চিরবিদায়: শান্ত মিত্রকে শেষ শ্রদ্ধা শ্যাম থাপার। নিজস্ব চিত্র
বছর দেড়েক আগে এক অনুষ্ঠানে শানুদার (শান্ত মিত্রকে আমরা এই নামেই ডাকতাম) সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয়েছিল। তার পর শুনেছিলাম খুবই অসুস্থ ছিলেন। কিন্তু ভাবতে পারিনি এত তাড়াতাড়ি চলে যাবেন।
শানুদার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ১৯৬৭-তে। আমি সে বছর উয়াড়িতে সই করেছি। কলকাতা ময়দানে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য লড়াই করছি। শানুদা তখন ভারতীয় ফুটবলের তারকা। কলকাতা লিগে ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে দু’টো লেগেই আমি খুব ভাল খেলেছিলাম। ম্যাচের পরে শানুদা এসে আমার মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘‘মন দিয়ে খেলো। তুমি একদিন বড় ফুটবলার হবে।’’
তিন বছর পরে আমাকে ইস্টবেঙ্গলে নিয়ে এলেন জ্যোতিষ গুহ। অধিনায়ক তখন শানুদা। প্রথম দিন ক্লাবে আমাকে দেখেই জড়িয়ে ধরেছিলেন। ভাবতেই পারিনি আমার মতো এক জন অনামী ফুটবলারকেও উনি মনে রাখবেন। শানুদা আমাকে নতুন জীবন দিয়েছিলেন!
১৯৭০। নকশাল আন্দোলনের জেরে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি গোটা রাজ্যে। আমি তখন থাকতাম হাবড়ার কাছে অশোকনগরে। গড়িয়াহাটে ইস্টবেঙ্গলের মেসে সংস্কারের কাজ চলছিল বলে বাড়ি থেকেই যাতায়াত করতাম। একদিন অনুশীলনের পরে অশোকনগরে ফিরে গিয়েছি। বিকেলে রাস্তায় বেরনোমাত্র বন্দুক উঁচিয়ে আমাকে ঘিরে ধরে সেনাবাহিনীর জওয়ানরা। বারবার ওদের বললাম, আমি ফুটবল খেলি। এ বছরই সই করেছি ইস্টবেঙ্গলে। কিন্তু আমার বাঙাল ভাষা ওরা কিছুই বুঝতে পারল না। নকশাল সন্দেহে আমাকেই তুলে দিল প্রিজন ভ্যানে। মৃত্যুভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছিলাম। ওদের মধ্যে একজন বাঙালি ছিল। সে বলল, ‘‘চুপ করে বসে থাকো। এদের সঙ্গে কথা বলে কোনও লাভ নেই। একটু পরেই আমাদের অফিসার আসবেন, তাঁকে যা বলার বলবে।’’ আমার কথা মন দিয়ে শুনে সেই অফিসার বললেন, ‘‘আপনাকে স্টেশনে নামিয়ে দিচ্ছি। কলকাতা ফিরে যান। যত দিন না পরিস্থিতি শান্ত হয়, অশোকনগরে আসবেন না।’’ কিন্তু আমি থাকব কোথায়? শিয়ালদহে নেমে প্রথম গেলাম কাইজার স্ট্রিটে আমার গুরু বাঘা সোমের কোয়ার্টারে। উনি বললেন, ‘‘আমার এত বড় সংসার। অথচ ঘর মাত্র দু’টো— আজকের রাতটা একটু কষ্ট করে থাকো। কাল সকালে ক্লাবে গিয়ে কর্তাদের জানাও তোমার সমস্যার কথা।’’
আরও পড়ুন: শান্তর প্রয়াণে শোক ময়দানে
পরের দিন সকালে প্র্যাকটিসের পরেই সিনিয়র ফুটবলারদের বললাম, আমার ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা। শুনেই শানুদা বললেন, ‘‘পিন্টু, আমার কাছে থাকবি তুই।’’ বাড়িতে পৌঁছেই শানুদা ওঁর মাকে বললেন, ‘‘পিন্টু আজ থেকে এখানেই থাকবে। ও কিন্তু এক দিন বিরাট বড় ফুটবলার হবে। দেখো, পিন্টুর যেন কোনও অযত্ন না হয়।’’ শানুদার কথা শুনে লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিল আমার। দেড় মাসেরও বেশি সময় শানুদার বাড়িতে ছিলাম। একসঙ্গে খেলেছি টানা তিন বছর। শানুদা কত বড় ফুটবলার ছিলেন, আমি সেই প্রসঙ্গে ঢুকতে চাই না। শানুদাকে আমি শিক্ষক হিসেবে দেখি। ওঁর কাছেই শিখেছি, কী ভাবে সকলকে নিয়ে চলতে হয়। অভিভাবকের মতো আগলে রাখতেন সুধীর (কর্মকার), স্বপন (সেনগুপ্ত) আর আমাকে। কেন জানি না, আমার প্রতি ওঁর দুর্বলতা মনে হয় একটু বেশিই ছিল।কোনও দিন রাগতে দেখিনি ওঁকে। ম্যাচে আমরা অনেক সময় মাথা গরম করে ফেলতাম। কিন্তু শানুদা অদ্ভুত ভাবে নিজেকে শান্ত রাখতেন। আমরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতাম, এই কারণেই হয়তো মাসিমা ছেলের নাম রেখেছেন শান্ত!
শানুদার নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতাও ছিল অসাধারণ। সেরকমই ছিল ম্যাচ রিডিং। ১৯৭০ সালে আইএফএ শিল্ড ফাইনালে ইরানের পাস ক্লাবের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক জয় এসেছিল শেষ মুহূর্তে পরিমল দে-র গোলে। কিন্তু আমার কাছে নায়ক শানুদা-ই। উনি না থাকলে আমরা চ্যাম্পিয়ন হতাম না। কারণ, চোট পাওয়া হাবিবের পরিবর্তে পরিমলদা-কে নামানোর সিদ্ধান্তটা ওঁরই ছিল। সে বছর আমাদের কোচ ছিলেন হোসেন সাহেব। কিন্তু কলকাতা লিগের মাঝপথেই তিনি দল ছেড়ে চলে যান। শানুদাই অনুশীলন করাতেন। দল গড়তেন প্রশান্ত সিংহের সঙ্গে আলোচনা করে। শিল্ড ফাইনালের আগে আমাদের বলেছিলেন, ‘‘এই ম্যাচটার সঙ্গে দেশের সম্মান জড়িয়ে। প্রয়োজনে প্রাণ বাজি রাখতে হবে। কোনও অবস্থাতেই জিততে দেব না।’’
শানুদার আগ্রাসী নেতৃত্বে পাস ক্লাবকে ট্রফি নিয়ে যেতে দিইনি। কিন্তু আমার অধিনায়ককেই আর আটকে রাখতে পারলাম না!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy