দুরন্ত জয় তুলে গেইলের গ্যাংনাম। ছবি: রয়টার্স
ম্যাচের শেষ ওভারে জেমস ফকনার জোড়া ছক্কা হজম করে অস্ট্রেলিয়াকে হারালেন? না কি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের এই গুরুত্বপূর্ণ একইসঙ্গে মর্যাদার যুদ্ধের আগের দিনই ওয়েস্ট ইন্ডিজ জেতার রসদ পেয়ে গিয়েছিল অজি পেসারের থেকে?
ফকনার যে ভাবে প্রাক-ম্যাচ সাংবাদিক সম্মেলনে “আমি ঠিক ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটটাকে পছন্দ করি না” মন্তব্য করে ডারেন স্যামির দলকে খেপিয়ে তুলেছিলেন, তাতে চব্বিশ ঘণ্টা পরে বাইশ গজে জিতে উঠে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ক্রিকেটাররা যে ‘পাগল-সেলিব্রেশন’ করবেন তাতে আর সন্দেহ কী? অস্ট্রেলিয়ার ১৭৮-৮ তাড়া করতে নেমে শেষ তিন ওভারে ওয়েস্ট ইন্ডিজের জেতার জন্য দরকার ছিল ৪২ রান। শেষ ছ’বলে ১২ রান। শেন ওয়াটসনের মতো পোড়খাওয়া টি-টোয়েন্টি তারকার দু’ওভার বাকি থাকলেও (যে দু’ওভার এ দিন করেছিলেন এই পেসার-অলরাউন্ডার, তার একটি আবার মেডেন ছিল!) আত্মবিশ্বাসী অস্ট্রেলীয় অধিনায়ক জর্জ বেইলি শেষ ওভারটা দিয়ে বসেন কিনা ফকনারকেই! সামনে পড়বি তো পড়, ক্যারিবিয়ান ক্যাপ্টেন স্যামি-ই! যিনি গতকালই বলেছিলেন, “কথা-টথা হল গিয়ে ফালতু ব্যাপার। আসল হল, মাঠে কারা কতটা বেশি কাজ করতে পারল! সেটাই ম্যাচ জেতায়।”
এবং ফকনারের শেষ ওভারে সত্যিই ‘কাজ’ করে দেখালেন স্যামি। প্রথম দু’টো বল ‘ডট’ যাওয়ার পর যখন হলুদ জার্সির ডাগআউটে আশা আর মেরুন জার্সির ডাগআউটে আশঙ্কা বাড়ছে, তখনই পরের দু’টো বল সটান উড়ে মাঠের বাইরে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ (১৭৯-৪) দু’বল বাকি থাকতে ছ’উইকেটে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে টুর্নামেন্ট থেকে তাদের কার্যত ছুটি করে দেওয়ার পাশাপাশি নিজেদের সেমিফাইনাল ওঠার আশা জিইয়ে রাখল।
আর তার পরেই মিরপুরের মাঠে অভাবনীয় সব ‘ক্যারিবিয়ান সেলিব্রেশন’! কেউ টিম জার্সিতে, কেউ থ্রি-কোয়ার্টার ট্রাউজারে, কেউ বা আবার বারমুডা পরে গোটা ওয়েস্ট ইন্ডিজ স্কোয়াড মাঠের ভেতর পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে ঢুকে পড়ে। দুই অপরাজিত ডারেন স্যামি (১৩ বলে ৩৪ নঃআঃ) আর ব্র্যাভোকে (১২ বলে ২৭ নঃআঃ) কোলে তুলে নিতে। স্যামি-ব্র্যাভো ততক্ষণে নিজেদের ব্যাট আকাশে ছুড়ে দিয়েছেন! যেগুলো তখনও ক্রিজের আশপাশে থাকা অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটারদের মাথায় এসে পড়ে রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটালেও অবাকের ছিল না। ব্র্যাভো আবার গ্যালারির যে অংশে বেশি অস্ট্রেলীয় সমর্থকদের ভিড় ছিল, সেখানকার বাউন্ডারি লাইনের কাছে দৌড়ে গিয়ে নিজের গ্লাভস জোড়া ছুড়ে মারেন দর্শকদের উদ্দেশ্য করে।
মাঠে রক্তারক্তি না ঘটুক, সাংবাদিক সম্মেলনে যেন গরমাগরম কথার রক্তারক্তি ঘটল এক দফা। ফকনারের ‘ফালতু’ কথার সমুচিত জবাব ম্যাচে দিতে পেরে উৎফুল্ল, একইসঙ্গে উত্তেজিত ওয়েস্ট ইন্ডিজ অধিনায়ক বলে দিলেন, “আরে, ক্রিকেটটা হল বড়সড় এক অ্যাকশন। তুমি মুখে যা খুশি বলতেই পারো! কে তোমাকে আটকাবে? কিন্তু আসল ব্যাপার হল, মাঠে নেমে অ্যাকশন করা। মুখে নয়, কাজে। এবং সেটাই দিনের শেষে গণ্য হয়। ওয়েস্ট ইন্ডিজ আজ সেই অ্যাকশনটাই করেছে। অন্য দলটার মতো কেবল মুখেই নয়, কাজে! জেমস ফকনার হল এই গ্রহের একমাত্র ক্রিকেটার, যে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে পছন্দ করে না। আজকের পর থেকে ও নিশ্চয়ই আরও বেশি করে অপছন্দ করবে আমাদের।”
ব্র্যাভোর অবিশ্বাস্য ক্যাচে আউট ফকনার।
মিরপুরে ক্যালিপসো।
আসলে ফকনারের সঙ্গে এই ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের কোনও ক্রিকেটারের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নেই। বিশেষ করে ক্রিস গেইলের সঙ্গে। এ দিন ওয়েস্ট ইন্ডিজ ইনিংসের প্রথম ওভার ওয়াটসন মেডেন করার পর গেইল-ই প্রথম পাল্টা আক্রমণ শুরু করেছিলেন। মিচেল স্টার্কের দ্বিতীয় ওভারেই ১৬ রান নিয়ে। শেষ পর্যন্ত ৩৫ বলে ৫৩ করে গেইল-ই ক্যারিবিয়ান জয়ের ভিত গড়ে দেন। জয়ের পর অধিনায়ক স্যামি যখন দলের ডাগআউট থেকে ছুটে আসা বাদবাকি ক্রিকেটারের বুকে ধরা দিচ্ছেন, প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মাঠের সাউন্ড সিস্টেমে ‘ডিজে’ গ্যাংনাম-গান চালিয়ে দিয়েছিল। এক সেকেন্ড দেরি না করে গেইল মাঠের মধ্যেই গ্যাংনাম নাচতে শুরু করে দেন। তাঁর উত্তেজক শরীরী ভাষা স্পষ্টতই ছিল হতোদ্যম অস্ট্রেলিয়া দলের দিকেই তাক করা।
কিন্তু বিশ্বকাপে আজকের দিনটা যে গ্যাংনামেরই দিন! একটা নিছক গ্রুপ ম্যাচ জিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের জয়োৎসবকে বিশ্বকাপ জিতে ফেলার সমান দেখালেও স্যামিই বোধহয় সঠিক কথাটা বলেছেন। “আমরা আজ বিশ্বকাপ জিতিনি ঠিকই। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে এই জয়টা আমাদের কাপ জেতার ব্যাপারে রাীতিমতো তাতিয়ে দিয়েছে। আর শেষ ওভারে ফকনারকে পিটিয়ে আমাদের জেতাটা যেন সুস্বাদু কেকের উপর একটা টুকটুকে লাল চেরি!”
আরও একটা কথা বলে গিয়েছেন ক্যারিবিয়ান অধিনায়ক। “ঘুমন্ত সিংহকে জাগিয়ে দেওয়ার ভুল করাটা ঠিক নয়।”
বাকিরা শুনছে তো?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy