হিমেল হাওয়ায় জড়ানো পাহাড়ি গ্রাম টাবো।
নাকো
স্পিতি নদীপাড়ের এক সুন্দর গ্রাম। কল্পা পার হতেই পাল্টে যায় প্রকৃতির চালচিত্র। কমতে শুরু করে সবুজের বাহার। উচ্চতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রুক্ষতা সঙ্গী হয়। কল্পা থেকে পাক্কা ১০৬ কিমি। রুক্ষ হাংরাং উপত্যকায় প্রবেশ করুন। আসার পথে অসাধারণ লোটসাবা মনাস্ট্রি দেখে নিন।
দেখে নিন
কিন্নরের শেষ প্রান্তে প্রায় সাড়ে ১১ হাজার ফুট উচ্চতায় এক সুন্দর গ্রাম। ঠিক যেন একটুকরো গ্রামীণ তিব্বত। চারদিকে রুক্ষ উপত্যকা। মাঝে পাইন আর ফারের অবিচ্ছেদ্য মেলবন্ধন। আর তারই মাঝে কাকচক্ষুর মতো সুন্দর নাকো লেক। উইলো গাছের ছায়ায় ঘেরা বৃত্তাকার লেকের জলে সাদা মেঘের ভেলায় ভাসা নীল আকাশের প্রতিচ্ছবি মুগ্ধ করে দেয়। এর পর পাকদণ্ডীর শেষে পৌঁছে যান নাকো গ্রামে। পাথুরে পথের ধারে পুরনো ঘরবাড়ি। মনাস্ট্রি, আপেলবাগান, কালীমন্দির দেখে নিন। নাকো গ্রামের ঠিক ওপারেই তুষারাবৃত লিয়ো পারগিল পর্বতমালার দৃশ্যাবলী মন ভুলিয়ে দেবে। নাকো থেকে বেশ কিছু ট্রেকিং রুট রয়েছে। নানান মিথ শুনতে শুনতে চলে আসুন লেকের উত্তরপ্রান্তে বৌদ্ধমন্দিরগুলিতে। এখানকার স্টকো বিগ্রহ আর মুরালগুলি অসাধারণ।
কী ভাবে যাবেন:
কল্পা, পিও থেকে খাব হয়ে স্পিতি নদীপার বরাবর ১০৬ কিমি গিয়ে সুন্দরী নাকো। সময় নেবে সাড়ে ৫ ঘণ্টা। এ পথে বাসও চলে, কিন্ত না আসাই ভাল।
উইলো গাছের ছায়ায় ঘেরা বৃত্তাকার নাকো লেক।
কোথায় থাকবেন:
নাকোয় কোনও সরকারি হোটেল নেই। এখানে থাকার জন্য বেশ কিছু বেসরকারি হোটেল রয়েছে। হোটেল কিন্নর ক্যাম্প (০৯৪১৮৪৪০৭৬৭) ভাড়া ৪৫০০-৬৫০০ টাকা। লোভান গেস্টহাউস (০৯৪৩৩৭২৫৭৭৮), ভাড়া ১২০০-১৫০০ টাকা। লেক ভিউ (০৯৪১৮৭৫৯৪৩), ভাড়া ১৩০০-১৮০০ টাকা। লেকভিউ (০৮৫৮৪৮৫২৭০২) ভাড়া ১,৭০০-১,৯০০ টাকা। সিজিন অনুযায়ী ভাড়া বাড়ে কমে।
আরও পড়ুন: যেখানে থমকে আছে সময়
টাবো
নাকো ছাড়িয়ে এ বার টাবো। অনেকেই বলে থাকেন, হিমালয়ের অজন্তা। ধূসর পাহাড়ের গায়ে বরফের আতিশয্য আর মরুপাহাড়ের অদ্ভুত সৌন্দর্যমাখা এক উপত্যকা। পাহাড়ের গায়ে আটকে থাকা গ্রামের তিব্বতিশৈলীর নানান বাক্সবাড়ি। স্পিতি নদীর তীরে মন্দির, গোম্ফা নিয়ে ১০,০০০ ফুট উচ্চতায় এই গ্রামের নাম টাবো। এক সময় তিব্বতি রাজাদের অধীনে ছিল লাহুল-স্পিতির এই বিস্তীর্ণ অঞ্চল।
৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে তিব্বতরাজ সংস্টেন নেপালের রাজকুমারীকে বিয়ে করেন। তার পর থেকেই এই এলাকায় বৌদ্ধধর্মের প্রসার ঘটে ব্যাপক ভাবে। এই সময়কালে প্রায় ৯টি গোম্ফা আর ২৩টি স্তূপের নির্মাণ হয় টাবোতে।
ট্রান্স হিমালয়ে নির্মিত তিব্বতি গুম্ফা।
ট্রান্স হিমালয়ের হিমেল হাওয়া জড়ানো গ্রামে নির্মিত গুম্ফাগুলি তিব্বতি ফেসকো-শৈলিতে ভগবান বুদ্বের নানা জীবনগাঁথার অঙ্কিত রূপের বাহার অপূর্ব। তিব্বতের থোলিং ও লাদাখের হেমিজ গুম্ফার পরেই টাবো গুম্ফা। ইউনেস্কো-র ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের তালিকায় টাবো গুম্ফার নাম উঠে এসেছে। এই গুম্ফার মাটির দেওয়ালে ভেষজ রঙে ভগবান বুদ্বের জাতক কথামালার বাহারে শুধুই বিস্ময়। সুংলাখাং গুম্ফা, কালচে ধূসর পাহাড়ের গা ঘেঁষা ধানকার মনাস্ট্রি, পো গুম্ফা উল্লেখযোগ্য।
তিব্বতিশৈলীতে নির্মিত ভগবান বুদ্ধের নানান শিষ্য এবং বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি, মুখোশ, নানা প্রাচীন লিপি সম্বলিত দুষ্প্রাপ্য পুঁথি, ধর্মীয় পোশাক সম্বলিত ঝালমা মিউজিয়ামটি দেখে নিতে ভুলবেন না। সেঞ্চ নামগিয়ালের সময়ে নির্মাণ শেরখাং গোল্ডেন টেম্পলটি অসাধারণ। যার অন্দরমহলে রয়েছে কাঠের গুম্ফা। গর্ভগৃহের বিশালাকার বুদ্ধমূর্তি দেখে নিন। সব মিলিয়ে টাবোতে আজও ছোট্ট তিব্বতকে খুঁজে পাওয়া যায়।
কী ভাবে যাবেন:
স্পিতি নদীর বাঁ দিকের গ্রামের নাম টাবো। নাকো থেকে টাবোর দূরত্ব ৬৫ কিমি।
কোথায় থাকবেন:
এখানে থাকার জন্য রয়েছে প্রাইভেট হোটেল। মৈত্রেয়ী গেস্টহাউস (১০৯০৬-২২৩৩২৯), ভাড়া ১০০০-১২০০ টাকা। হোটেল সিদ্ধার্থ (০৯৪১৮৮১৭৭৬১) ভাড়া ৯০০-১,৫০০ টাকা। টাইগার ডেন (০৯৪৩৩১২০৯৯৭) ভাড়া ১,২৫০-১,৬৫০ টাকা। মনাস্ট্রি গেস্টহাউস (১০৯০৬-২২৩৩১৫) ভাড়া ৪০০-১,১০০ টাকা।
আরও একটি তিব্বতি গুম্ফা।
কাজা
হিমাচলের স্পিতি মানেই বৃক্ষবিরল ধূসর পাহাড় আর শীতল মরুপাহাড়ের দেশ। ৩,৬৬০ মিটার উচ্চতায় স্পিতি জেলার সদর শহর কাজা। নভেম্বর থেকে জুন পর্যন্ত পুরু বরফের আস্তরণে ঢেকে থাকে এই উপত্যকা। এইসময় অগম্য হয়ে পড়ে এই পথ। কুনজুম পাসের রাস্তা বন্ধ থাকার কারণে এ পথে মানালি আসা যায় না। সুমদো উপত্যকার মধ্য দিয়ে স্পিতি উপত্যকায় প্রবেশ।
দেখে নিন:
এখানে স্পিতি ও পীরে নদীর সঙ্গমস্থল। নদী পাড়ে কিন্নর সীমানার শেষ জনপদ। এ পথের সৌন্দর্য শুধুই মুগ্ধতা। স্পিতি নদীকে সঙ্গী করে পথ চলা। রুক্ষতায় ভরপুর নানান রঙের পাহাড় আর ছোট ছোট জনপদ। হরলিং ব্রিজ পেরিয়ে পাকদণ্ডী বেয়ে পৌঁছে যান দুর্গপ্রাকারে ঘেরা গুম্ফায়, যা একসময় স্পিতি দুর্গ নামেও পরিচিত ছিল। বিচিত্ররঙা পাহাড়ের গায়ে গড়ে উঠেছে এক হাজার বছরের প্রাচীন ধানকার গুম্ফা। গুম্ফায় রয়েছে লা ওড পাইলাঘাং আর লোবসাবা লা খাং।
পিন ভ্যালি
আটরানগো থেকে স্পিতি নদী পার হয়ে বাঁ দিকের রাস্তা ধরে গেলেই, পিন ভ্যালি। বরফমুক্ত পিন উপত্যকার হলদে ঘাসে ভরে থাকে নানা রঙের পাহাড়ি ফুলের মেলা। এই পথে বেশকিছু গোম্ফা রয়েছে। এরমধ্যে গুংরি গ্লেসিয়ারের পাড়ে তান্ত্রিক বৌদ্ধদের গুংরি গুম্ফাটি অনবদ্য। পিন ভ্যালি ন্যাশনাল পার্ক রুক্ষতার মাঝে হিমাচলের বিরল প্রজাতির বন্যপ্রাণের দেখা মেলে। তবে এ পথ পুরোটাই হাঁটাপথ। এখানে আইবাক্স, স্নো লেপার্ড, ভোরাল-সহ নানান পাখি দেখার সেরা ঠিকানা। যাঁরা এ পথে আসেন তাঁরা মূলত ট্রেকার। ধূসর পাহাড়ের ঘেরাটোপে বসানো এক ছবি আঁকা শহর কাজা।
প্রকৃতি ঘেরা বিখ্যাত কি গুম্ফা।
কাজার বাইরে
১২ কিমি দূরে বিখ্যাত কি গুম্ফা। ঘন নীল আকাশের নীচে ৪,১১৬ মিটার উচ্চতায় ১৩ শতকের কি গুম্ফার অন্দরমহল অসাধারণ। সিঁড়ি বেয়ে ঢুকে পড়লেই দেখা মিলবে অপরূপ দেওয়ালচিত্র, নানান তিব্বতি দেবমূর্তি, ধর্মগ্রন্থ ‘গিলুবা’। এ ছাড়াও অপরূপ সব থাঙ্কার বাহার। গুম্ফা থেকে কি গ্রাম দেখতে পাওয়া যায়। কি গ্রাম দেখে নিয়ে ৮ কিমি দূরের কিব্বের গ্রামে চলে আসা যায়। কাজা থেকে কিব্বের গ্রামের দূরত্ব ২০ কিমি। পিঙ্গলবর্ণের রুক্ষ পাহাড়ের সমাবেশ আর তার মাঝে চরম শীতকে উপেক্ষা করে বেশ কিছু বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পরিবার পশুপালন করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করে। ঠিক যেমন ভাবে লাদাখের সো-মোরিরি লেকের পাড়ে চাংপা উপজাতিরা তীব্র শীতল আবহাওয়ার সঙ্গে চালিয়ে যান তাঁদের বাঁচার লড়াই। মাত্র কয়েক ঘর পরিবার বাস করে। বরফের চাদরে মুড়ে গেলে এরা কাজায় নেমে আসেন।
পাকদণ্ডী বেয়ে প্রায় ৪,৯৯৯ মিটার উঁচুতে আরও এক গ্রাম রয়েছে, যা বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু মোটর চলাচলকারী গ্রাম। মাত্র ৬টি পরিবার এখানে বসবাস করে। গ্রামের নাম গেটে। শীতে এই দু’টি গ্রাম বাইরের বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। হিমাঙ্কের নীচে ৪০ ডিগ্রি নেমে আসে তাপমাত্রা। প্রবল শীতে এখানে দেখা মেলে তুষার চিতাদের।
কী ভাবে যাবেন: টাবো থেকে কাজার দূরত্ব ৪৭ কিমি।
কোথায় থাকবেন: এখানে থাকার জন্য রয়েছে রাজ্য পর্যটন দফতরের হোটেল স্পিতি (০৯৪১৮০২২৭৫২), ভাড়া ১,৯০০-২,৪০০ টাকা।
বেসরকারি হোটেলের মধ্যে রয়েছে হোটেল স্পিতি সরাই (০৮৫৮৪৮৫২৭০২), ভাড়া ১,৬০০- ২,৮০০ টাকা। হোটেল ডেলেক হাউস (০৮৫৮৪৮৫২৭০৫) ভাড়া ১,৬০০-২,৮০০ টাকা। হোটেল ভেজোর (০৯৪১৮৪০২৬৬০) ভাড়া ১,০০০- ২,১০০ টাকা। হোটেল স্পিতি ভ্যালি (০৯৪১৮৯২৭৩১২), ভাড়া ১,৫০০-২,৪০০ টাকা। সিজন অনুযায়ী প্রতিটি হোটেলের ভাড়া বাড়ে কমে।
নীল আকাশের নীচে তুষারমোড়া গ্রাম।
কুনজুম গিরিবর্ত
স্পিতির শেষ, লাহুল উপত্যকার শুরু। এই দুই উপত্যকা হয়ে মানালি আসার একমাত্র গিরিপথ। ৪,৫৫১ মিটার উচ্চতায় এক হিমশীতল গিরিবর্ত। মাত্র ৪ মাস খোলা থাকে, বাকি সময় বরফে মুড়ে থাকে। নীল আকাশের নীচে নানান তুষারাবৃত শৃঙ্গরাজদের সমাবেশ। একসময় এই গিরিপথ দিয়েই মধ্য এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক যোগাযোগ রক্ষা করা হত। দু’পাশে বরফে মুড়ে থাকা বড়া শিগ্রি, ছোটা শিগ্রি গ্লেসিয়ার আর চন্দ্রভাগা শৃঙ্গ দেখতে দেখতে সঙ্কীর্ণ পথ। পেরিয়ে চলে আসুন কুনজুম মাতার মন্দিরে। এই দেবীমাতার মন্দিরে পুজো দিতে আসেন বহু মানুষ।
আরও পড়ুন: উত্তরবঙ্গের অনাঘ্রাত পর্যটনক্ষেত্র বুংকুলুং-তুরুক-সেলফু
চন্দ্রতাল
কুনজুম থেকে ৮ কিমি দূরে উৎরাই পথে ঘুরে আসতে পারেন হিমাচলের উত্তর-পূর্বে ১৪,১০০ ফুট উচ্চতার চন্দ্রতাল। নীল আকাশের নীচে স্বচ্ছ চন্দ্রতালের নীল সায়র অসাধারণ। এই চন্দ্রতাল থেকেই সৃষ্টি হয়েছে চন্দ্র নদের। আর ভাগা নদীতে মিলিত হয়ে এখানেই সৃষ্টি হয়েছে চন্দ্রভাগা নদীর। কুনজুম থেকে চলে আসুন গ্রামপো। এক অসাধারণ নিসর্গে মোড়া পাহাড়ি গ্রাম।
হিমাচলের উত্তর-পূর্বে ১৪,১০০ ফুট উচ্চতায় রয়েছে এই চন্দ্রতাল।
কুনজুম গ্রামপো থেকে শিশু গ্রাম চলে আসুন। স্পিতি উপত্যকার সবুজেমেশা শেষ গ্রামটি যেন পিকচার পোস্টকার্ড। মাঝে পড়বে ৩,১৬০ মিটার উচ্চতায় গোন্ডলা। অল্পচেনা এই গ্রামে রয়েছে সুন্দর দুর্গ। গোন্ডলা থেকে কেলং চলে আসুন। কেলং আসার পরে এক অল্পচেনা, অখ্যাত বিউটি স্পট ছত্তোর। পাহাড়ের কোলে বসান এই গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে চন্দ্রভাগা নদী। রয়েছে নানান ট্রেকিং রুট। পাহাড়ের গায়ে ছোট ছোট ফুলে ভরে থাকে উপত্যকা।
চন্দ্রতালে থাকার জন্য বেশ কিছু টেন্ট রয়েছে। বুকিং করতে হয় কাজা থেকে। তবে কুনজুম পাসে থাকার কোনও জায়গা নেই।
ছবি: শান্তনু চক্রবর্তী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy