দলের তিন গোলের মধ্যে দু’টোই তাঁর। ড্র করেও শেষ ষোলোয় জায়গা করে নিল পর্তুগাল। — রয়টার্স
হাঙ্গেরি-৩ : পর্তুগাল-৩
(জেরা, জুজাক-২) (নানি, রোনাল্ডো-২)
জিনিয়াসরা জ্বলে ওঠে ঠিক আসল সময়েই। যখন সে দেখে, তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী মাঠে আগুন ঝরাচ্ছে।
বুধবার রাতে যে রোনাল্ডো ম্যাজিক দেখলাম, তাতে এক কথায় এটা একটা ছ’গোলের থ্রিলার। নব্বই মিনিটের যে টানটান চিত্রনাট্যে নায়ক এক জনই। তার নাম ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো। যতই হাঙ্গেরির জুজাক জোড়া গোল করে যাক না কেন। পুসকাসের দেশের বিরুদ্ধে ম্যাচটা জিততে না পারলেও ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো বুঝিয়ে দিল তার সেই সিগনেচার ফ্লিক, হেড এখনও হারিয়ে যায়নি।
নিজে একটু আধটু ফুটবল খেলেছি বলেই জানি, বড় ফুটবলারদের একটা ইগো সব সময় কাজ করে— আমিই সেরা। কিন্তু সেটা যখন মাঠে সে করে দেখাতে পারে না, তখনই সে মেজাজ গরম করে। অস্বাভাবিক সব আচরণ করে। যে কারণে কখনও বিপক্ষ টিমের সঙ্গে হাত না মিলিয়ে ম্যাচ শেষে ড্রেসিংরুমে ওর ফিরে যাওয়া। কখনও তাদের তাচ্ছিল্য করা।
এ বারের ইউরোতেও এ দিনের আগে ঠিক সেটাই হচ্ছিল রোনাল্ডোর সঙ্গে। একে এটা ওর শেষ ইউরো। তার উপর কোনও কারণে ক্লিক করছিল না ওর পরিকল্পনাগুলো। ১৮০ মিনিট খেলেও আইসল্যান্ড ও অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে কোনও গোল পায়নি। তার উপর পেনাল্টি মিস। অথচ এটাকেই ইউরো শুরুর আগে বলা হচ্ছিল অন্যতম সহজ গ্রুপ। সেখানে জয়ের জন্য কি না তীর্থের কাকের মতো বসে ফুটবল দুনিয়ার সিআর সেভেন!
চোখের সামনে ও দেখতে পাচ্ছিল কোনও এক লিওনেল মেসি কোপায় নিজের ব্যাড প্যাচ কাটিয়ে একের পর এক গোল করে টিমকে জেতাচ্ছে। ফাইনালেও চলে গেল বুধবার সকালেই। রিয়াল মাদ্রিদে ওর সতীর্থ গ্যারেথ বেল ইংল্যান্ডের সঙ্গে একই গ্রুপে থেকেও নিজের দেশ ওয়েলসকে গ্রুপ সেরা করছে। রিয়ালের আরও এক সতীর্থ জার্মানির টনি ক্রুজ মাঝমাঠে একটা শক্তপোক্ত নেতৃত্ব দিচ্ছে জোয়াকিম লো-র টিমকে। সেখানে রোনাল্ডোর টিম না পাচ্ছে জয়, না পাচ্ছে গোল।
রোনাল্ডোও যে ভিতরে ভিতরে জ্বলছে তা বুঝতে পারছিলাম। আরও ভাল করে ব্যাপারটা বুঝলাম ম্যাচ শুরুর আগে খবর দেখতে গিয়ে। কোনও এক সাংবাদিকের প্রশ্নে তাঁর হাতের বুম কেড়ে ফেলে দিয়েছে ও। তবু বুধবার সকালেই খবরের কাগজে দু’টো মন্তব্য পড়ে কেন জানি না মনে হয়েছিল, হাঙ্গেরি ম্যাচে জ্বলে উঠবেই রোনাল্ডো।
এক, পর্তুগাল টিমে রোনাল্ডোর সতীর্থ উইলিয়াম কার্ভালহো মিডিয়াকে এই ম্যাচ সম্পর্কে বলেছিল, ‘‘আমরা জানি ক্রিশ্চিয়ানো আমাদের নেতা। কিন্তু আমরা ওর উপর নির্ভর করে নেই।’’
দুই, পর্তুগিজ কোচ ফার্নান্দো সান্তোস বলেছিলেন, ‘‘কে বলল রোনাল্ডো চাপে? ও সব সময়েই গোল করতে ভালবাসে।’’
নিজস্ব ছন্দে গোল করতে না পারার জন্য রোনাল্ডো মনে মনে গুমরোচ্ছিল ঠিকই। কিন্তু সবাই জানে, সেটাই পর্তুগিজদের জন্য একটা শুভ লক্ষ্মণ। কারণ, অতীতে এ রকম পরিস্থিতিতে পড়লে রোনাল্ডো অবস্থাটা সুইচ ওভার করেছে গোল করে। ম্যাচ জিতিয়ে।
এ রকম অসহনীয় চাপে রোনাল্ডোর মতো যে কোনও তারকা ফুটবলারেরই একটু বেশি অ্যাড্রিনালিন ঝরবে। হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে ম্যাচেও ঠিক সেটাই হল। শুধু কাঙ্ক্ষিত জয়টাই এল না, এই যা। তাতে অবশ্য রোনাল্ডোদের শেষ ষোলোয় যাওয়া আটকালো না। রোনাল্ডোর দু’টো গোলই পর্তুগালকে বাঁচিয়ে রাখল।
প্রথমার্ধ জুড়ে রোনাল্ডো পুরোপুরি নিষ্প্রভ। হতাশায় মাঠের মধ্যেই হাত-পা ছুড়ছে। তখন মনে হল কার্ভালহোর কথাটাই ঠিক। পেপে, নানি, জোরাও মারিওরা নিজেদের নিংড়ে দিচ্ছে। কিন্তু রোনাল্ডো কোথায়?
সিআর সেভেন তার সিগনেচার ফর্মে ফিরল দ্বিতীয়ার্ধে। স্যাঞ্চেজ নামার পর। কিন্তু ততক্ষণে প্রথমার্ধে ১-১ থাকা ম্যাচ ১-২ পিছিয়ে পড়েছে পর্তুগাল। ম্যাচটার রোনাল্ডো ম্যাজিক শুরু হল সাতচল্লিশ মিনিট থেকে। তার পরের পনেরো মিনিটে যা হল, তা দেখার জন্য তামাম ফুটবলপ্রেমীই ম্যাচটা বারবার দেখতে চাইবে। জুজাক ফ্রি-কিক থেকে নিজের প্রথম গোলটা করার তিন মিনিটের মধ্যেই দর্শনীয় ব্যাক ফ্লিকে রোনাল্ডোর প্রথম গোল। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই হাঙ্গেরির ব্যবধান বাড়ানো। কিন্তু রোনাল্ডো সেটাও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেনি। সাত মিনিটের মধ্যেই ফের গোল করে ৩-৩ করার পর রোনাল্ডো প্রমাণ করে, দিল তার কোচের কথাই ঠিক। গোল করাটাই ওর অভ্যাস।
এই ইউরোর শুরুতে পর্তুগালের প্রথম ম্যাচ দেখে বলেছিলাম, রোনাল্ডো ফিট কি না তা নিয়ে আমি সন্দিহান। কিন্তু এ দিনের রোনাল্ডোকে দেখে সেই ধারণা থেকে সরে আসতেই হচ্ছে। কারণ ও মোটেই আনফিট নয়। আসলে ক্লাব ফুটবলে যে তাগিদ নিয়ে ওকে খেলতে দেখা যায়, সেই তাগিদ যে কোনও কারণেই হোক, এত দিন চোখে পড়েনি। আসলে রোনাল্ডোকে ওর চেনা ফর্মে দেখা যায়নি দু’টো কারণে। এক, ওর সেই বল পায়ে উইং ধরে বিদ্যুৎগতির দৌড়গুলো এই ইউরোতে ছিল না। দুই, সেই ট্রেডমার্ক ফ্রি-কিকও যেন কোথায় হারিয়ে গিয়েছে। এ দিনও ফ্রি-কিকগুলো গোলে রাখতে পারছিল না।
তা সত্ত্বেও এই ম্যাচের শেষের পঁয়তাল্লিশ মিনিট যে ‘রোনাল্ডো শো’ দেখলাম, তাতে যেন সেই পুরনো রোনাল্ডোরই ঝলক। শুধু পঁয়তাল্লিশ মিনিটের জন্য না হয়ে সেটা যদি প্রথম ম্যাচ থেকেই শুরু হয়ে যেত, তা হলে শেষ ইউরোতে নক আউটে যাওয়ার এত অনিশ্চয়তা নিয়ে মাঠ ছাড়তে হতো না ওকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy