ইস্টবেঙ্গলকে বহু ট্রফি দেওয়া তিন ফুটবলার ও এক কোচ। (বাঁ দিক থেকে) শ্যাম থাপা, পরিমল দে, সুকুমার সমাজপতি ও অমল দত্ত। ছবি: উৎপল সরকার
পুরো স্টেডিয়াম দাঁড়িয়ে পড়েছে তাঁকে সম্মান জানাতে, মঞ্চের সামনে এগিয়ে এসে মাথা ঝোঁকালেন বাচেন্দ্রি পাল। যা মনে পড়াল তিরিশ বছর আগের একটা সাদা-কালো ছবিকে—এভারেস্টের সর্বোচ্চ শৃঙ্গে ওঠার পর তৎকালীন মধ্য তিরিশের এক ভারতীয় মহিলা শৃঙ্গ নমস্কার করছেন।
“তিরিশ বছর পরও আমার কৃতিত্বের কথা মনে রাখবে ইস্টবেঙ্গলের মতো ক্লাব। ভাবতেই পারিনি,” লাল-হলুদের সর্বোচ্চ সম্মান ‘ভারত গৌরব’ পুরস্কার নেওয়ার আগে বলছিলেন পাহাড় কন্যা। ষাট বছরেও চুলে তেমন পাক ধরেনি। সুঠাম-দীপ্ত হাঁটাচলা।
বাচেন্দ্রির একটু দূরে যিনি বসে ছিলেন—সেই ডায়মন্ড কোচ অমল দত্ত অবশ্য আশি পেরিয়েছেন বহু দিন। স্মৃতি হাতড়ানোটাই এখন তাঁর কাজ। ভুলে গেছেন অনেক কিছুই। তবুও কথার ঝাঁঝ কমেনি এতটুকু। “মোহনবাগানকেও তো আমি কোচিং করিয়েছি। অবনমন বাঁচিয়েছি। ওরা কিছু দিয়েছে? ইস্টবেঙ্গল সম্মান দিল। জ্যোতিষ (গুহ) দা’-র ক্লাবই তো আমার ক্লাব। এখানে খেলেছি। কোচিং করিয়েছি। দেবেই তো। তবে দেরিতে দিল,” জীবনকৃতির ট্রফি আর এক লাখের চেক নেওয়ার পর আবেগ আর বিতর্ক মিশিয়ে বলে দেন অমল।
‘গুরু’ অমলের সঙ্গে জীবনকৃতি সম্মান নিতে এসেছিলেন পরিমল দে-ও। সত্তরে ইরানের পাজ ক্লাবের বিরুদ্ধে শেষ মূহূর্তে নেমে তাঁর করা গোলের স্মৃতি ধারাবিবরণীর মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তুলছিলেন ঘোষক। লাল-গেঞ্জি পরা ফর্সা টুকটুকে জংলা দা (পরিমলকে ময়দান এই নামেই চেনে) হাত নাড়ছেন। সে দিনের গোলের পরের মূহূর্তের মতোই। গোটা ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্র হাততালিতে ফেটে পড়ছে।
এ সবের মাঝে পড়ে এ বারের অধিনায়ক হরমনজিৎ খাবরার হাত থেকে বর্ষসেরা ফুটবলারের পুরস্কার নিতে এসে অর্ণব মণ্ডল যেন কিছুটা জড়সড়। দর্শকাসনে বসা র্যান্টি মার্টিন্স সতীর্থদের প্রশ্ন করছিলেন, “অর্ণব কে তো চিনি। বাকিরা কে? ওরা কি আমাদের ক্লাবে খেলত?” আর্মান্দো কোলাসো ছাড়া এ বছরের টিমের সব ফুটবলারই হাজির ছিলেন অনুষ্ঠানে। র্যান্টির সঙ্গেই।
এ রকম অসংখ্য মূহূর্তের কোলাজ আর বক্তৃতায় শুক্রবার সন্ধ্যায় জমে গেল ইস্টবেঙ্গলের পঁচানব্বইতম জন্মদিন। মঞ্চের পিছনে বিশাল ফ্লেক্সের ভাবনাতে ছিল নতুনত্ব। সেখানে মাঠের উপর ইস্টবেঙ্গলের পরিকাঠামো উন্নয়নের ছবি— ট্রফি রুম, জাকুজি, গ্যালারিতে ওঠার লিফট, আধুনিক জিমন্যাসিয়াম। আর মঞ্চের সামনে থোকা থোকা গোলাপে শুধুই লাল-হলুদ।
সামান্য অগোছালো হলেও ভারত গৌরব-জীবনকৃতির পাশাপাশি সম্মানিত করা হল চার ঘরোয়া ট্রফি জয়ী ক্রিকেটারদেরও। রেফারি, ক্রীড়া সাংবাদিক, চিত্র সাংবাদিকদের নানা সম্মান জানানো হল। নইম থেকে শ্যাম থাপা, সুকুমার সমাজপতি থেকে সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়অনেক প্রাক্তন ফুটবলার ও ক্রিকেটার ছিলেন দর্শকাসনে। ছিলেন রাজ্যের দুই মন্ত্রীমদন মিত্র এবং গৌতম দেব।
লাল-হলুদের উজ্জ্বল আলোর নিচে হঠাৎ-ই চলে আসেন ছন্দা গায়েন। কয়েক মাস আগেই পাহাড়ে হারিয়ে যাওয়া বঙ্গকন্যা। প্রথম অসামরিক এভারেস্টজয়ী বাচেন্দ্রির জন্যই। “মেয়েটা পরিকল্পনা করে এ বার পাহাড়ে যায়নি। গেলে এভাবে চলে যেত না। আমি চাইছিলাম আট হাজার মিটারের ১৪টা শৃঙ্গ জয় করুক ছন্দা। কোনও মেয়ে যা আজ পর্যন্ত পারেনি। ওর প্রতিভা ছিল। পারত,” বলছিলেন বর্তমানে টাটা অ্যাডভেঞ্চার ফাউন্ডেশনের প্রধান বাচেন্দ্রি। সময়াভাবে ছন্দার হাওড়ার বাড়িতে যেতে পারেননি জামশেদপুর থেকে আসা বাচেন্দ্রি। বলছিলেন, “ওদের বাড়িতে গিয়ে পরিবারকে সান্ত্বনা দিয়ে আসতে পারলে ভাল লাগত।” আর এর মধ্যেই ক্রীড়ামন্ত্রী মদনবাবু বলে গেলেন, “প্রয়াত ছন্দার নামে পুরস্কার চালু করতে চলেছে রাজ্য সরকার। ক্রীড়ারত্নের মতোই। দেওয়া হবে পর্বতারোহীদের।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy