ময়দানে ভলিবল মাঠটা ঠিক কোথায়?
সাধারণ ক্রীড়াপ্রেমী কোন ছার, নিয়মিত ময়দানে আসা লোকজনের অনেকেই সেটা বলতে পারবেন না।
ভলিবলে বাংলা দলের কোনও খেলোয়াড়ের নাম জানেন? সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর ‘দাদাগিরি’-র কুইজে এই প্রশ্নটি করলে চোখ বুজে বলে দেওয়া যায় একজনও এর উত্তর দিতে পারবেন না।
আইএসএল, আইপিএল, দীপা কর্মকার, পিভি সিন্ধু, সাক্ষী মালিকদের রমরমার বাজারে রাজ্য বা দেশের ভলিবল মিডিয়াতে একেবারেই অন্ত্যজ। দুয়োরানি। এক লাইনও লেখা হয় না চ্যাম্পিয়ন টিমের নাম। রিও-তে রুপো জয়ী সিন্ধুর বাবা পুসালারা ভেঙ্কটেস রামান্নাই তো অর্জুন পুরস্কার প্রাপ্ত ভলিবলার। এশিয়ান গেমস খেলেছেন দেশের জার্সিতে। হায়দরাবাদের মেয়ে অলিম্পিক্সে পদক না জিতলে তাঁর বাবার কথা কেউ জানত?
অথচ এই ভলিবলকে কেন্দ্র করে বাংলার বিভিন্ন জেলার গ্রামগুলো এখন উত্তাল। উড়ছে কোটি টাকা। পাড়ার ক্লাব বনাম পাশের পাড়ার ক্লাবের ভলিবল টিমের লড়াই দেখতে বৃহস্পতিবার রাতেও পূর্ব মেদিনীপুরের রামনগরের মাঠে উপচে পড়ছে ভিড়। মহরম উপলক্ষ্য সেখানে হচ্ছে টুনার্মেন্ট। চলবে রাত একটা পর্যন্ত। উদ্যোক্তারা জানাচ্ছেন, রাত যত বাড়বে ভিড় বাড়বে ততই। শুধু বাংলার ছেলে-মেয়েরাই নন, লাখ লাখ টাকা খরচ করে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভারতীয় দলের খেলোয়াড়রা আসছেন পঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ থেকেও। তাঁদের জন্য বিমানের টিকিট থেকে থাকা-খাওয়ার খরচ সব দিয়ে খেলতে নিয়ে আসছেন বিভিন্ন ক্লাবের কর্তারা।
আর এই ‘খেপ’ খেলার জেরে রাজ্য সংস্থার ভলিবল লিগ-ই লাটে ওঠার জোগাড়। খেলোয়াড়রা কেউই সেই লিগ খেলতে আগ্রহী নন এখন। না খেললে নথিভুক্তি বাতিল হয়ে যাবে এই ভয়ে ক্লাবগুলো ধরেবেঁধে টিম নামালেও, খেলার পরই বিভিন্ন ক্লাবের গাড়িতে উঠে বসছেন সন্দীপ মুখোপাধ্যায়, সুবীর দে, রাজকুমার শীলরা। চলে যাচ্ছেন জেলার বিভিন্ন মাঠে। রাতের টুর্নামেন্ট খেলতে। বড়িশা সবুজ সংঘের নামী খেলোয়াড় সন্দীপ বলছিলেন, ‘‘কেন মন দিয়ে খেলব রাজ্য সংস্থার লিগ? ক’ টাকা পাব। চ্যাম্পিয়ন হলে একটা ক্লাব পাবে সাত হাজার টাকা প্রাইজ মানি। আর জেলার এক-একটা টুনার্মেন্টে তিন-চারটে ম্যাচ খেলে চ্যাম্পিয়ন হলে দু’তিন লাখ টাকা চলে আসে। এক একজনের পকেটে আট-দশ হাজার টাকা চলে আসে। সবাই তাই ওই দিকেই ঝুঁকছে।’’
ঠিক কত ‘খেপ’ টুনার্মেন্ট হয় বাংলায়? খোঁজ নিয়ে জানা গেল দুই মেদিনীপুর, শিলিগুড়ি, বর্ধমান, উত্তর ২৪ পরগনা মিলিয়ে প্রায় আড়াইশোর মতো টুনার্মেন্ট হয়। প্রত্যন্ত গ্রামের ভিতর মাঠে জাল টাঙিয়ে, বাঁশ দিয়ে চারদিকে ব্যারিকেড তৈরি করে হয় রাতের টুনার্মেন্ট। আট-দশ হাজার দর্শক খেলা দেখেন। অক্টোবর থেকে এপ্রিল এটাই ভরা সিজন খেপের। মহরম, রাসের মেলা, কার্তিক মেলা ছাড়াও প্রায় প্রতি শনি, রবিবার হয় ম্যাচ। ক্লাবগুলোর কর্তারা টিম তৈরি করতে যোগাযোগ করেন বাংলার বিভিন্ন খেলোয়াড়ের সঙ্গে। তাঁরাই টিম তৈরি করেন। ট্রফি পেতে মরিয়া ক্লাবগুলোর পিছনে দাঁড়িয়ে যান স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। নিজেদের প্রতিপত্তি বাড়াতে লাখ লাখ টাকা খরচ করেন। সেখানে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের মতো রেষারেষি। গত বছরই মেদিনীপুরের জাবদা, তাজপুর, ইচ্ছাবনী, হেড়িয়ে মোহাটির মতো গ্রামে অন্তত দশটা টুনার্মেন্ট খেলে গিয়েছেন ভারতীয় দলের পাঁচ খেলোয়াড় মনদীপ সিংহ, নভজিৎ সিংহ, সুরজিৎ বিকাশ, লাকভিত কাটোরিয়া, দিলীপ খৈবাল। এঁদের এক-একজনের পিছনে খরচ হয় সব মিলিয়ে চল্লিশ হাজার টাকার মতো। রাজ্য লিগে হাওড়া ইউনিয়ন টিমের হয়ে খেলেন সুবীর দে। বলছিলেন, ‘‘ক্লাবের হয়ে লিগে খেলে দশ-বারো হাজার টাকা পাই। জেলার টুর্নামেন্ট খেললে লাখ দুয়েক টাকা অনেকেরই আয় হয়। এমনিতে ভলিবলে চাকরি প্রায় নেই-ই। রেল বা কিছু সরকারি সংস্থায় দু’একজন নেয়। খেপ না খেললে চলবে কী করে?’’
খেপের জেরে রাজ্য ভলিবল লিগের দফারফা হচ্ছে মানছেন সচিব পল্টু রায় চৌধুরী। বলছিলেন, ‘‘টাকার জন্য ওরা খেপ খেলতে যাচ্ছে। কী করা যাবে? আমরা আমাদের ক্ষমতা অনুযায়ী লিগে প্রাইজ মানি চালু করেছি। ওখানে খেললে অনেক বেশি পায়। তাই কিছু বলি না।’’ ফুটবলে খেপ খেললে শাস্তি দেওয়ার নিয়ম আছে খেলোয়াড়দের। আইএফএ-তে এসে সই করার সময় মুচলেকা দিতে হয় ফুটবলারদের। তাই নামী খেলোয়াড়রা নাম ভাঁড়িয়ে খেলেন টুনার্মেন্ট। ভলিবলে কি সে রকম নিয়ম নেই? পল্টুবাবু হতাশ গলায় বললেন, ‘‘নিয়ম আছে। প্রমাণ করা অনেক ঝামেলার। আর ওরা গরিব ঘরের ছেলে, তাই কিছু বলি না। জেনেও এড়িয়ে যাই। বেশি কড়াকড়ি করলে ওরা লিগ না খেলে খেপই খেলবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy