পেশির মেদ কী ভাবে জমে, তা কতটা বিপজ্জনক? ছবি: ফ্রিপিক।
গত বছরই বিশ্বের দানবীয় বডিবিল্ডার হিসাবে পরিচিত ইলিয়া ‘গোলেম’ ইয়েফিমচিকের হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু নিয়ে বেশ হইচই হয়েছিল। ৩৬ বছরের বডিবিল্ডারের বডি মাস ইনডেক্স (বিএমআই) ছিল স্বাভাবিক, গোটা শরীরে মেদের চিহ্নমাত্র নেই। রীতিমতো ভারী ওজন তুলে শরীরচর্চা করা ও ডায়েট মেনে চলা পেশিবহুল চেহারার এক জনের হার্ট অ্যাটাক কী ভাবে হতে পারে, সে নিয়েই চর্চা হয়েছে বিস্তর। গত বছর বলিউডেরও কয়েক জন তারকার জিমে গিয়ে হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুর খবর শোনা গিয়েছিল। তাঁদেরও চেহারা ছিল সুঠাম ও পেশিবহুল। এখান থেকেই একটি বিষয় উঠে আসছে, যদি কেউ মোটা না-ও হন, তাঁর বিএমআই স্বাভাবিকই থাকে, তা হলেও হৃদ্রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। আর এর অন্যতম বড় কারণই হল পেশির মেদ।
পেট, কোমর বা ঊরুতে থলথলে চর্বি মানেই যে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি থাকবে আর ছিপছিপে চেহারার কারও থাকবে না, তা কিন্তু না-ও হতে পারে। বিএমআই অর্থাৎ, উচ্চতার সঙ্গে ওজনের পরিমাপ সে ক্ষেত্রে আসন্ন বিপদের ইঙ্গিত দিতে পারবে না। কারণ বিএমআই-তে চেহারার মেদ মাপা হলেও পেশিতে জমা মেদের কোনও হিসাবই থাকে না। আর বিপদটা ঘটে এখানেই।
এখন কথা হল পেশির মেদ আসলে কী?
‘দ্য ল্যানসেট ডায়াবিটিস অ্যান্ড এন্ডোক্রিনোলজি’ জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাপত্র অনুযায়ী, পেশিতে যে চর্বি জমে, তাকে বলা হয় ‘ইনট্রামাস্কুলার ফ্যাট’। এই চর্বির স্তর বাড়তে শুরু করলে তা হৃদ্পেশির উপর প্রভাব ফেলে। ফলে হৃদ্পেশির সঙ্কোচন ও প্রসারণ বাধা পায়, এবং হার্টে রক্ত সঞ্চালনে বিঘ্ন ঘটে যা হৃদ্রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। পেশির চর্বি কিন্তু বাইরে থেকে বোঝা সম্ভব নয়। জিমে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শরীরচর্চা করে স্টেরয়েড নিয়ে যাঁরা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে পেশি বানান, তাঁদের কিন্তু ‘ইনট্রামাস্কুলার ফ্যাট’ খুব বেশি। আর এই মেদই পরবর্তীতে হৃদ্রোগের কারণ হয়ে উঠতে পারে।
এই বিষয়ে ফিটনেস প্রশিক্ষক অনুপ আচার্য আনন্দবাজার অনলাইনকে বললেন, “তারকারা যে ভাবে পেশি বানান, কম সময়ের মধ্যে ওজন বাড়ান বা কমান, তার একটা পদ্ধতি আছে। পেশিবহুল চেহারা বানাতে গেলে দিনে কী পরিমাণ ক্যালোরি দরকার হবে তার হিসাব আছে। কতটা প্রোটিন জরুরি, কী পরিমাণ খনিজ উপাদান দরকার তার খুঁটিনাটি হিসাব মেনে চলতে হয়। কিন্তু অল্পবয়সি ছেলেমেয়েরা তা না বুঝেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা জিমে গিয়ে ওজন তুলে ব্যায়াম করে আর প্রচুর সাপ্লিমেন্ট খেয়ে পেশি বানানোর চেষ্টা করেন কম সময়েই। ফলে লিন ফ্যাট নয়, বরং পেশিতে ট্রান্স ফ্যাট জমা হতে থাকে যা বিপদ বাড়ায়।” জিমে গিয়ে শরীরচর্চা করার সময়ে হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু হয়েছে, এমন ঘটনা ইদানীংকালে অনেক ঘটেছে। এর একচা বড় কারণই হল কম সময়ে পেশি বানানোর প্রবণতা। অনুপবাবু জানাচ্ছেন, পেশি বানাতে গেলে দিনে আড়াই থেকে তিন হাজার ক্যালোরি দরকার হবে। কিন্তু বেশি সাপ্লিমেন্ট খেলে বা স্টেরয়েড ইঞ্জেকশন নিলে ক্যালোরির মাত্রা দিনে ৫ থেকে ১০ হাজার হয়ে যাবে। এতে তাড়াতাড়ি পেশিবহুল চেহারা পাওয়া যাবে ঠিকই, কিন্তু পেশিতে এত পরিমাণে চর্বি জমে যাবে যা হার্টের উপর প্রভাব ফেলবে।
হৃদ্রোগ চিকিৎসক কুণাল সরকারের কথায়, স্টেরয়েড আর সাপ্লিমেন্ট যে কতটা বিপজ্জনক তা বুঝতেই পারছে না এখনকার ছেলেমেয়েরা। এগুলিতে প্রোটিনের মাত্রা অনেকটা বেশি থাকে, যা শরীরের বিপাকপ্রক্রিয়া, হরমোনের ক্ষরণকে তছনছ করে দেয়। চিকিৎসকের বক্তব্য, “ভারতীয় মহিলাদের কম বয়সেই ‘মেটাবলিক ডায়াবেটিক সিনড্রোম’-এর লক্ষণ দেখা যায়। পেট-কোমর, নিতম্বের মেদ বাড়তে থাকে। সেই সঙ্গে পেশির মেদও নিঃশব্দে বাসা বাঁধতে থাকে। অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভাস, শরীরচর্চা না করা ও কম ঘুম এর অন্যতম কারণ।” উচ্চতার সঙ্গে ওজন মেলালে পেশির মেদের হিসেব পাওয়া যাবে না। কারণ, যাঁর উচ্চতা ৬ ফুট, তাঁর ওজন যা হবে, যাঁর উচ্চতা ৫ ফুট তাঁর ওজন আলাদা হবেই। এ বার ৫ ফুটের ব্যক্তি যদি আড়ে-বহড়ে বেজায় স্থূল হন, কোমরে স্তরে স্তরে চর্বি থাকে, তা হলে ওজন বেশি হবেই। কিন্তু যাঁর উচ্চতা বেশি, চেহারা ছিপছিপে, তাঁর ওজন কমই দেখাবে। ভুলটা হয় এখানেই।
আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সমীক্ষা আছে ‘ইনট্রামাস্কুলার ফ্যাট’ নিয়ে। গবেষকেরা ৬৫০ জন প্রাপ্তবয়স্ক স্ত্রী ও পুরুষকে নিয়ে পরীক্ষাটি করেন। সিটি স্ক্যান করে দেখা যায়, যাঁদের পেশির মেদ বেশি, তাঁদের একটি বড় অংশই ‘করোনারি মাইক্রোভাস্কুলার ডিসফাংশন (সিএমডি)’-এ আক্রান্ত। অর্থাৎ, ধমনীতে চর্বির স্তর জমে রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়া। পেশির মেদ যদি ১ শতাংশ বাড়ে, তা হলে হৃদ্রোগের ঝুঁকি ৭ শতাংশ বেড়ে যেতে পারে বলে জানিয়েছেন গবেষকেরা।
কুণালবাবুর কথায়, এখনকার ছেলেমেয়েরা সুষম খাবারের বদলে বেশি করে সাপ্লিমেন্ট নেয়, ইচ্ছামতো ওজন বাড়াতে বা কমাতে নানা রকম ডায়েট পদ্ধতি অনুকরণ করে। ফলে ‘ইনট্রামাস্কুলার ফ্যাট’ বাড়তে থাকে। পেশির মেদ থেকেই শরীরে প্রদাহজনিত সমস্যা বাড়ে। বাজালচলতি নানা রকম ওজন কমানোর ওষুধও কিন্তু এর জন্য দায়ী।
বিপদ এড়ানোর উপায় কী?
হার্টের পরীক্ষা করাতে হবে ছোট থেকেই। চিকিৎসকের পরামর্শ, জন্ম থেকে হার্টের সমস্যা থাকে অনেক শিশুর যা ধরা পড়ে না। পরে গিয়ে বিপদ বাড়ে। শিশু যখন স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে তখন এক বার, যখন নবম বা দশম শ্রেণিতে পড়ছে তখন এক বার, কলেজ যাওয়া শুরু করার পরে আরও এক বার স্বাস্থ্যপরীক্ষা করানো জরুরি। এখনকার মা-বাবারা পরীক্ষার ফল নিয়ে বেশি চিন্তিত। কিন্তু সবচেয়ে আগে চিন্তা করা উচিত স্বাস্থ্য নিয়ে। লিপিড প্রোফাইল, চেস্ট এক্স রে ও ইলেকট্রোকার্ডিয়োগ্রাম ছোটদেরও করিয়ে রাখতে হবে। তা হলেই বিপদ এড়ানো যাবে।
জিমে গিয়ে পেশি যদি বানাতেই হয়, তা হলে নিয়ম মতো ডায়েট করতেই হবে। ফিটনেস প্রশিক্ষকের পরামর্শ, একগাদা প্রোটিন খেয়ে পেশি বানানোর প্রক্রিয়া বিপজ্জনক হতে পারে। বার বার চেকআপ করানোও জরুরি। এতে প্রশিক্ষকেরা দেখে নেন, পেশিতে বেশি চর্বি জমা হয়ে যাচ্ছে কি না। সেই অনুযায়ী ব্যায়াম ও ডায়েট দেওয়া হয়। তাই অভিজ্ঞ চিকিৎসক ও ফিটনেস প্রশিক্ষকের পরামর্শ না নিয়ে কোনও কিছু করাই ঠিক নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy