Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
Travel

কল্পনা আর রূপকথার মিশেল

ছোটবেলায় আমি ছিলাম কার্টুন আর ফেয়ারি টেলস্‌-এর প্রবল ভক্ত। ভাবতাম, টিভির পর্দা কিংবা বইয়ের পাতা থেকে ওই সব চরিত্রেরা উঠে এসে যদি এক বার দর্শন দিয়ে যায়, তা হলে বুঝি জীবন সার্থক হয়ে যাবে! শৈশবের সেই কল্পনাকে বাস্তবের রং দেওয়ার একটা সুযোগ এসে গেল বড়দিনের ছুটিতে। ডিসেম্বরের মিশিগানে হাড় হিম করা ঠান্ডায় যখন আমরা কর্তা-গিন্নি কোনও গরম জায়গায় যাওয়ার প্ল্যান করছি, হঠাত্ই মাথায় এল ফ্লোরিডার কথা।

শেষ আপডেট: ২৫ মে ২০১৭ ১৬:১২
Share: Save:

ছোটবেলায় আমি ছিলাম কার্টুন আর ফেয়ারি টেলস্‌-এর প্রবল ভক্ত। ভাবতাম, টিভির পর্দা কিংবা বইয়ের পাতা থেকে ওই সব চরিত্রেরা উঠে এসে যদি এক বার দর্শন দিয়ে যায়, তা হলে বুঝি জীবন সার্থক হয়ে যাবে! শৈশবের সেই কল্পনাকে বাস্তবের রং দেওয়ার একটা সুযোগ এসে গেল বড়দিনের ছুটিতে। ডিসেম্বরের মিশিগানে হাড় হিম করা ঠান্ডায় যখন আমরা কর্তা-গিন্নি কোনও গরম জায়গায় যাওয়ার প্ল্যান করছি, হঠাত্ই মাথায় এল ফ্লোরিডার কথা।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তের এই রাজ্যটি সারা বছরই নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ার জন্য পরিচিত। ১৯৬৫-তে এই ফ্লোরিডারই অর্ল্যান্ডো শহরে প্রখ্যাত অ্যানিমেশন নির্মাতা ওয়াল্ট ডিসনি তাঁর ‘ওয়াল্ট ডিসনি ওয়ার্ল্ড’ গড়ে তোলার কথা ঘোযণা করেন। যদিও সেটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয় ১৯৭১-এ ডিসনির মৃত্যুর পর। তখন থেকেই ক্রমশ এখানে পর্যটকদের সমাগম বাড়তে থাকে। শুধু ডিসনি ওয়াল্ট-ই নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণতম বিন্দু ‘কি ওয়েস্ট’ও রয়েছে ফ্লোরিডাতে। সেই সঙ্গে রয়েছে মায়ামির মতো অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি সমুদ্রবন্দর। কাজেই আর দেরি না করে আমরা ফ্লোরিডা ভ্রমণের ছক কষে ফেললাম।

শিকাগো থেকে বিমান ধরে পৌঁছলাম অর্ল্যান্ডো। সময়টা ডিসেম্বরের মাঝামাঝি। কিন্তু, রোদ ঝলমলে অর্ল্যান্ডোতে যেন গরমের আমেজ। সারি সারি পাম গাছে সাজানো শহর। ডিসনি ওয়াল্টের কল্যাণে এই শহর এখন থিম পার্কের রাজধানী হিসেবেও পরিচিত। আমরা চার দিন থাকব এখানে। প্রত্যেক দিন একটা করে থিম দেখতে হবে! প্রথম দিনের গন্তব্য ডিসনি ম্যাজিক কিংডম।


ম্যাজিক কিংডম

ম্যাজিক কিংডমে পৌঁছে বুঝলাম, এটি আক্ষরিক অর্থে জাদু সাম্রাজ্যই বটে। সেই সাম্রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দু, সিন্ডেরেলার ক্যাসল। আমরা যখন সেই ক্যাসলের দোরগোড়ায় পৌঁছলাম, তখনই শুরু হল একটি বিশেষ শো— ড্রিমস কাম ট্রু। সত্যিই আমাদের স্বপ্ন সফল করে মঞ্চে একে একে এল রূপকথার চরিত্রেরা— সিন্ডেরেলা থেকে স্নো হোয়াইট, আলাদিন-জ্যাসমিন, এমনকী মিকি মাউস থেকে ডোনাল্ড ডাক পর্যন্ত সব। শো শেষ হল চোখ ধাঁধানো আতসবাজি দিয়ে।


মঞ্চে হাজির মিকি মাউস, মিনি মাউস, ডোনাল্ড ডাক এবং গুফি।

শোয়ের পর ক্যাসলের মুখোমুখি মেইন স্ট্রিট থেকে শুরু হল রাজকীয় এক শোভাযাত্রা। এখানেও উপস্থিত সেই সব রূপকথার চরিত্রেরা। কিছু ক্ষণ প্যারেড দেখার পর আমরা এগিয়ে গেলাম এই ম্যাজিক কিংডমেরই একটি বিশেষ অঞ্চল ‘অ্যাডভেঞ্চার ল্যান্ড’-এর দিকে। সেখানে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট— সবই সাজানো হয়েছে ‘পাইরেটস অব দ্য ক্যারিবিয়ান’-এর আদলে। সেখান থেকে বেরিয়ে হাজির হলাম ‘ফ্যান্টাসি ল্যান্ড’-এ। ম্যাজিক কিংডমের এই বিশেষ অঞ্চলটি সাজানো হয়েছে মধ্যযুগীয় ফেয়ারি টেলস্‌-এর অনুকরণে। কল্পনাকে যে এ ভাবেও বাস্তবের রঙে রাঙানো যায়, এখানে না এলে উপলব্ধি করতে পারতাম না। একে একে ‘উইনি দ্য পু’, পিটার প্যানের বাড়ি, মিকির আস্তানা, বিউটি অ্যান্ড বিস্ট-এর দুর্গ, স্নো হোয়াইটের কটেজ পেরিয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম ‘সুইস ফ্যামিলি ট্রি হাউস’-এ। গাছের মধ্যে তৈরি তিন তলা এই বাড়িটিতে বসবাসের উপযোগী সব বন্দোবস্তই আছে।

এখান থেকে বেরোনোর পর কিছু দূর অন্তর ইতস্তত জটলা দেখে কৌতূহলী আমরা এগিয়ে গেলাম। দেখলাম, ভিড়ের কেন্দ্রবিন্দু আবার সেই রূপকথার চরিত্রেরাই। কচিকাঁচারা এদের চাক্ষুষ দেখেই সন্তুষ্ট নয়, এদের সঙ্গে ছবি তুলে, করমর্দন করে, অটোগ্রাফ নিয়ে তবে খুশি। সে জন্য দীর্ঘ ক্ষণ লাইন দিতেও প্রস্তুত তারা। শুধু খুদেরাই নয়, উত্সাহ কিন্তু বড়দেরও বিন্দুমাত্র কম নেই। এ রকম কয়েকটি জমায়েত অতিক্রম করে, আমরা একে একে ‘ফ্রন্টিয়ার ল্যান্ড’-এর পাহাড়ি রেলপথকে ঘুরপাক খেয়ে, মহাকাশের ধাঁচে তৈরি ‘টুমরো ল্যান্ড’ পেরিয়ে অবশেষে হাজির হলাম ‘লিবার্টি স্কোয়্যার’-এর ‘হন্টেড ম্যানসন’-এ। এই ভৌতিক বাড়িটির আনাচেকানাচে অনবরত চলছে অশরীরীদের আনাগোনা। অত্যাধুনিক ‘স্পেশ্যাল এফেক্ট’-এর কারসাজিতে সেই ছায়াধারীর দল কখনও বা বলড্যান্স করে চলেছে, কখনও ভোজবাজির মতো উবে যাচ্ছে, আবার কখনও বা অট্টহাসিতে হৃদ্‌কম্প ধরিয়ে দিচ্ছে। এ ভাবে একের পর এক সব চমকপ্রদ শো দেখে দু’চোখে বিস্ময়ের ঘোর নিয়ে যখন আমরা হোটেলে ফিরলাম, তখন সন্ধে পেরিয়ে গিয়েছে। ইতিমধ্যে আমাদের পর দিনের গন্তব্যও ঠিক হয়ে গিয়েছে— এপকট।


এপকট

এপকট (এক্সপেরিমেন্টাল প্রোটোটাইপ কমিউনিটি অব টুমরো) অর্থাত্ ভবিষ্যত্ সমাজের এক পরীক্ষামূলক নমুনা। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির আধুনিকতম নিদর্শন এই থিম পার্কে রয়েছে অসংখ্য ছোটবড় ‘সিমুলেটেড রাইড’ বা ছদ্ম-ভ্রমণের সুযোগ। যেমন, প্রথমেই আমরা মহাকাশ অভিযানের সুযোগ পেয়ে গেলাম ‘মিশন স্পেস’-এর এক রাইডে চেপে। চার মিনিটের জন্য হলেও মনে হল গ্রহান্তরে পৌঁছে গিয়েছি।


এপকট-এর সদর দরজায়

মহাকাশযান থেকে নামার সময় আমার মাথা ভোঁ ভোঁ করলেও দেখলাম, আমার পতিদেব সায়নের উত্সাহ আরও বেড়ে গিয়েছে। আমি রাজি না হওয়ায় সে একাই কয়েকটা ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিপাক রাইড চেপে এল। অবশেষে আমিও সাহসে বুক বেঁধে সায়নের সঙ্গ নিলাম। বেশির ভাগ রাইডেই কিছু সতর্ক বার্তা টাঙানো রয়েছে। যেমন, মোশন সিকনেস আছে বা যাঁদের হৃদ্‌যন্ত্র দুর্বল, তাঁদের এই সব রাইডে না চাপাই বাঞ্ছনীয়।

সারা দিন রাইডে চাপতে চাপতে দুপুর গড়িয়ে গেল। এ বার আমরা হাজির হলাম এপকটের আর একটি অঞ্চল ‘ওয়াল্ট শোকেস’-এ। এখানে বিশ্বের ১১টি দেশ প্রতিনিধিত্ব করছে তাদের শিল্প-সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের পসরা সাজিয়ে। সেই তালিকায় ভারতের নাম নেই দেখে একটু আফশোস হল। কি আর করা যাবে! আমরা এগিয়ে গেলাম কানাডা-ভবনে। এখানে সবচেয়ে আকর্ষণীয় লাগল কানাডা বিষয়ক একটি তথ্যচিত্র, যেটা দেখানো হচ্ছে ৩৬০ ডিগ্রি ঘোরানো এক পর্দায়। একে বলে ‘সার্কল ভিশন’। কানাডার পর আমরা জাপানি প্যাগোডা, মরক্কোর মিনার ঘুরে পৌঁছে গেলাম নরওয়ের শিবিরে আর একটি মজাদার রাইড চাপতে।

একে একে বিভিন্ন দেশের প্রদর্শনী দেখতে দেখতে সন্ধে হয়ে গেল। আমরা পৌঁছলাম এপকটের আর এক আকর্ষণ ‘ক্যারেকটার স্পট’ দেখতে। এখানে রয়েছে মিকি মাউস, মিনি মাউস, ডোনাল্ড ডাক, প্লুটো-সহ অন্য কার্টুন চরিত্রদের ‘মিট অ্যান্ড গ্রিট’ করার সুযোগ। আশ মিটিয়ে, পোজ দিয়ে এদের সঙ্গে ফোটো তুললাম একে একে।

দিনের শেষ হল লেজার আর আতসবাজির যুগলবন্দি দিয়ে। এ বার হোটেলে ফেরার পালা। পরের দিনের টিকিট কাটা হয়ে গিয়েছে আগেই যাব ‘ইউনিভার্সাল’। অর্ল্যান্ডোর ‘ইউনিভার্সাল’ আসলে দু’টি থিম পার্ক নিয়ে তৈরি। একটি ‘ইউনিভার্সাল স্টুডিও’ আর দ্বিতীয়টি তার লাগোয়া ‘আইল্যান্ডস অব অ্যাডভেঞ্চার’। এপকটের রকমারি রাইডে চেপে অভিযানের রেশ তখনও কাটেনি। তাই ঠিক করলাম, প্রথমে যাব ‘আইল্যান্ডস অব অ্যাডভেঞ্চার’, তার পর ‘ইউনিভার্সাল স্টুডিও’য়।


আইল্যান্ডস অব অ্যাডভেঞ্চার


হ্যারি পটারের জাদুনগরী

সকাল সকাল আইল্যান্ডস অব অ্যাডভেঞ্চার-এ পৌঁছে আমরা প্রথমেই দেখতে গেলাম জাদুনগরী ‘দ্য উইজার্ডিং ওয়ার্ল্ড অব হ্যারি পটার’। সেই নগরীর কেন্দ্রে রয়েছে একটি দুর্গ। যার ভেতরে ঢুকলে দেখা যাবে তাক লাগানো সব ভেল্কিবাজি। কখনও দেওয়ালে টাঙানো প্রতিকৃতিরা নিজেদের মধ্যে বাক্যালাপ চালাচ্ছে। কখনও বা হাই-ডেফিনেশন থ্রি-ডি প্রজেকশনের দৌলতে হ্যারি পটার স্বয়ং হাজির হচ্ছে তার দলবল নিয়ে। বিস্ময়ের ঘোর কাটতে না কাটতে আমরা চড়ে বসলাম এক রাইডে, যার নাম ‘ফরবিডেন জার্নি’। মনে হল, যেন নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের বুক চিরে আমরাও ঝাঁটায় চেপে হ্যারির সঙ্গে কোনও এক নিষিদ্ধ পথের পথিক হয়েছি। দুর্গ থেকে বেরিয়ে রয়েছে ‘ড্রাগন চ্যালেঞ্জ’— এটি একটি ইনভার্টেড রোলার কোস্টার অর্থাত্ এটাতে চাপলে মাথা নীচে পা উপরে করে ঘুরপাক খেতে হবে। যথারীতি, সায়ন মহা উত্সাহে একাই সেটায় চাপতে গেল। আর আমি? ভিডিও তোলার অছিলায় বাইরে দাঁড়িয়ে রইলাম।

হ্যারি পটারের পর এ বার স্পাইডার ম্যান। এখানেও ‘স্পেশ্যাল এফেক্ট’-এর কল্যাণে আমাদের রক্ষা করতে স্পাইডার ম্যান স্বয়ং হাজির। আর আমরাও থ্রি-ডি চশমা পরে তার অভিযানের শরিক হলাম। আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য রাইডের তালিকায় রয়েছে ‘রিপ স্য ফল্‌স’, ‘জুরাসিক পার্ক’, ‘হাল্ক রোলার-কোস্টার’ ইত্যাদি। এদের মধ্যে বেশ কিছু আবার ওয়াটার রাইডও বটে।


ইউনিভার্সাল স্টুডিও

পরিকল্পনা মাফিক আমরা দুপুর নাগাদ চলে এলাম ইউনিভার্সাল স্টুডিওতে। এখানে রয়েছে অসংখ্য থ্রি-ডি এমনকী ফোর-ডি সিমুলেটেড রাইড। একে একে ‘রিভেঞ্জ অব দ্য মমি’, ‘সিম্পসন’, ‘টারমিনেটর টু’ দেখে আমরা হাজির হলাম ‘জ্যস’-এর সেটে। জলপথে কৃত্রিম হাঙরের উত্পাতে নাস্তানাবুদ হওয়ার পর আমরা গেলাম ‘টুইস্টার’-এর ঝড়ঝাপটার তাণ্ডব দেখতে।


ইউনিভার্সাল স্টুডিওর দোরগোড়ায়

এ ভাবে সারা দিন রাইডে চেপে, জলে ভিজে, দিনের শেষে যখন আমরা হোটেলে ফিরলাম, নিজেদেরকে মনে হচ্ছিল রণক্লান্ত সেপাই। তার উপর উপরি পাওনা সায়নের ঘাড় ব্যথা। অগত্যা বাম পালিশ করে ঘুমোতে গেলাম। যাওয়ার আগে বললাম, ‘‘এটাই হল একা একা রাইড চাপার শাস্তি।’’


ডিসনি’স হলিউড স্টুডিও

চতুর্থ দিনে আমরা গেলাম ডিসনির হলিউড স্টুডিওতে। এখানে রয়েছে অসংখ্য ছোটবড় কৃত্রিম হলিউডি সেট। আমরা দিনের শুরু করলাম ‘ভয়েজ অব দ্য লিটল মারমেড’ দিয়ে। মত্স্যকন্যা এরিয়ল আমাদের আর এক বার মুগ্ধ করল। সেই সঙ্গে লেজারের ইন্দ্রজাল আমাদেরকে দর্শকাসন থেকেই পৌঁছে দিল গভীর সমুদ্রের কোনও এক মায়া রাজ্যে! তার পর দেখতে গেলাম ‘পাইরেটস অব দ্য ক্যারিবিয়ন’ শো। দর্শন পেলাম ‘ক্যাপ্টেন জ্যাক স্প্যারো’র।


স্টান্ট শো

এ বার আমরা এগিয়ে গেলাম স্টান্ট শো দেখতে। রীতিমতো হেলিকপ্টার এনে, গোলাগুলি চালিয়ে, আগুন জ্বালিয়ে আমাদের তাক লাগিয়ে দিল নকল আর্মি। একই ভাবে আমরা কৃত্রিম ভূমিকম্প আর বন্যার কবলে পড়লাম অন্য দু’টি শো’তে।

এ রকম একের পর এক শো দেখতে দেখতে বেলা গড়িয়ে সন্ধে হল। আমরা হাজির হলাম ‘লেজার শো’ দেখতে। সেখানে আবার হাজির ম্যাজিক কিংডমের চরিত্রেরা। এই শোয়েরও মূল মন্ত্র একই— ‘ড্রিমস কামস ট্রু’। শোয়ের শেষে বিস্ময় আর মুগ্ধতা নিয়ে যখন আমরা হোটেলে ফিরলাম, দু’জনেই এক বাক্যে স্বীকার করলাম, সত্যিই ‘ড্রিমস হ্যাভ কাম ট্রু’!


কি ওয়েস্ট

অর্ল্যান্ডোতে চারটে জমজমাট দিন কাটানোর পর পঞ্চম দিন সকালে আমরা গাড়ি নিয়ে রওনা হলাম ‘কি ওয়েস্ট’-এর উদ্দেশে। অর্ল্যান্ডো থেকে কি ওয়েস্ট-এর যাত্রাপথটি কল্পনাতীত সুন্দর। অতলান্তিকের বুক চিরে চলে গিয়েছে দীর্ঘ এক সড়কপথ— দু’পাশে আদিগন্ত বিস্তৃত নীল জলরাশি। মাঝে মাঝে দেখা মিলবে ছোট ছোট দ্বীপের।

কি ওয়েস্ট যখন পৌঁছলাম, তখন সন্ধে হয়ে গিয়েছে। পর দিন সকাল সকাল আমরা বেরিয়ে পড়লাম সূর্যোদয় দেখতে। সূর্যোদয়ের পর হাজির হলাম এক মিনারের সামনে। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণতম বিন্দু। কিউবা থেকে এর দূরত্ব মাত্র ৯০ মাইল।


অতলান্তিকের উপর দিয়ে কি ওয়েস্ট যাত্রার সড়কপথ

আরও জানতে পারলাম, শুধু ভৌগলিক কারণেই নয়, ঐতিহাসিক কারণেও কি ওয়েস্ট যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। আমেরিকার ‘সিভিল ওয়ার’-এর সময় (১৮৬১-৬৫) যখন ফ্লোরিডা-সহ আমেরিকার দক্ষিণ সীমান্তের রাজ্যগুলি স্বাধীন ‘কনফে়ডারিট স্টেটস অব আমেরিকা’ গঠন করে ফেলেছে, ফ্লোরিডা রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত এই কি ওয়েস্ট তখনও রয়ে গিয়েছিল আমেরিকার উত্তর ভাগের ‘ইউনিয়ন’ দলের দখলে, এক গুরুত্বপূর্ণ নৌবন্দর হিসেবে। সেই ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে এখনও দাঁড়িয়ে আছে ‘ফোর্ট জ্যাচারি টেলর’। অতএব, আর দেরি না করে আমরা চলে গেলাম সেই দুর্গ দেখতে। বহু যুদ্ধ-বিগ্রহের সাক্ষী এই দুর্গের লাগোয়া সমুদ্র সৈকতটিকে দেখে ভাবাই যায় না যে এখানে কোনও দিন যুদ্ধ হতে পারে! শুনলাম হ্যালোইনের সময় নাকি এই দুর্গকে সাজানো হয় ‘হন্টেড ফোর্ট’ বা ভুতুড়ে দুর্গ হিসেবে। আমরা দুর্গ-মিউজিয়াম ঘুরে, সমুদ্র সৈকতে কিছু ক্ষণ কাটিয়ে বেরিয়ে পড়লাম শহর দেখতে।

ছোট্ট ছিমছাম শহর এই কি ওয়েস্ট। রংচঙে রেলগাড়ি আছে শহর পরিক্রমার জন্য। এখানকার আরও একটি আকর্ষণ ‘প্যারা সেইলিং’ অর্থাত্ প্যারাসুটে চেপে আকাশভ্রমণ। আগে আমরা গোয়াতে প্যারা সেইলিং করেছিলাম। কিন্তু, এ রকম চার দিকে নীল সমুদ্রের মাঝে ছোট ছোট দ্বীপ আকাশ থেকে দেখতে পাওয়ার অভিজ্ঞতা সত্যিই দুর্লভ।


মায়ামি

পর দিন সকাল বেলা আমরা কি ওয়েস্ট থেকে রওনা দিলাম মায়ামি— সেই অতলান্তিকের উপর দিয়ে ফেরত সড়কপথ ধরে। যখন মায়ামি পৌঁছলাম, বিকেলের আলো তখনও ফুরোয়নি। তাই হোটেলে চেক-ইন করেই চটপট হাজির হলাম সমুদ্র সৈকতে। দেখলাম ধবধবে সাদা বিস্তীর্ণ বেলাভূমির উপর আছড়ে পড়ছে সমুদ্রের ঢেউ। আর সেই সমুদ্রের তীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি অট্টালিকা— রচনা করেছে মায়ামি শহরের স্কাইলাইন।

মায়ামি বন্দর বিশ্বের বৃহত্তম প্রমোদ ভ্রমণের বন্দর বা ‘ক্রুজ পোর্ট’ বলে চিহ্নিত। শহরটি কিন্তু কি ওয়েস্টের মতো ছিমছাম নয়। বরং এটি বিলাসিতার শহর, বৈভবেরও। সেই সঙ্গে আমেরিকার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন শহরও বটে। সন্ধে নামার সঙ্গে সঙ্গে মায়ামির স্কাইলাইন সেজে উঠল আলো ঝলমলে মায়াপুরীর মতো। আর সেই মায়াপুরীতে রূপসী রাজকন্যার মতো জেগে উঠল মায়ামির ডাউন-টাউন। আমরা সেই ডাউন-টাউনে টুকটাক কেনাকাটা আর ডিনার সেরে ফিরে এলাম হোটেলে।


স্পিড বোট থেকে তোলা মায়ামি শহরের স্কাইলাইন

পর দিন সকালে আমরা চলে এলাম মায়ামির ‘সাউথ বিচ’ অঞ্চলের ‘স্টার আইল্যান্ড’-এ। এখান থেকে বুক করলাম থ্রিলার বোট রাইড। এটি আসলে স্পিড বোটে সমুদ্র ভ্রমণ। সেই সঙ্গে দেখতে পেলাম কয়েকটি দ্বীপ, যেখানে রয়েছে এলিজাবেথ টেলর, সিলভারস্টার স্ট্যালোন, ম্যাডোনা-সহ বেশ কিছু তারকার বাড়ি।

এ বার ফিরে এলাম হোটেলের কাছের সি-বিচটিতে। এসে দেখি সেখানে একটা কোরিয়ান সিনেমার শ্যুটিং চলছে। নায়িকা সমুদ্র থেকে উঠে রুপোলি বালির উপর দিয়ে হেঁটে আসছে। আমার মনে পড়ে গেল ‘দোস্তানা’ সিনেমার সেই দৃশ্য, যেখানে প্রিয়াঙ্কা চোপড়া একই ভাবে সমুদ্র স্নান সেরে উঠে এসেছিল। উত্সাহী হয়ে কিছু ক্ষণ শ্যুটিং দেখতে দাঁড়ালাম। কিন্তু, সাত-আট বার টেক নিয়েও যখন শ্যুটিং ওই একই দৃশ্যের বেশি এগোল না, তখন আমরাই এগিয়ে গেলাম অন্য দিকে।

এই দিকটায় রয়েছে সমুদ্রের তীরে বসে আরাম করার সমস্ত বন্দোবস্ত— ভাড়া পাওয়া যাচ্ছে ছাতা, আরামকেদারা, টাওয়েল ইত্যাদি। আমরাও ভাবলাম অনেক ঘোরাঘুরি তো হয়েছে, এ বার একটু আয়েশ করা যাক। ছাতার তলায় আরামকেদারায় শুয়ে সমুদ্রের শোভা উপভোগ করতে করতে বিকেল গড়িয়ে গেল।

এ বার হোটেলে ফেরার পালা। আজই আমাদের ফ্লোরিডা ভ্রমণের শেষ দিন। চোখের নিমেষে একটা সপ্তাহ কোথা থেকে কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না। তবে, এই এক সপ্তাহেই যা রসদ সংগ্রহ করেছি, তাতে নিঃসন্দেহে বার বার বলতে পারব, ‘‘ইয়েস, ড্রিমস কাম ট্রু।’’

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE