Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪

থেমে গেল হার না মানা মাসুদুরের জীবন-সাঁতার

পিকনিক গার্ডেন রোডের বাসিন্দা শাহনওয়াজ আলম। একটা হাত নেই। প্রবল বৃষ্টির মধ্যেই ঠায় দাঁড়িয়ে অ্যাম্বুল্যান্সের সামনে। দরগা রোডের বাসিন্দা সিরাজুল। একটা পা নেই। ক্রাচ হাতে তিনিও এসেছেন ফুল নিয়ে। পার্ক সার্কাসের সুরজিৎ মণ্ডল। বাঁ হাত অকেজো। ডান হাতে সাড় আছে, কিন্তু সেটা কোনও কাজে লাগে না। রবিবার বিকেলে তিনিও হাজির কুষ্ঠিয়া হাউসিংয়ে।

প্রীতম সাহা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:০৫
Share: Save:

পিকনিক গার্ডেন রোডের বাসিন্দা শাহনওয়াজ আলম। একটা হাত নেই। প্রবল বৃষ্টির মধ্যেই ঠায় দাঁড়িয়ে অ্যাম্বুল্যান্সের সামনে।

দরগা রোডের বাসিন্দা সিরাজুল। একটা পা নেই। ক্রাচ হাতে তিনিও এসেছেন ফুল নিয়ে।

পার্ক সার্কাসের সুরজিৎ মণ্ডল। বাঁ হাত অকেজো। ডান হাতে সাড় আছে, কিন্তু সেটা কোনও কাজে লাগে না। রবিবার বিকেলে তিনিও হাজির কুষ্ঠিয়া হাউসিংয়ে।

এঁরা শুধু প্রতিবন্ধী নন। এঁদের পরিচয় এঁরা সবাই মাসুদুর রহমানের ভক্ত। প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে মাসুদুরের লড়াই দেখে জীবনে কোনও না কোনও জায়গায় নিজেরাও এখন প্রতিষ্ঠিত। জীবনযুদ্ধে সফল। দিনগত যন্ত্রণার কান্না মুছে হাসছেন!

কিন্তু রবিবারের বিকেলে কেউ-ই মাসুদুরের নিথর দেহের সামনে চোখের জল আটকে রাখতে পারলেন না। পরিবারের সদস্যরা তো বটেই। বাংলার অবিশ্বাস্য এই সাঁতারুর অনুপ্রেরণায় যাঁরা জীবনে নতুন আলো দেখেছেন, তাঁরাও ভেঙে পড়লেন কান্নায়।

মাত্র ছেচল্লিশ বছর বয়সেই যে সব শেষ! মাসুদুর রহমান বৈদ্য আর নেই।

শুধু ক্রীড়াপ্রেমীরা নন, আজ সাধারণ মানুষও শোকস্তব্ধ। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিক্রিয়া, ‘‘সাঁতারু মাসুদুর রহমানের মৃত্যুতে আমি গভীর শোক প্রকাশ করছি। উনি বহু তরুণ সাঁতারুকেও প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। আমি ওঁর পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি।’’

দশ বছর বয়সে মাল গাড়ির নীচে নিজের দু’পা হারালেও মাসুদুর থামেননি। বরং নিজের দুর্বলতাকেই নিজের শক্তি বানিয়ে দৌড় শুরু করেন তিনি। প্রথমে গ্রামের পুকুরে, তার পরে একে একে মহাসাগর অতিক্রম করা। প্রতিবন্ধকতার জন্য অলিম্পিক ইভেন্টের সাঁতারে পারবেন না বলে বেছে নেন লং সুইমিং। মুর্শিদাবাদে প্রথম ৮১ কিমি দশ ঘণ্টায় পার করা দিয়ে শুরু। তার পরে অবিশ্বাস্য ভাবে ইংলিশ চ্যানেল, জিব্রালটর প্রণালী পার করে ইতিহাস গড়া। কোচ হিসেবেও মাসুদুর সফল। তাঁর প্রশিক্ষণেই অমৃতা দাস ইংলিশ চ্যানেল পার করেছেন। রেশমি শর্মা, রিচা শর্মারা উপকৃত। একটা কথা প্রায়ই শোনা যেত মাসুদুরের মুখে—আমি প্রতিবন্ধী নই। এ বার কি এভারেস্ট জয় করলে সেটা প্রমাণ হবে?

মায়ের কান্না। ছবি: সুমন বল্লভ।

মাসুদুরকে কিছু দিন আগেই ভারতের ‘রিয়াল হিরো’ বলেছিলেন সচিন তেন্ডুলকর। সেই ‘রিয়াল হিরো’ যে এত তাড়াতাড়ি চলে যাবেন, সেটা রবিবার সকালেও বোঝা যায়নি। প্রত্যেক দিনের মতো ঘুম থেকে উঠে খবরের কাগজ পড়েছেন। স্ত্রীর সঙ্গে হাসি-ঠাট্টাতেও মেতেছেন। এমনকী লাঞ্চে গলা ভাত আর জ্যান্ত মাছের ঝোলও রাঁধতে বলেন স্ত্রীকে। মাসুদুরের স্ত্রী বলছিলেন, ‘‘কিছু বুঝতেই দিল না। দু’তিন ধরে শরীর খারাপ ছিল। কিন্তু এ রকম হবে, সেটা স্বপ্নেও ভাবিনি। ওকে ভাত খাওয়াতে খাওয়াতেই অসুস্থ হয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে গেলেও বাঁচাতে পারলাম না।’’

পারিবারিক সূত্রের খবর, তিনি ডায়বেটিসের রোগী ছিলেন। সেখান থেকেই রক্তাল্পতা ও ‘মাল্টিপল অর্গ্যান ফেলিওর’। দুপুর তিনটে নাগাদ মধ্য কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালে তিনি মারা যান। রেখে গেলেন মা, স্ত্রী, দুই মেয়েকে।

বাংলার আর এক কিংবদন্তি সাঁতারু বুলা চৌধুরী বলছিলেন, ‘‘বাংলার সাঁতার জগতের একটা উজ্জ্বল তারা নিভে গেল। মাসুদুর যে নেই, সেটা এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না। কুড়ি বছর ধরে ওকে চিনি। খেতে খুব ভালবাসত। কিন্তু শরীরের যত্ন নিত না। কত বার বলেছি, মোটা হয়ে যাচ্ছিস। কন্ট্রোল কর। শুনল না কথা।’’ আফসোস গ্র্যান্ডমাস্টার দিব্যেন্দু বড়ুয়ার গলাতেও, ‘‘ও বুঝিয়েছিল, প্রতিভা আর জেদ থাকলে যে কোনও স্বপ্ন পূরণ করা যায়। শুধু প্রতিবন্ধীদের জন্যই নয়। মাসুদুর গোটা ক্রীড়া জগতের কাছেই এক জন আইকন। মনে হচ্ছে ছোট ভাইকে হারালাম।’’

মাসুদুরের শেষকৃত্য সোমবার তাঁর পৈতৃক ভিটে রায়খোলা বল্লভপুরে হবে। তাঁর বাবার সমাধির পাশেই। তার আগে অবশ্য ‘পিস ওয়ার্ল্ড’-এ থাকবে দেহ। সকালে সেখান থেকে জিন মসজিদ হয়ে তাঁর সল্টলেকের বাড়ি। তার পর সেখান থেকে রাজ্যের প্রয়াত ক্রীড়ামন্ত্রী সুভাষ চত্রবর্তীর বাড়িতে মাসুদুরকে শেষ শ্রদ্ধা জানাবেন সবাই। রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস বললেন, ‘‘মাসুদুরের পরিবার যা চাইবে, তাই করা হবে। ও আমাদের স্পোর্টস কাউন্সিলের কোচ ছিল। সুভাষ সরোবরে অনুশীলন করাতো।’’ এ দিন তাঁর পিকনিক গার্ডেনের বাড়িতে অরূপবাবু ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়, রবীন দেব ও রমলা চক্রবর্তী।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE