আগ্রাসী: বৃহস্পতিবার সকালে রাঁচীর নেটে চেনা মেজাজেই দেখা গেল মহেন্দ্র সিংহ ধোনিকে। পিটিআই
মহেন্দ্র সিংহ ধোনিকে ভারতের নীল জার্সিতে ভারতের মাটিতে কি শেষ বার দেখা যাবে আজ, শুক্রবার? এর পর কি আর কখনও তাঁকে সেই বিখ্যাত ৭ নম্বর নীল জার্সি পরে নামতে দেখা যাবে না নিজের দেশের কোনও মাঠে?
কোটি কোটি ধোনি-ভক্তের মন খারাপ করে দেওয়া এমন একটা সম্ভাবনা ক্রমশ জোরাল হতে শুরু করেছে। রাঁচীতে তৃতীয় ওয়ান ডে ম্যাচের পরে সিরিজে রয়েছে আরও দু’টি ম্যাচ। সেই দুই ম্যাচ হবে মোহালি এবং দিল্লিতে। কিন্তু বিশ্বস্ত সূত্রে ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছে যে, শেষ দুই ম্যাচে না-ও খেলতে পারেন ধোনি। যার অর্থ, রাঁচীতে ঘরের মাঠে খেলার পরে তাঁকে আবার দেখা যাবে আইপিএলে।
বিশ্বের সব চেয়ে ধনী ক্রিকেট লিগ হলেও আইপিএল কোনও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা নয়। সেখানে দেশের হয়েও খেলার ব্যাপার নেই। কুড়ি ওভারের ক্লাব বনাম ক্লাব দ্বৈরথে ধোনিকে দেখা যাবে চেন্নাই সুপার কিংসের হলুদ জার্সিতে। যারা দু’বছর নির্বাসিত থাকার পরে ফিরেই গত বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে।
আইপিএলের পরে বিরাট কোহালির দলের এক নম্বর উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান হিসেবে ইংল্যান্ডে বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়া নিশ্চিত ধোনির। টেস্ট থেকে অনেক আগেই অবসর নিয়ে ফেলেছিলেন। ধরে নেওয়া হচ্ছে, বিশ্বকাপের পরে সমস্ত রকম আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকেই বিদায় জানাবেন কপিল দেবের পরে বিশ্বকাপ জেতা একমাত্র ভারত অধিনায়ক। রাঁচীর পরে বাকি দু’টি ম্যাচে বিশ্রাম নিলে তাই তাঁর জন্য টিম ইন্ডিয়ার নীল জার্সি পরে দেশের মাঠে তাঁকে শেষ বার দেখা যাবে শুক্রবারের ম্যাচেই।
এমনও শোনা যাচ্ছে যে, ধোনি নিজেই না কি জাতীয় নির্বাচকদের কাছে ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন, দেশের মাটিতে ভারতের জার্সি গায়ে শেষ এক দিনের ম্যাচ খেলতে চান নিজের শহরে। তাই শেষ দুই ম্যাচে বিশ্রাম দেওয়ার অনুরোধও জানিয়েছেন। তাঁর সেই ইচ্ছাকে গুরুত্ব দিয়ে শেষ দুই ম্যাচে তাঁকে বিশ্রাম দেওয়ার কথাই ভাবা হচ্ছে।
এমনিতেই রাঁচীতে খেলা মানে আবেগের কেন্দ্রস্থলে থাকা চরিত্রের নাম মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। খোলা ময়দানে টেনিস বলে খেলতে খেলতে তাঁর আন্তর্জাতিক ক্রীড়াজগতে উত্থান অবিশ্বাস্য এক কাহিনি। এর সঙ্গে ধোনির মাটিতে পা রেখে চলা, সদা মেজাজকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারা এবং কখনও ক্রিকেটের স্পিরিটের বাইরে না যাওয়ার ইতিহাস তাঁকে মহানায়কের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে।
উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে কমার্স নিয়ে পড়তেন ধোনি। তাঁর শিক্ষিকা বলছিলেন, ‘‘টিভির সামনে বসে ছাত্রকে দেখে গর্ব হয়। ওর ক্রিকেটের জন্য নয়, কত সুশোভন এক ছাত্র আমাদের স্কুল থেকে বেরিয়েছে সেটা দেখে।’’ আবেগতাড়িত হয়ে এর পরে তিনি যোগ করেন, ‘‘এত বড় হয়ে যাওয়ার পরেও মাহি ওর পুরনো লোকদের ভোলেনি। বন্ধুদের ভোলেনি, আমাদের ভোলেনি। বিশ্বকাপ জেতার পরে নিজে এসে দেখা করে গিয়েছিল।’’
যেখানে এমনিতেই তাঁকে নিয়ে কথা বলতে গিয়ে লোকের গলা ধরে আসছে, সেখানে শেষ ম্যাচ! আবেগ বাঁধনহারা হয়ে পড়তে শুরু করেছে। কোহালির দলের মধ্যেও উথালপাতাল শুরু হয়েছে। বুধবার ধোনি রিং রোডে তৈরি করা তাঁর নতুন, বিশাল ফার্ম হাউসে নিমন্ত্রণ করেছিলেন গোটা দলকে। সেখানেও অনেকে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। উৎসবের মধ্যেই বেদনার সুর বেজে উঠছিল যে, পরের বার যখন ভারতীয় দল রাঁচীতে খেলতে আসবে, মাথার উপরে মহীরূহের মতো দাঁড়িয়ে থাকা মাহি আর থাকবেন না।
সত্যিই বর্তমান দলের প্রত্যেক সদস্যের জন্য মহীরূহ হয়ে ছিলেন মাহি! অধিনায়ক স্বয়ং মাহি মোহে আচ্ছন্ন। ধোনির চারশো ওয়ান ডে ম্যাচ উপলক্ষে পুরো দলকে ডেকে জড়ো করে কোহালি বলেছিলেন, ‘‘আমি নামেই অধিনায়ক। আমাদের সকলের হৃদয়ে তুমিই অধিনায়ক ছিলে, তুমিই অধিনায়ক থাকবে, মাহি।’’ ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে অধিনায়ক এবং সহ-অধিনায়ক এমন সৌহার্দের সম্পর্ক কখনও দেখা যায়নি। বরং অতীত ঘাঁটলে নেতা এবং সহ নেতার মধ্যে তিক্ততার বর্ণনাই বেশি পাওয়া যাবে।
বুধবার রাতে ধোনির বাড়ির নৈশভোজ নিয়ে কোহালি লিখেছেন, ‘‘ধোনিকে ধন্যবাদ, দুর্দান্ত একটা দলগত সন্ধে উপহার দেওয়ার জন্য।’’ সব চেয়ে আলোচিত হচ্ছে ঋষভ পন্থের টুইট। যাঁকে ধোনির উত্তরসূরি মনে করা হচ্ছে, তিনি লিখেছেন, ‘‘ভাবীজি আমাদের ফিটনেসের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে।’’
এ দিন মাঠে ভারতের অনুশীলনের সময় আরও গভীর মুহূর্ত তৈরি হতে দেখা গেল। নেটে ব্যাট করার পরে ছক্কা মারার বিশেষ অনুশীলন করছিলেন ধোনি। বোঝাই যাচ্ছিল, ঘরের মাঠে বিদায়ী ম্যাচ স্মরণীয় করে যেতে চান। ছুড়ে দেওয়া বল প্রায় প্রত্যেকটাই উড়ে গিয়ে পড়ছিল গ্যালারিতে। নিজে ছক্কার অনুশীলন করার পরে সেখানে ঋষভ পন্থ, অম্বাতি রায়ডুদের ডেকে আনলেন ধোনি। তার পরে তাঁদের শিক্ষকের ভূমিকা নিলেন। যাঁর ছক্কার দাপটে ভারত জিতেছে বহু ম্যাচ, যিনি ওয়াংখে়ড়েতে ২ এপ্রিল, ২০১১ ছক্কা মেরে জিতিয়েছিলেন বিশ্বকাপ, তাঁর চেয়ে বড় শিক্ষক আর কে হতে পারে! এমনকি, ছক্কা মারার সময় কী ভাবে ক্রিজ ছেড়ে বেরোতে হবে, সেটাও দেখিয়ে দিচ্ছিলেন ঋষভদের। আর দিল্লির তরুণ প্রতিভা বাধ্য ছাত্রের মতো তাঁর কথা শুনে যাচ্ছেন। দূরে দাঁড়িয়েও কত জ্বলন্ত দেখায় সেই ছবি! মহানায়ক বিদায় নিচ্ছেন, তৈরি করে দিয়ে যাচ্ছেন তাঁর উত্তরসূরিকে।
অনুশীলন শেষ করে নিজে গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরবেন। তখনও গায়ে লেগে রয়েছেন ঋষভ। দেখে মনে হবে এমএসডি যেন তাঁর ‘টেস্ট পেপার’। এটা বুঝে নিতে পারলেই আসল পরীক্ষায় লেটার মার্কস বাঁধা।
আনন্দবাজারের পক্ষ থেকে তাঁর দীর্ঘ কেরিয়ার এবং বহু সাফল্যের জন্য অভিনন্দন জানানো গেল। দেশের মাঠে গর্বের নীল জার্সিতে শেষ ম্যাচের জন্য শুভেচ্ছা জানানো গেল। হাল্কা হেসে ধন্যবাদ জানালেন মাহি। আলাদা কোনও অনুভূতি হচ্ছে কি না, জানতে চাওয়ায় ঘাড় নাড়িয়ে
নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া।
প্রিয়তম ক্রিকেট শেষ হয়ে আসছে। কেরিয়ার ফুরিয়ে যাওয়ার মুখে। দেশের মাঠে দেশের জার্সিতে জীবনের শেষ ম্যাচ! তাঁর পরিবারের সদস্যরা অনেকে উপস্থিত থাকতে পারেন নিজের শহরে শেষ বার প্রিয় মানুষটাকে দেখার জন্য। কত রকম আবেগের উথালপাতাল চলছে তাঁকে ঘিরে। কিন্তু মহানায়ক নিজে সেই একই রকম আবেগহীন। বিশ্বকাপ জেতানো ছক্কা মেরেও যে রকম নির্লিপ্ত, দেশের মাটিতে শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ নিয়েও একই রকম ভাবলেশহীন।
মহেন্দ্র সিংহ ধোনি, আপনার খেলাই শুধু শেষ হতে পারে, থেকে যাবে এমএসডি ফর্মুলা!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy