বো ব্যারাক মহল্লা
ক্লারা চাও আর সুইটি নিলের সঙ্গে দেখাটা দৈবাৎ ঘটে গিয়েছিল। হয়তো বছরশেষে কানাডা-অস্ট্রেলিয়াবাসী ভাইবেরাদরদের সঙ্গে দেখা হওয়ার আমেজেই মনটা তর্ হয়ে ছিল দু’জনের। ঘাড়ছাঁটা কাঁচাপাকা চুল, কালোকোলো দুই বুড়িমা মিলে সাদরেই সটান ভিতর-বাড়ি নিয়ে গেলেন।
লাল টুকটকে ইটের বুড়ো হওয়া বাড়িগুলোর ভিতরে সেই প্রথম পা রাখা। বৌবাজার থানার ঠিক পিছনে যে পাঁচিলঘেরা চিলতে খেলার মাঠ, তার মুখোমুখি সেই আয়ত ক্ষেত্রাকার চত্বর। গ্রীষ্মের বিকেলে এ তল্লাট এখনও হকিস্টিকের ঠোকাঠুকিতে জমজমাট হয়ে থাকে। চৌহদ্দিটা ঘিরে লাল ইটের বাড়ির দু’খানা সারি। এটাই কলকাতার বিখ্যাত বো ব্যারাক মহল্লা।
আরও পড়ুন: লেডিকেনি আজও স্বাদু, কিন্তু লেডি ক্যানিংয়ের সমাধি ঘিরে অবহেলা
ক্লারা-সুইটি দুই হাসিখুশি আন্টির সৌজন্যেই প্রথম বার ছানার কেক চেখে দেখা গেল। ক্যারামেলাইজড চিনিতে কিসমিস-মোরব্বা ঠাসা আঁটোসাঁটো ছানার আদল। নকুড়-ভীম নাগের শহরে ছানার এমন উৎকর্ষ বেঁচে আছে, জানা ছিল না তখনও। আর এক বিকেলে ঢুকে পড়েছিলাম আন্টি অ্যানার ঘরের জমাটি আড্ডা-আসরে। বেশ কয়েক জন চিনে, অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বৃদ্ধার ফুরফুরে মজলিশ তখন জমে উঠেছে। অর্ডারমাফিক ওয়াইন তৈরি করে বিক্রি করেন আন্টি। তারই হালহদিশ জানতে তাঁর ঘরে বসে সৌজন্যের স্মারক, এক গ্লাস পান করার সুযোগও ঘটেছিল। খানিক বেশি মিষ্টি গোয়ান ওয়াইন গোত্রের স্বাদ। তার অনুষঙ্গে আন্টিদের ঝাল-মিষ্টি ঠাট্টার মোচড়ও মালুম হল। তখন সামনেই বছরশেষে বো ব্যারাকের মদিরতম রাত, নাচাগানার আসর। আন্টিরা আদর করে শুনিয়েছিলেন, বৌকে নিয়ে চলে এসো, গার্লফ্রেন্ডকেও আনতে পারো!
কলকাতার এমনই সব মজাদার রং ধরে রেখেছে বো ব্যারাক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আমলে আমেরিকান সেনাদের বসবাসের জন্যই না কি এই ব্যারাকের পত্তন। ক্যালকাটা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্টের গড়া বাড়িগুলো থাকবে কি থাকবে না, একদা প্রশ্ন উঠেছিল। শেষমেশ ভাঙবার বোকামি করেননি পুর কর্তৃপক্ষ। তবে বাড়িগুলো থাকলেও এখন কোনও সংস্কারের বালাই নেই। বাসিন্দাদের থেকে কেউ ভাড়া নেয় না, সরকারি তরফে রক্ষণাবেক্ষণও তেমন হয় না। তবু বো ব্যারাক টিকে আছে কলকাতার ক্রমশ ক্ষীয়মান অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সমাজের দলিল হিসেবে। এমন কসমোপলিটন মহল্লাও কলকাতায় আর আছে কি না, সন্দেহ।
লাল ইটের বাড়িগুলোয় কম-বেশি ১৩০-১৩২টা পরিবারের বাস। এক কামরা, দু’কামরা বা তিন কামরার ছোট ছোট ফ্ল্যাট। পিছন দিকে ভাঙাচোরা সার্ভেন্ট কোয়ার্টার্সে কেআইটি-কর্মী কয়েক ঘর সাফাইকর্মীরও বাস। কলকাতার কালো সাহেব-মেমরা অনেকেই পরিবারের ডাল ভেঙে বিদেশে থিতু হয়েছেন, তবু গুষ্টি বেড়েছে বৈ কমেনি! আর শুধু অ্যাংলো ইন্ডিয়ানরাই নন, এই চিলতে মহল্লায় এখনও গায়ে গা লাগিয়ে রয়েছে এক ‘মিনি ভারতবর্ষ’!
চিলতে মহল্লায় ‘মিনি ভারতবর্ষ’
একদা বাংলার হকি মাঠের চ্যাম্পিয়ন সাসেলি সেভিয়েল, ফ্রেডেরিক রোজারিওদের দেখা মিলত এখানে। যেমন খেলাপাগল, তেমনই সুরারসিক। আবার এই তল্লাটকে এক দিন গোটা দেশ চিনত সাংসদ গীতা মুখোপাধ্যায়, সিপিআই নেতা বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায়ের ঠিকানা হিসেবে। সবার প্রিয় গীতাদিকে দেখতে এ পাড়ায় হাজির হয়েছেন রাষ্ট্রপতি জৈল সিংহ থেকে জ্যোতিবাবু। আবার এখানেই হাফপ্যান্ট পরে প্যারেডে যোগ দিতে যেতেন আরএসএস-ঘনিষ্ঠ ‘আঙ্কল লাল’!
তাঁর গোটা নামটা মনে করতে পারলেন না পাড়ার আজকের মাতব্বর প্রৌঢ় ফেলিক্স অগাস্টিন, ভাগবত জানারা। কিন্তু বিলক্ষণ মনে আছে, কই, কখনও কারও মধ্যে সিরিয়াস ঝগড়া-কথা বন্ধ তো দেখিনি! তবে আজকের বো ব্যারাকেও দিব্যি হাসিখুশি সহাবস্থান গুজরাতি নলিন শাহের মেয়েজামাই, উকিলবাবু হাসানসাহেব, গীতা মুকুজ্জের পুত্রপ্রতিম ভাগবতবাবু, বিধানসভার আধিকারিক শ্যামল দত্ত প্রমুখের।
তাঁদের সঙ্গেই বসবাস পর্করোস্ট-খ্যাত চিনে প্রবীণ রিচার্ডসাহেব বা বিফপর্কের রকমারি রান্নাপটিয়সী আন্টি জ্যানিসের। এ পাড়ার আর এক গিন্নি এঞ্জেলা গোবিন্দরাজ আবার তামিলভাষী অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। তিনিও ছানার কেক বিশারদ। রিচার্ড একদা টেরিটিবাজারের সকালে নিয়মিত পর্ক রোস্ট বিক্রি করতেন। জ্যানিসের রান্নার লোভেও অনেকে অর্ডার দিতেন। বয়স বেড়েছে বলে, তাঁরা খানিক কম রান্নাবান্না করেন ইদানীং। রেলের অফিসার সুশীল বাঁড়ুজ্জে, পঞ্জাবি বেরী বা খুরানা পরিবার, আদতে ইউপি-র লোক বসারাত হোসেনদেরও এখানেই বাড়ি।
অঞ্জন দত্তের ‘বো ব্যারাক ফরেভার’-ছবিটা দেখে কারও কারও মনে হয়েছিল, এক ধরনের উদ্দাম উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনেরই নাম বো ব্যারাক্স। এ পাড়ার বাসিন্দাদের অনেকেরই ছবিটা পছন্দ হয়নি। তবে রঙের প্রাচুর্যে সেলুলয়েডের কাহিনিকেও হার মানাতে পারে এ পাড়া। ক্রিসমাসে বুড়োবুড়িদের হাউজি-দুপুর, বয়স নির্বিশেষে সক্কলের বল নাচের সন্ধে, বছর শেষের জম্পেশ ডিনারের পার্বণ ছাড়াও বো ব্যারাককে চেনা যায় গরমের ছুটির সপ্তাহান্তের হকি প্রতিযোগিতায়। আশপাশের পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে হকি টক্করের উত্তেজনা সবার রক্তে রক্তে ছড়িয়ে পড়ত।
এক চিলতে উঠোনে জমে উঠেছে খেলা
আজকের তরুণ প্রজন্মের কলকাতা ছাড়ার হিড়িকেও এত রং মোটে ফিকে হয়নি। এ পাড়ায় মা মেরি-যিশুর মূর্তি সাজানো চোখ জুড়োন গ্রটো-য় ফি-রোববার কম ভিড় হয় না। আর বিকেলে ভিড় জমে পাড়ার মেয়েদের রান্না পর্ক বা ফিশ বল সুপ, ফিশ সুইমাইয়ের লোভে। কোনও চিনে আন্টির কাছে এ সব রান্না শিখে প্রায়ই এটা-সেটা রাঁধেন ডিওন আলেকজান্ডার। খাইয়েদের বকেঝকে পাকা হাতে ব্যবসা সামলান দাপটে। আর ইংরিজি-হিন্দি-বাংলা-চিনে-তামিলের টুকরো মেশা আড্ডায় উড়তে থাকা অতীতের সুগন্ধী ধুলো। গা ঘেঁষা রবার্ট স্ট্রিটে বৌদ্ধমন্দিরের ঘণ্টা ধ্বনি বা সান্ধ্য আজানও আকছার মিশে যায় এ সময়ে।
বাঙালি-অবাঙালি, হিন্দু-মুসলিমের ছোট ছোট খুপরি-বন্দি শহরের দিকে চেয়ে তখন মুচকি হাসে রংবেরঙের মানুষ ভরা মহল্লা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy