)
ষষ্ঠ দিন: সাত সকালে চলে আসুন রঙ্গতের জেটিতে। হ্যাভলকের জাহাজ ছাড়ে (শনিবার ব্যতীত) এখান থেকে। অগ্রিম টিকিট কাটা বাঞ্ছনীয়। ঘণ্টা চারেকে হ্যাভলক পৌঁছে দুপুর থেকে দেখুন কালাপাথর বিচ, বিজয়নগর বিচ। বিকেলে রাধানগর বিচে সূর্যাস্ত, চাইলে সমুদ্রস্নান, হ্যাভলকে থাকা।
সপ্তম দিন: হ্যাভলক থেকে এলিফ্যান্টা বিচে গিয়ে সমুদ্রস্নান করে ফেরা। দুপুরে হ্যাভলক থেকে দ্বীপযাত্রা নীলের লক্ষ্মণপুর-১ বিচে সূর্যাস্ত দেখে নীলেই রাত্রিবাস।
লিটল আন্দামানের অন্যতম আকর্ষণ কালাপাহাড় বিচ
অষ্টম দিন: সারা দিনে সীতাপুর বিচে সূর্যোদয়, ভাটার সময় লক্ষ্মণপুর-২ বিচে ন্যাচারাল কোরাল ব্রিজ-সহ জীবন্ত কোরাল দর্শন, ভরতপুর বিচে সমুদ্রস্নান। বিকালে নীল থেকে পোর্ট ব্লেয়ার ফেরা।
নবম দিন: পোর্ট ব্লেয়ারের আশপাশে সারা দিনের সাইটসিয়িং, চাথাম স’মিল, মিনি জু, মাউন্ট হেরিয়েট, সামুদ্রিকা, কারাবাইনস কোপ বিচ, অ্যান্থ্রোপলজিক্যাল মিউজিয়াম, ফিশারিজ মিউজিয়াম।
দশম দিন: রাবার প্ল্যানটেশন, স্পাইস গার্ডেন, ওন্ডুর, জলি বয়, চিড়িয়াটাপুতে সূর্যাস্ত (মুন্ডা পাহাড় বিচ)।
একাদশ দিন: কিছু দেখা বাকি থাকলে সকালে সেরে নিতে পারেন। বিকালের উড়ানে ঘরে ফেরা।
মনে রাখুন, এই ট্যুরের সঙ্গে লিটল আন্দামান যোগ হলে আরও তিন দিন-দু’রাত বেড়ে যাবে।
প্রথম দিন: পোর্ট ব্লেয়ারের ফেনিক্স বে জেটি থেকে সকালে, লিটল আন্দামানের একমাত্র জেটি হাট বে যাত্রা। বিকালের ভ্রমণ পায়ে পায়ে সাগর তীরে।
দ্বিতীয় দিন: গাড়ি ভাড়া নিয়ে সাইট সিয়িং-এ দেখে নিন— পাখি দেখতে ডুবডুবি, রামকৃষ্ণপুর ড্যাম, বিবেকানন্দপুর ড্যাম, ডালডা প্ল্যানটেশন, বাটলার বে বিচ, কালাপাহাড়, আন্দামানের একমাত্র ঝর্না হোয়াইট সার্ফ ফলস, ভাটার সময় চাট্টানে জীবন্ত কোরাল দর্শন, নিকোবরি কলোনি।
তৃতীয় দিন: কিছু বাকি থাকলে সকালে দেখে নিন। সমুদ্রস্নান সেরে নিন। দুপুরে হাট বে থেকে পোর্ট ব্লেয়ার ফেরার জাহাজ ধরা।)
জেনে রাখুন: আবহাওয়া খারাপ হলে বা সমুদ্র উত্তাল থাকলে পর্যটকদের রস অ্যান্ড স্মিথ আইল্যান্ডে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয় না। পোর্ট অফিস থেকে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। তখন আর কিছুই করার থাকে না।
লিটল আন্দামানের রামকৃষ্ণপুর ড্যাম
পোর্ট ব্লেয়ার থেকে লিটল আন্দামানের হাট বে-র দূরত্ব ১০১ কিমি।
দ্রুতগামী জাহাজে সময় লাগে ৫-৬ ঘণ্টা। পরিচয়পত্র ও বমির ট্যাবলেট নিয়ে জাহাজে উঠুন। যাত্রী ভাড়া ডিলাক্স কেবিন ২৫০ টাকা, সাধারণ কেবিন ১৩০ টাকা, বাঙ্ক ৬৫ টাকা ও ডেক ৫০ টাকা। লিটল আন্দামানে সাধারণ পর্যটক খুব কম যান, তাই হোটেল পেতে অসুবিধা হবে না। তবে জাহাজে অগ্রিম টিকিট কাটা প্রয়োজন। লিটল আন্দামানে স্কুটি, বাইক, সাইকেল ভাড়া পাওয়া যায়।
যাওয়া: প্রতি মাসে তিন অথবা চারটি ট্রিপ হয় কলকাতা/চেন্নাই আর পোর্ট ব্লেয়ারের মধ্যে। মাসে একটি জাহাজ যাতায়াত করে বিশাখাপত্তনম থেকে। এক মাস আগে উক্ত অফিস থেকে টিকিট দেওয়া শুরু হয়। শিপিং কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া লিমিটেডের বিভিন্ন স্থানের অফিসের ঠিকানা ও ফোন নম্বর:
১। মুম্বই অফিস: এপিকে হাউস, পঞ্চম তল, ডিনসা ওয়াচা রোড, মুম্বই-৪০০০২০, ফোন: ০২২-২২৮২২১০১, ২২৮২৩৩১৬।
২। চেন্নাই-অফিস: জওহর বিল্ডিং, রাজাজী সান্দাই, চেন্নাই-৬০০০০১, ফোন: ০৪৪-২৫২৩১৪০১।
৩। কলকাতা অফিস: শিপিং হাউস, ১৩ স্ট্র্যান্ড রোড, কলকাতা-৭০০০০১, ফোন: ০৩৩-২২৪৮২৩৫৪, ২২৪৮৮০১৩।
৪। পোর্টব্লেয়ার অফিস: আবেরদিন বাজার, পোর্ট-ব্লেয়ার-৭৪৪১০১, ফোন: ০৩১৯২-২৩৩৫৯০/২৩৩৯১৬।
লিটল আন্দামান যাওয়ার জাহাজ ছাড়বে ফেনিক্স বে জেটি থেকে। সকাল ৬টায় জাহাজ ছেড়ে দুপুর ১২টার দিকে পৌঁছয়, আবার সেই জাহাজেই দুপুর ১টায় হাট বে ছেড়ে সন্ধে ৭টাতে পোর্ট-ব্লেয়ার ফিরে আসে। ফেনিক্স বে জেটির অনুসন্ধানের জন্য ফোন নম্বর: ০৩১৯২-২৩২৫২৮/২৩২৭৪২।
থাকা: হোটেল আছে সারা আন্দামান জুড়ে। তাই থাকার ব্যবস্থা ঠিক একটা হয়েই যায়। রঙ্গতে থাকার জন্য রাজ্য পর্যটনের হর্নবিল নেস্ট, ফোন: ০৩১৯২-২৭৯১৫৯। সাধারণ ডবল বেড ৬০০ টাকা, বাতানুকূল ডবল বেড ১,০০০ টাকা, ডর্মিটরি শয্যা প্রতি ১৫০ টাকা। কালিপুরে থাকার জন্য টিলার উপর রাজ্য পর্যটনের টার্টেল রিসর্ট, ফোন: ০৩১৯২-২৭২২৩৩/২৭১৮১৮।
ছবি: লেখক
(লেখক পরিচিতি: পেশা শিক্ষকতা। বিষয়: অঙ্ক। অথচ নেশা বেড়ানো। বছরে ছোট-বড় বেড়ানো মিলিয়ে অন্তত বার চারেক। ভ্রমণ সংক্রান্ত লেখালেখি বছর বিশেকের। ঘুরেছেন গোটা ভারতবর্ষই। তবে পয়লা পছন্দের তালিকায় রয়েছে জঙ্গল। কলম চালানোর পাশাপাশি ক্যামেরার শাটার টিপতেও ভুল হয় না তাঁর।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy