১৩৫*
ছেলেটা বড় মুখচোরা, বড় গোবেচারা গোছের। চলে মাথা নিচু করে, কথা বলে এত আস্তে যে মাইকেও শোনা যায় না ঠিক মতো। স্পোর্টসম্যানের সাফল্যের যে স্বাভাবিক বিজ্ঞাপন হয়, এর তো তা-ও নেই। আজ একটা ব্যতিক্রমী দিন বলে, একটু বেশি লাফাল-ঝাঁপাল। ব্যাট তুলে আকাশে দেখল, ঠিক যেমন আমাদের সচিন দেখত। কিন্তু তার পরই দেখো সেই শান্ত, নির্বিরোধী ব্যাটিং। যেন প্রথম ওভার খেলছে। অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জিতে জিম কুরিয়র ইয়ারায় ঝাঁপ দিয়েছিল। ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো গোল করে কেমন পা ফাঁক করে দাঁড়ায়। ও তো পারত আর একটু আবেগ দেখাতে, আর একটু রোম্যান্টিক হতে।
শুধু একটাই আশ্চর্যের। টি-টোয়েন্টির যুগেও ও সাত ঘণ্টা টানা ব্যাট করে যেতে পারে!
ছেলেটার সঙ্গে আমার পাশের বাড়ির পল্টুর কোনও মিলই নেই। আইফোন প্রজন্মের ছেলে, অথচ হাতে কি না ট্যাটুর সংখ্যা শূন্য! কলারটা উঠে থাকবে না, প্রতিশোধের দিনেও অবিচার নিয়ে টুঁ শব্দ করবে না, এ আবার কী! মহিলা ফ্যানের সংখ্যা তো পাঁচ পেরনো উচিত নয়।
শুধু একটাই আশ্চর্যের। বোলার এত দাঁত-খিঁচুনি দিল দিনভর, সুইংয়ে শেষ না করতে পেরে লাগাতার বাউন্সার দিল, কোহলি থেকে রোহিত সবাই চলে গেল এক-এক করে, তবু ও নার্ভ ফেল করল না!
আপনি যদি ভারতবাসী হন, সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাবের মাঠের শনিবাসরীয় চেতেশ্বর পূজারাকে যদি টিভিতে দেখে থাকেন, ব্যক্তি পূজারাকে নিয়ে উপরের ব্যাখ্যাগুলো মনে ধরলে দোষ দেওয়া যাবে না। এটা ঠিক যে মনুষ্যচরিত্র হিসেবে সৌরাষ্ট্রের সাতাশ বছরের যুবক যুগধর্মের মানদণ্ডে বেশ অনাকর্ষণীয়, অনাবেগী। হাতে সত্যিই তাঁর কোনও ট্যাটু থাকে না, কথাটা বেশ আস্তে বলেন এবং নিয়মিত পূজা-অর্চনা করাটা জীবনে তাঁর নিয়ম। কিন্তু আপনি যদি হন নিখাদ টেস্ট-ক্রিকেটপ্রেমী, যদি পাঁচ দিনের বাইশ গজের যুদ্ধকে জীবন মনে হয়, চেতেশ্বর পূজারাকে ভাল না লেগে উপায় নেই।
কী বলা যায়? কী বলা উচিত? পরিসংখ্যান বলছে, চারশো চৌত্রিশ মিনিট ক্রিজে পড়ে থেকে মহাকাব্যিক ইনিংস খেলে গেলেন পূজারা। বলছে, দু’দিন ধরে প্রায় ‘বিলিতি’ বাইশ গজ বানিয়েও শ্রীলঙ্কা পেসাররা একটা বল বার করতে পারেননি যা দিয়ে তাঁর ব্যাটিং-শিল্পের মৃত্যু ঘটানো যায়। এখন ১৩৫ ব্যাটিং। রবিবার সকালে হয়তো আরও এগোবেন। শেষ পর্যন্ত দেড়শোতেও দাঁড়াতে পারে। কিন্তু কতগুলো সংখ্যা আর যা-ই হোক, তাঁর ইনিংসের সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা করতে পারবে না। বলতে পারবে না, পূজারা শ্রীলঙ্কার মাঠে জীবনের ইনিংস খেলে গেলেন। যে ইনিংস তাঁকে ক্রিকেট-নির্বাসন থেকে ফের বাইশ গজের পৃথিবীতে পুনর্জন্ম দিল না, মুমূর্ষু টিমকেও জীবনধারণের প্রয়োজনীয় অক্সিজেন দিয়ে গেল। নাহ্। হারের বেদি থেকে টেনে তুলে জয়ের একমুঠো স্বপ্ন উপহার দিয়ে গেল। সঙ্গে নির্বাচক ও টিম ম্যানেজমেন্টের উদ্দেশ্যে একটা নীরব বার্তা— দেখো, তোমরা এত দিন কাকে বসিয়ে রেখেছিলে। এক-দু’দিন নয়, টানা আটটা মাস বসিয়ে রেখেছিলে।
পূজারার সেঞ্চুরির পর ভারতীয় টিম ডিরেক্টর রবি শাস্ত্রীকে দেখা গেল গর্বিত ভাবে হাততালি দিতে। স্বাভাবিক। যে দিনটা হওয়ার কথা ছিল ভারতের বালখিল্যসুলভ টেস্ট ব্যাটিং অর্ডারকে তুলোধোনা করার দিন, তা শেষ পর্যন্ত দাঁড়াল পূজারা-বন্দনার প্রহর। টেস্ট ক্রিকেটে ব্যাটসম্যানের কাছে দু’টো জিনিস চাওয়া হয় সাধারণত। এক, সফট হ্যান্ডের বেশি ব্যবহার। আর দুই, ধৈর্য নামের একটা শব্দ। বিরাট কোহলি স্বতন্ত্র। তিনি যে জাতের ব্যাটসম্যান, সেখানে চাওয়া-পাওয়ার ব্যালান্স শিট মেলাতে বসাটা অর্থহীন। মুরলী বিজয় পারেন। কিছুটা অজিঙ্ক রাহানেও। কিন্তু ভারতীয় টেস্ট ব্যাটিং অর্ডারের বাকিরা দু’টো শর্তের একটাও পূরণ করেন বলে অভিযোগ নেই।
এ দিন সকালের ধামিকা প্রসাদের সামনে যেটা দরকার ছিল। উইকেটের সবুজকে পেসারের ব্যবহার না করানোই অস্বাভাবিক। কিন্তু ধামিকা যা করছিলেন, অস্বাভাবিক। এত মারাত্মক সুইং করাতে শেষ কোনও লঙ্কা পেসারকে দেখা গিয়েছে, মনে করা মুশকিল। এক-একটা পড়ছে, আর ‘ব্যানানা-সুইংয়ে’ ব্যাটসম্যানকে দিশেহারা করে চলে যাচ্ছে। কোহলির মতো দুঁদে টেকনিক-সম্পন্ন ব্যাটের বিরুদ্ধে প্রথম ওভারে দু’টো এলবি-র আবেদন উঠে গেল! লাঞ্চের আগে একটা সময় দেখা গেল, পনেরো ওভারে ভারতের রান যোগ হয়েছে বাইশ! শ্রীলঙ্কার সিম বোলারদের বিরুদ্ধে রান রেট দেখাচ্ছে ১.১১! যত সময় যাচ্ছে, গলায় ফাঁস চেপে বসছে।
পূজারা একটা সময় পুরো পাঁচটা ওভার নিশ্চল থেকে গেলেন। একটাও রান নিলেন না। সফট হ্যান্ড ব্যবহার করে খেলে ছেড়ে দিলেন। মুশকিল হল, তিনি যা পারেন, রোহিতদের কাছে তা দুঃসাধ্য। আইপিএল এবং ওয়ান ডে খেলে খেলে টেস্ট ক্রিকেটের দু’টো শর্তের কোনওটাই বেঁচে নেই। নমন ওঝা যে ভঙ্গিতে টেস্ট অভিষেকে মিড অনে উঁচু ক্যাচ তুললেন, সেটা ঋদ্ধিমান সাহাকে নিঃসন্দেহে নিশ্চিন্ত করবে। বিনি-রোহিত পরপর দু’বলে গিয়ে আবার প্রসাদকে দাঁড় করিয়ে গেলেন হ্যাটট্রিক সম্ভাবনার সামনে। সাত বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটজীবন হয়ে গেল রোহিতের। তার পরেও সুক্ষ্ম খোঁচায় ব্যাট দুলিয়ে বিদায় নেওয়াই তাঁর টেস্ট ব্যাটিংয়ের সেরা বিজ্ঞাপন। এর পরেও তাঁকে টানা হবে? একটা অমিত মিশ্র যা পারেন, মুম্বইকরের তথাকথিত ‘চরম প্রতিভাবানের’ থেকে সেটাও আশা করা যায় না। পূজারাকে টানার দরকার নেই। লড়ুয়ে হাফসেঞ্চুরিতে অমিতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রানকারীর মুকুটই রোহিতদের অবদানের শ্রেষ্ঠ অপমান।
আর পূজারা? ৬২-৩, ১১৯-৪, ১১৯-৫, ১৮০-৭-এর বিপর্যয়ের ধ্বংসস্তুপের মধ্যে তাঁর ২৭৭ বলের সেঞ্চুরিতে প্রতিপক্ষ অধিনায়ককেও বিমুগ্ধ দেখিয়েছে। যিনি এক সময় পাঁচ ওভারে কোনও রান নেননি, তিনিই পরে থারিন্ডু কৌশলকে টানা তিনটে বাউন্ডারি মেরেছেন। বিকেলে প্রসাদ-প্রহারও বাকি থাকেনি। বোলারকে ক্লান্ত করে শেষে বিদ্ধ করেছেন। মিশ্রর সঙ্গে সেঞ্চুরি পার্টনারশিপে টিমকে এখনই পৌঁছে দিয়েছেন এমন স্কোরে, যার সঙ্গে আরও গোটা তিরিশেক যোগ হলে নিশ্চিন্ত বিমা সম্ভব। অথচ তাঁর শেষ টেস্ট ছিল গত বছরের মেলবোর্নে। যেখানে তিনের জায়গায় জুটেছিল অধঃপতনের ছ’নম্বর। পরবর্তী আট মাসে ডাক পড়েনি, বিজয়দের চোট-আঘাত না ঘটলে অস্বাচ্ছন্দ্যের ওপেনিংটাও কপালে জুটত না। আর এ দিন এমন খেললেন যে এর পর তাঁকে বসানোটা দুঃসাধ্য।
চেতেশ্বর পূজারা কখনও নেভিল কার্ডাস পড়েছেন কি না, জানা নেই। কিন্তু তাঁর এক অমোঘ মন্তব্যকে এ দিনের ইনিংস দিয়ে তিনি অমরত্ব দিয়ে গেলেন।
ইট ইজ ফার মোর দ্যান আ গেম, দিস ক্রিকেট!
স্কোর বোর্ড
ভারত
প্রথম ইনিংস ২৯২-৮
পূজারা ন.আ. ১৩৫
কোহলি ক পেরেরা বো ম্যাথেউজ ১৮
রোহিত ক থরঙ্গা বো প্রসাদ ২৬
বিনি এলবিডব্লিউ প্রসাদ ০
নমন ক থরঙ্গা বো কৌশল ২১
অশ্বিন ক পেরেরা বো প্রসাদ ৫
মিশ্র স্টাঃ পেরেরা বো হেরাথ ৫৯
ইশান্ত ন.আ. ২
অতিরিক্ত ১৬
মোট ২৯২-৮
পতন: ২, ১৪, ৬৪, ১১৯, ১১৯, ১৭৩, ১৮০, ২৮৪
বোলিং: প্রসাদ ২৩.৩-৪-৮৩-৪, প্রদীপ ২২-৬-৫২-১, ম্যাথেউজ ১৩-৬-২৪-১, হেরাথ ২৫-৩-৮১-১, কৌশল ১২-২-৪৫-১।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy