পেশাদার টেনিসকে বিদায় জানালেন ফেডেরার। ছবি: রয়টার্স
গেম, সেট, ম্যাচ।
শেষ হয়ে গেল আধুনিক টেনিসের একটা অধ্যায়। যে অধ্যায়ের গভীরতা দেখা গেলেও মাপা কঠিন। আরও কঠিন অনুভব করা। এই অধ্যায়ের নাম রজার ফেডেরার।
ফেডেরার গত ১৫ সেপ্টেম্বর জানিয়ে দিয়েছিলেন, লেভার কাপেই শেষ বার প্রতিযোগিতামূলক টেনিস খেলবেন। কয়েক দিন আগে ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন, শেষ ম্যাচে জুটি বাঁধতে চান নাদালের সঙ্গে। তেমনই হয়েছে সব। শুক্রবার লেভার কাপের ডাবলস ম্যাচে আমেরিকার জ্যাক সক এবং ফ্রান্সেস টিয়াফো জুটির বিরুদ্ধে ফেডেরার-নাদালের বিপক্ষে ফল ৬-৪, ৫-৭, (৯-১১)।
প্রাক্তন টেনিস খেলোয়াড় জিমি কোনর্স এক বার বলেছিলেন, ‘‘আধুনিক যুগে আপনি হয় ঘাসের কোর্টের খেলোয়াড়, নয় আপনি হার্ড কোর্টের খেলোয়াড় অথবা ক্লে কোর্টের খেলোয়াড়। নয়তো আপনি রজার ফেডেরার!’’ কোনর্সের এই মন্তব্যের সমর্থন পাওয়া গিয়েছে তাঁর দুই প্রবল প্রতিপক্ষ রাফায়েল নাদাল এবং নোভাক জোকোভিচের কথাতেও। দু’জনেই মেনে নিয়েছেন, সেরা ছন্দে থাকা ফেডেরারকে হারানোর ক্ষমতা তাঁদের নেই। নাদাল বলেছিলেন, ‘‘ফেডেরার যদি নিজের সেরা টেনিস খেলে, তা হলে আমার কোনও সুযোগ থাকে না। আমি যদি দুর্দান্ত টেনিস খেলি আর ফেডেরার যদি সেরা ছন্দে না থাকে, তা হলেই শুধু ওকে হারাতে পারি।’’ জোকোভিচ বলেছিলেন, ‘‘নিজের সেরা টেনিস খেললেও ফেডেরারকে হারানোর দক্ষতা আমার নেই। আপনি যত ভালই খেলুন, রজার এমন কিছু শট মারবে যেগুলোর জবাব দিতে পারবেন না।’’ অথচ ফেডেরারে গ্র্যান্ড স্ল্যামের সংখ্যা ২০। নাদাল, জোকোভিচ জিতেছেন যথাক্রমে ২২ এবং ২১টি করে গ্র্যান্ড স্ল্যাম।
নিজের শর্তে স্বেচ্ছাবসর। ফেডেরারকে ছাড়া কাকেই বা মানায়? চাইলে খেলতেই পারতেন আরও কিছু দিন। কে রুখত তাঁকে? রুখল বেহায়া চোট। আধুনিক যুগের সম্ভবত সব থেকে নয়নাভিরাম টেনিস আর দেখা যাবে না। যে টেনিসের অন্যতম সৌন্দর্য মার্জিত আচরণ। টেনিস কোর্টে মেজাজ কি কখনও হারাননি ফেডেরার? তিনি কি যথেষ্ট আগ্রাসী নন? সব কিছুই সীমাবদ্ধ থেকেছে তাঁর চাহনিতে। কোর্টের ভিতরে হোক বা বাইরে, কখনও সীমা অতিক্রম করেননি। মার্জিত আচরণ তাঁর উচ্চতাকেই আরও বাড়িয়েছে। যা মেনে নিয়েছে টেনিস বিশ্ব।
টেনিসই ফেডেরারের বিশ্ব। যে বিশ্বকে প্রথম থেকে আগলে রেখেছিলেন মিরকা। বলা হয়, যে কোনও সফল পুরুষের পিছনে থাকে এক জন নারীর অবদান। মিরকা মিক্সড ডাবলসে ফেডেরারের প্রাক্তন সঙ্গী। জীবন সঙ্গীও। মিরকা যখন টেনিস থেকে অবসর নেন, তখন রাজা হননি রজার। তবু ফেডেরারকে এগিয়ে দিয়েছিলেন মিরকা। আসলে বিশ্ব টেনিসকেই এগিয়ে দিয়েছিলেন অনেকটা। মিরকার প্রতি কৃতজ্ঞতা বহু বার প্রকাশ করেছেন ফেডেরার। মিরকার কাছে আসল ঋণ তো বিশ্ব টেনিসের।
জোকোভিচ বলেছেন, “টেনিসকে যে ভাবে বদলে দিয়েছে ফেডেরার, তা কোনও ভাবেই ভোলা যাবে না। ওর খেলার ধরন, কঠোর পরিশ্রম যে কোনও টেনিস কোচ, খেলোয়াড় বা সাধারণ টেনিস সমর্থকদের চোখ জুড়িয়ে দেবে। ও এমন একটা উত্তরাধিকার রেখে যাচ্ছে, যা পূরণ করতে অনেক সময় লাগবে।” গোটা খেলোয়াড় জীবনে ফেডেরারের বিরুদ্ধে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করা নাদাল বলেছেন, ‘‘ফেডেরারের শেষ ম্যাচে জুটি বাঁধার স্মৃতি আজীবন থাকবে আমার।’’
ঠিকই বলেছেন জোকোভিচ, নাদালরা। ফেডেরারের উত্তরাধিকার! ভুলে যাওয়া সম্ভব তাঁর টেনিস?
শেষ ম্যাচ খেলার আগে ৪১ বছরের ফেডেরার বলেছিলেন, ‘‘আমি জানি না, ধকল নিতে পারব কি না। তবে অবশ্যই চেষ্টা করব।’’ তাঁর এই চেষ্টাকেই গত ২৪ বছর সমীহ, শ্রদ্ধা করে এসেছে টেনিস বিশ্ব। তাঁর চেষ্টার ফলাফল টের পেয়েছেন জোকোভিচ, নাদালরা। ফেডেরারের চেষ্টা শুরু হয়েছিল পিট সাম্প্রাসকে দেখে। আমেরিকার প্রাক্তন টেনিস খেলোয়াড়ই তাঁর আদর্শ। সেই সাম্প্রাসও অবসরের প্রতীক্ষায় থাকা নিজের ভক্তের উদ্দেশ্যে বলেছেন, ‘‘তোমার বিরুদ্ধে যখন প্রথম খেলেছিলাম, তখন তোমার বয়স ছিল ১৯। তখন তুমি এক জন উঠতি খেলোয়া়ড়। অনেকেই তোমাকে নিয়ে কথা বলছিল। উইম্বলডনের সেন্টার কোর্টে আমাদের তীব্র লড়াই হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত তোমার কাছে হেরে গিয়েছিলাম।’’
নিজের আদর্শকে হারিয়ে যাঁর উত্থান তিনি তো বিশেষ-ই হবেন। উইম্বলডনের সেই সেন্টার কোর্টেই আট বার শেষ হাসি হেসেছেন ফেডেরার। তিনিই উইম্বলডনের ‘রাজা’। সাম্প্রাস জিতেছিলেন সাত বার। ফাইনাল খেলেছিলেন। রাজত্বের হাত বদল হয়েছিল তখনই। সেই রাজত্বের অবসান হল শুক্রবার। কয়েক দিন আগেই শেষ হয়েছে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের রাজত্বের। রানির মৃত্যুর পর রাজা হয়েছেন তৃতীয় চার্লস। ইংল্যান্ডের রাজ পরিবারের উত্তরাধিকার আগেই নির্দিষ্ট ছিল। অল ইংল্যান্ড লন টেনিস ক্লাবের উত্তরাধিকার অনির্দিষ্ট। কার্যত অসম্ভব।
টেনিস ছাড়া কেমন লাগবে ফেডেরারকে? বা ফেডেরারহীন টেনিস? নিন্দকরা বলতেই পারেন গত উইম্বলডনের পর থেকে তো টেনিস ফেডেরারহীনই। টেনিস ছাড়াই দেখতে হয়েছে ফেডেরারকে। কিন্তু সেটা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ছিল না। ফেডেরারের ফিরে আসার সম্ভাবনা ছিল। সবুজ গালিচায় তাঁর টেনিস শিল্প দেখার আশা ছিল। শিল্পী যখন নিজেই তুলির শেষ টান দিয়ে ফেলেন, তখন থমকে যায় সৃষ্টি। থেকে যায় স্মৃতি। আগামী দিনে টেনিস কুলের সম্বল স্মৃতি। ফেডেরার নিশ্চিত ভাবেই থাকবেন টেনিস কোর্টের কাছাকাছি। টেনিসকে নিশ্চয় ততটাও দরিদ্র করবেন না সুইস ‘কিংবদন্তি’। তবু, নতুন করে আর তৈরি হবে না শিল্প। দেখা যাবে না তাঁকে ঘিরে ভক্তদের উৎকন্ঠা, উচ্ছ্বাস।
পেশাদার টেনিস খেলবেন না জানিয়েছেন ফেডেরার। টেনিস খেলবেন না, এমন কথা বলেননি। এটাই আশা। শুধু টেনিস বিশ্বের নয়, গোটা ক্রীড়া বিশ্বের। টেনিসপ্রেমীদের অনেকেই বলেন, আধুনিক টেনিসের ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর হলেন ফেডেরার, নাদাল, জোকোভিচ। সেই ব্রহ্মা নিজেকে সরিয়ে নিলেন কোর্ট থেকে। বিষ্ণুও কাবু চোট-আঘাতে। কত দিন পারবেন, নিজেই নিশ্চিত নন। মহেশ্বরও বেছে বেছে খেলছেন প্রতিযোগিতা। ওদিকে সরে গিয়েছেন সেরিনা উইলিয়ামসও। সময়ের নিয়মে রং হারাচ্ছে টেনিস।
এক ইংরেজ ক্রীড়া সাংবাদিক লিখেছিলেন, ‘ফেডেরারমোন’। অর্থাৎ, ফেডেরার কোর্টে নামলেই যে হরমোন ক্ষরণ শুরু হয়। যে হরমোনের প্রভাবে কোর্টের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে যেতেন তিনি। বিদ্যুৎ গতিতে প্রতিপক্ষের দিকে ছুটে যেত তাঁর ব্যাক হ্যান্ড বা ফোর হ্যান্ড। সার্ভ, ভলিতে লেগে থাকত শিল্পের ছোঁয়া। বেসলাইনে খেলেও দাঁড় করিয়ে রাখতেন প্রতিপক্ষকে। যে হরমোন তাঁকে দিত নিখুঁত ‘জাজমেন্ট’। হাসি মুখে প্রতিপক্ষের শিরদাঁড়ায় ঠান্ডা স্রোত বইয়ে দিতেন টসের সময়েই। সেই ‘ফেডেরারমোন’ আর নিঃসৃত হবে না। আর চেয়ার আম্পায়াররা বলবেন না গেম, সেট, ম্যাচ ফেডেরার।
পুরুষদের আধুনিক টেনিসে শেষ কথা কি ফেডেরারই ছিলেন? বোধ হয় না। নাদাল, জোকোভিচরা ছিলেন। কিছুটা ছিলেন অ্যান্ডি মারেও। শেষ বেলায় প্রবল প্রতিপক্ষদের সতীর্থ হিসাবে পেয়েছেন। সকলেই পাশে ছিলেন। ছিলেন ফেডেরারে আচ্ছন্ন হয়ে। বন্ধুকে বিদায় জানাতে হয়তো তাঁদের চোখও ভিজেছে। কেঁদেছেন বিশ্ব জুড়ে অসংখ্য ভক্ত। হয়তো অদূরে ভিজেছে উইম্বলডনের কোর্টের ঘাস। সেই জল কি শিশিরের? না টেনিস ঈশ্বরের অশ্রু!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy