Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
এক্সক্লুসিভ

কিছু অফিশিয়াল ফ্যানদের বোকা বানাচ্ছিল

কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী। ঝুমরিতালাইয়া থেকে মিজোরাম। গোটা ভারতীয় ক্রিকেটমহলে ধুন্ধুমার ফেলে দেওয়ার তিনিই কুশীলব। তাঁর সুপারিশে অনুমোদন দিয়ে তিরিশ ঘণ্টা আগে যুগান্তকারী ক্রিকেট রায় দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। সেই বিচারপতি রাজেন্দ্র মাল লোঢা-কে মঙ্গলবার গোটা দিনে ধরাই যাচ্ছিল না। রাতের দিকে বহু চেষ্টার পর দিল্লির বাড়ি থেকে ল্যান্ডলাইনে তিনি এক্সক্লুসিভ আনন্দবাজারের সঙ্গে।যে যে ভাবে দেখেন। আমি যেটা সত্যি সেটাই করার চেষ্টা করেছি। কখনও একটু কড়া হতেই হয়েছে। কারণ অনেক কিছু জগদ্দল পাথরের মতো চেপেছিল।

বিচারপতি রাজেন্দ্র মাল লোঢা

বিচারপতি রাজেন্দ্র মাল লোঢা

গৌতম ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২০ জুলাই ২০১৬ ০৪:৩৫
Share: Save:

প্রশ্ন: বলা হচ্ছে আপনার আনা বদল শুধু বদল নয়, সংস্কার।

লোঢা: যে যে ভাবে দেখেন। আমি যেটা সত্যি সেটাই করার চেষ্টা করেছি। কখনও একটু কড়া হতেই হয়েছে। কারণ অনেক কিছু জগদ্দল পাথরের মতো চেপেছিল। তাই কারও কারও যদি সংস্কার মনে হয়, আপত্তি করছি না।

প্র: আপনি ক্রিকেট খেলতেন?

লোঢা: না, স্কুলজীবনে একটুআধটু খেলতাম যেমন সবাই খেলে থাকে। বলার মতো নয়। তবে আদ্যন্ত ক্রিকেটপ্রেমী।

প্র: সব কিছু এমন উপড়ে ফেলা তো গতিশীল বাউন্সারের সামনে হেলমেটহীন খেলার মতো। এই সাহস কোথা থেকে পেলেন?

লোঢা: ২১ বছর বিচারক থেকেছি। অকুতোভয়ে কাজ করেছি। সাহস তো আমার রক্তেই।

প্র: সর্বোচ্চ আদালতের রায় বেরোবার পর কী ধরনের প্রতিক্রিয়া আশপাশ থেকে পাচ্ছেন?

লোঢা: আমার সঙ্গে যাঁরা যাঁরা কথা বলেছেন তাঁরা তো দেখলাম খুব খুশি।

প্র: কোনও প্রাক্তন ক্রিকেটার এর মধ্যে আছেন?

লোঢা: না।

প্র: সোশ্যাল মিডিয়া বা প্রিন্টে কেউ কেউ বলেছেন কালকের দিনটা ছিল ভারতীয় ক্রিকেটের রেনেসাঁ।

লোঢা: দেখেছি। আম ক্রিকেট ফ্যান খুশি হলেই আমি খুশি।

প্র: সবাই কিন্তু খুশি নন। অনেকের মনে হচ্ছে এটা ভারতীয় ক্রিকেটের খুব বিতর্কিত দিনও।

লোঢা: যেমন (কন্ঠস্বরে বিস্ময়)?

প্র: যেমন আপনার সুপারিশ মানার পর এমন উদ্ভট পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে যে, বোর্ডের সভায় ৪১বার রঞ্জিজয়ী মুম্বই ভোট দিতে পারবে না। অথচ নাগাল্যান্ড বা মিজোরাম ভোট দেবে। এটা অদ্ভুত বিচার নয়?

লোঢা: ক্রিকেট ভোটের ময়দানে শুরু হয় না। শেষও হয় না। ক্রিকেটের সঙ্গে ভোটকে এক করার কোনও মানে হয় না। আমি বলেছি মহারাষ্ট্র থেকে তিনটে ইউনিট ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ভোট দেবে। আমি তো বলিনি মহারাষ্ট্র থেকে তিনটে ইউনিট ঘুরিয়ে ফিরিয়ে রঞ্জি ট্রফি খেলবে। মুম্বই তো প্রতি বছরই রঞ্জি খেলবে। প্রতি বছরই চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সুযোগ পাবে। ভোটের অধিকারটা কি খেলার চেয়েও বড়? আমার তো মনে হয় ক্রিকেট খেলা হয় মাঠে, বোর্ডরুমে নয়।

প্র: আরও একটা আইন জারি নিয়ে তীব্র অসন্তোষ যে, সত্তর বছরের বেশি হলে প্রশাসন থেকে সরে যেতে হবে। ক্রিকেট কর্তারা অনেকেই বলছেন এটা কী অন্যায় নিয়ম? দেশের প্রধানমন্ত্রী-রাষ্ট্রপতিদের জন্য সত্তর বছরের লিমিট নেই। অথচ আমরা কী দোষ করলাম?

লোঢা: কে বলল আইন নেই। আমি তো চিফ জাস্টিস অব সুপ্রিম কোর্ট হিসেবে ৬৫ বছরে রিটায়ার করেছি।

প্র: পাশাপাশি এমন অনেক পদ আছে যা বয়সভিত্তিক নয়।

লোঢা: আরে ভাই যে কোনও প্রশাসনেই তারুণ্য আর অভিজ্ঞতার একটা মিশেল ঘটাতে হয়। যে মানুষটা সত্তর বছরে ছেড়ে দিচ্ছে সে তো তার আগের তিরিশ-চল্লিশ বছর ক্রিকেট অ্যাডমিনিস্ট্রেশনকে দিয়েছে। তার সেরাটা তো তার মানে সে দিয়েই দিয়েছে। আর কত থাকবে। ক্রিকেটের ভাষায় বলি, আর কত ব্যাট করবেন। প্যাভিলিয়নে তো আরও ব্যাটসম্যান বসে রয়েছে। তাদের একটু সুযোগ দিন।

প্র: একটা ধারণার সৃষ্টি হয়েছে যে, আপনি এমন কিছু বোর্ড কর্তাকে তদন্ত চালানোর সময় ইন্টারভিউ করেছিলেন যাঁরা সত্তর পেরিয়েই থুরথুরে। এমন বিশেষ কাউকে দেখেননি যাঁরা সেভেন্টি অথচ গোইং স্ট্রং। সেই জন্যই আপনার সুপারিশ।

লোঢা: যারা বলছে একদমই ঠিক বলছে না। বিচারক হিসেবে এত বছরের অভিজ্ঞতা থেকে আমি জানি কোন বয়সে মানুষ পারফরম্যান্সের শীর্ষে থাকে। কখন তার সামান্য অবতরণ শুরু হয়। আমি এটাও জানি যে, একজন বা দু’জনকে দেখে একটা গোটা গোষ্ঠী সম্পর্কে ধারণা করা উচিত নয়। কাজেই যারা বলছে তাদের বরঞ্চ জিজ্ঞেস করবেন প্যাভিলিয়নে বসে থাকা লোকগুলোর ব্যাট প্রাপ্য কী না?

প্র: প্রয়াত জগমোহন ডালমিয়া আপনার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। তখন ওঁর অসুস্থ শরীর। ওঁর সম্পর্কে আপনার রিপোর্টে থাকা পর্যবেক্ষণ ওঁর পরিবারের কাছে খুব মর্মান্তিক মনে হয়েছিল।

লোঢা: আমি সে ভাবে কিছু বলতে চাইনি। যখন উনি সাক্ষ্য দিতে আসেন তখন ওঁর শরীর একদমই ভাল যাচ্ছিল না। আমাকে বলেছিলেন, এখন ঠিকঠাক অবস্থায় নেই। পরের বার বেটার হয়ে আসব। দুর্ভাগ্য, উনি চলেই গেলেন।

প্র: আপনার অনুমোদিত রিপোর্টের আরও একটা ব্যাপার নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে।

লোঢা: এটাই শেষ প্রশ্ন কিন্তু। এর পর ছেড়ে দেবেন।

প্র: দু’তিনটে করেই ছেড়ে দিচ্ছি। ধোঁয়াশা হল যে, মন্ত্রী বা আমলাকে আপনি প্রশাসন থেকে হঠিয়ে দিলেন। অথচ বিধায়ক বা সাংসদরা বহাল তবিয়তে রইলেন। এটা কী বিচার হল। রাজনীতি তো সেই থেকেই গেল ক্রিকেট প্রশাসনে।

লোঢা: তার কারণ মন্ত্রী বা আমলাদের আমাদের দেশে যে ধরনের দায়িত্ব থাকে সেই ভারী দায়িত্ব সামলে দ্বিতীয় কোনও বড় কাজ করা সম্ভব বলে আমি মনে করি না। মন্ত্রীদের নিজস্ব মন্ত্রক দেখতে হয়। সেটা একটা মস্ত বড় কাজ। আমলাদের দেশ চালাতে হয়। ক্রিকেট এখন যে পর্যায়ে চলে গিয়েছে তাতে তার অনেক বেশি সময় প্রাপ্য।

প্র: সে তো বিধায়ক বা সাংসদদেরও নিজস্ব কাজ রয়েছে।

লোঢা: আমার মতে তাঁদের মন্ত্রী বা আমলার মতো এমন হোলটাইম জব ফোকাস নেই। তাঁরা নিজের কাজ করেও এখানে সময় দিতে পারেন।

প্র: আরও একটা ব্যাপার নিয়ে খটকা। ভারতীয় বোর্ডে এর প্রয়োগ হচ্ছে ছ’মাসের মধ্যে। রাজ্য সংস্থাগুলোয় নাকি এক বছরের মধ্যে। এটা কি সত্যি?

লোঢা: আমার সুপারিশ যদি সর্বাত্মক মেনে নেওয়া হয়ে থাকে, আমি ফাইনাল রিপোর্ট পুরোটা আর পড়িনি। তা হলে রাজ্য সংস্থা এক বছর সময় নিলেও চলবে।

প্র: বোর্ডে বিভিন্ন রাজ্যের বাইরের যে ভোটগুলো, সেগুলো আপনার সুপারিশ অনুযায়ী সর্বোচ্চ আদালত নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। সার্ভিসেস, রেলওয়েজ, ইউনিভার্সিটিজ। এ বার রাজ্যে কী হবে? সিএবি-তে যেমন ভোট আছে, রেলওয়েজ, কাস্টমস, পুলিশ, ইউনিভার্সিটিজ। সেই ভোটগুলো কী হবে?

লোঢা: মূল রিপোর্টের আদর্শ মেনে চললে সেগুলোও নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়া উচিত। এটা নিয়ে আমরা গভীরে যাইনি। তবে সার্বিক ইউনিফর্মিটির জন্য রাজ্য সংস্থাতেও সেটাই অনুসরণ হওয়া উচিত।

প্র: আপনি বলছিলেন ঘোর ক্রিকেট ভক্ত। এই যে সংস্কারগুলো আনলেন, সেটা কি তদন্ত করতে বসে? না কি ক্রিকেট ভক্ত থাকার সময়ও আপনার মাথার মধ্যে ছিল যে এমনটাই হওয়া উচিত?

লোঢা: কিছু তো মাথার মধ্যে ছিলই। গড়পড়তা ক্রিকেট ফ্যান হিসেবে তো সব কিছু চোখের সামনে দেখতে পেতাম যে, তিরিশ-চল্লিশ বছর ধরে একই লোকেরা প্রতিষ্ঠানটাকে নিজেদের কুক্ষিগত করে রেখেছে। এরা কিছুতেই কাউকে ঢুকতে দেবে না। নতুন রক্ত, নতুন চিন্তা আনবে না। এটা কী করে খেলাটার জন্য ভাল হতে পারে? গোটা দেশে এত জনপ্রিয় খেলা মাত্র তিন-চারটে লোকের মেজাজ মর্জির ওপর নির্ভর করে থাকবে কেন? তার পর অতর্কিতে এই দায়িত্বটা আমার কাছে আসে। তখন অনেক ইনপুট জোগাড় করি। রিসার্চ করি। সব কিছু তলিয়ে দেখে সিদ্ধান্তে পৌঁছই।

প্র: হাতেকলমে সব কিছু দেখে কি মনে হল দূর থেকে যা দেখতেন সঙ্কট তার চেয়েও বেশি?

লোঢা: তার চেয়ে অনেক বেশি। আমি আগেও জানতাম জেনুইন ক্রিকেট ফ্যান অনেকে টিকিট পায় না। সত্তর-আশি শতাংশ টিকিট কর্তারা আগেই ডিস্ট্রিবিউট করে দেয়। বহু কষ্টে যদিও বা মাঠে ঢোকা গেল জল নেই, বসার জায়গা নেই। পরিষ্কার বাথরুম নেই। আর এই অফিশিয়ালদের সেই সব নিয়ে কোনও তোয়াক্কাই নেই।

প্র: আপনার সুপারিশে কি তাই ক্রিকেট ফ্যান সবচেয়ে অগ্রাধিকার পেয়েছে?

লোঢা: একজ্যাক্টলি। আমার সিদ্ধান্তে প্রকৃত নায়ক হল ওই রোদে দাঁড়িয়ে থাকা ফ্যানরা। সুযোগসন্ধানী অফিশিয়ালগুলো নয়। যারা দিনের পর দিন ফ্যানদের বোকা বানিয়েছে। তাদের প্রাপ্য দেয়নি।

প্র: ক্রিকেট মহলে এখনও বিলাপ চলছে যে, এমন বিধ্বংসী রায় হল শুধুমাত্র একটা লোকের জন্য। যাঁর নাম নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসন। শুধু একটা লোকের খেসারত দিতে হল বাকিদের।

লোঢা: পেছনে ফিরে তাকালে হয়তো সে রকমই মনে হবে। ওকে কেন্দ্র করে মামলা থেকেই তো সব কিছু শুরু হল। কিন্তু সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে আমি বলব যে, এই সর্বাত্মক সংস্কারের প্রয়োজন ছিল। এটা একটা টেমপ্লেট হয়ে থাকল। অন্য ক্রীড়াসংস্থার জন্যও থাকল। শুধু ক্রিকেট নয়।

প্র: এই তিরিশ ঘণ্টায় সবচেয়ে ভাল কমপ্লিমেন্ট কী পেলেন?

লোঢা: (হাসি) আপনি ভয়ডরহীন ভাবে নিজের কাজটা করেছেন।

অন্য বিষয়গুলি:

Rajendra Mal Lodha officials
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE