ছবি: শঙ্কর নাগ দাস।
কলকাতা মানে তাঁর কাছে পুরনো বন্ধুদের আড্ডা।
কলকাতা মানে তাঁর কাছে পার্ক স্ট্রিটের রোল।
কলকাতা মানে তাঁর কাছে দুর্গা পুজোর জাঁকজমক।
কলকাতা মানে তাঁর কাছে মিষ্টি দই আর সন্দেশ।
কলকাতা মানে তাঁর কাছে নিজের শহর।
জন্ম ভুবনেশ্বরে। কর্মভূমি এত দিন ছিল হায়দরাবাদ। আইপিএল খেলেন মুম্বই ইন্ডিয়ান্স জার্সিতে। বর্তমান রঞ্জি টিমের নাম বাংলা। দেশের এতগুলো কোণের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাঁর নাম। কিন্তু তিনি এখন নিজেকে কলকাতার নাগরিক ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারছেন না। তাঁর বাংলায় আসা নিয়ে যে কারও কারও ঘোর আপত্তি ছিল এবং রয়েছে, ভালই জানেন। কিন্তু সেটাকে বাড়তি মোটিভেশন হিসেবে দেখেন। মনে করেন তার জন্য কলকাতার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক তিক্ত হয়নি, হবেও না।
টিমকে মরসুমের প্রথম ছ’পয়েন্ট এনে দেওয়ার পরের দিন সে রকমই বলছেন প্রজ্ঞান ওঝা। ‘‘কলকাতার সঙ্গে আমার সম্পর্ক আজকের নয়। ছোটবেলা থেকে এখানে প্রচুর ক্রিকেট খেলেছি। দেশের হয়ে টেস্ট খেলেছি ইডেনে। আইপিএল খেলেছি। এখানে আমার প্রচুর বন্ধু রয়েছে। মনোজ, দিন্দা, ঋদ্ধি, লক্ষ্মী— এদের কি আজ থেকে চিনি?’’ বলে যান প্রজ্ঞান। সঙ্গে যোগ করেন, ‘‘হ্যাঁ, অন্য রাজ্য থেকে এসেছি বলে কেউ কেউ আপত্তি করবে জানি। কিন্তু সেটা আমার কাছে বাড়তি মোটিভেশন, ভাল খেলার বাড়তি চ্যালেঞ্জ।’’
আগে ছিলেন সাময়িক অতিথি। এখন এই শহরের প্রায় পাকাপাকি বাসিন্দা। বিদর্ভ-বধ উত্তর প্রজ্ঞান তো আরও বেশি করে কলকাতার একান্ত নিজস্ব। শহরটার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কও এখন আরও গভীর, আরও গাঢ়। এক দিনের জন্য বাড়ি ফিরলে সঙ্গে থাকে এক টুকরো কলকাতাও। বৃহস্পতিবার পুণে-যাত্রা। তার আগে এক দিনের ছুটি নিয়ে বুধবার ভোরে উড়ে গিয়েছেন হায়দরাবাদ। পরিবারের সঙ্গে দিওয়ালি কাটাতে। চার পাশে আতসবাজির আওয়াজের মধ্যে এ দিন সন্ধেয় ফোনে তিনি বলছিলেন, ‘‘আজ ছুটিটা পেয়ে দারুণ হল। পরিবারের সঙ্গে একটু সময় কাটাতে পারলাম। রাতে কয়েক জন বন্ধুকে ছোট একটা পার্টিতে ডেকেছি।’’
পরক্ষণেই বলতে শুরু করেন, ‘‘হায়দরাবাদে অনেক বছর ধরে আছি ঠিকই। কিন্তু আপনাদের শহরের সঙ্গে অন্য রকম সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছে। নিজেকে এতটা উপভোগ অন্য কোথাও করিনি। কলকাতাকে কেন সিটি অব জয় বলে, এই ক’টা মাসেই বুঝে গিয়েছি। এখানে যে এত দিন থাকছি, এক দিনের জন্যেও মনে হয়নি আমি অন্য রাজ্যের ছেলে। মনে হয়েছে আমি কলকাতারই এক জন।’’
এই শহরের সঙ্গে তাঁর একাত্মতার একটা বড় কারণ, কলকাতার খাবার। পার্ক স্ট্রিট প্রজ্ঞানের ভীষণ পছন্দের ঠিকানা। ফাস্ট ফুড বা ঐতিহ্যশালী রেস্তোরাঁ, ইটিং-আউট মানেই তাঁর কাছে পার্ক স্ট্রিট। স্ত্রী শহরে এলে কখনও মনোজ তিওয়ারি তো কখনও অশোক দিন্দা— কারও না কারও বাড়িতে নেমন্তন্ন আসবেই। কখনও তিনজন সস্ত্রীক বেরিয়ে পড়েন বাইরে খেতে। আর লাঞ্চ হোক বা ডিনার, কলকাতার মিষ্টি ছাড়া চলে না প্রজ্ঞানের। এই ফ্যান ক্লাবে রয়েছেন তাঁর স্ত্রী করবীও। ‘‘ও এখানে এলেই আমরা বেরিয়ে পড়ি। যত পারি মিষ্টি কিনি। বাড়িতে পাঠাই, নিজেরা খাই,’’ বলছিলেন প্রজ্ঞান। ম্যাচের দিন লাঞ্চে আর কিছু খান না খান, মিষ্টি দই আর সন্দেশটা খাবেনই।
ম্যাচ প্রস্তুতির চাপ কাটান প্রচুর সিনেমা দেখে। হালকা সিনেমা পছন্দ করেন, যাতে মনটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া যায়। পরের দিন প্র্যাকটিসে নামেন বাড়তি উৎসাহ নিয়ে। হোটেল ঘরে বসে নয়, এই ক’মাসে রীতিমতো সিনেমা হলে গিয়ে বেশ কয়েকটা ফিল্ম দেখে ফেলেছেন।
এখনও যেটা দেখা হয়নি আর যেটা দেখার ইচ্ছে ছোটবেলা থেকে, সেটা কলকাতার দুর্গা পুজো। এ বার পুজোটা কেটেছে দিল্লিতে ম্যাচ খেলে। সেই আফসোসের কথা যখন বলেন, পুজোয় পরবাসের আদ্যন্ত বাঙালি হাহাকার লেগে থাকে তাঁর গলায়। ‘‘এ বার পুজোটা মিস করে গেলাম। ছোটবেলা থেকে শুনেছি কলকাতায় দুর্গা পুজোর কথা। পুজো শুরুর পাঁচ-ছ’দিন আগেই যা ধুমধাম দেখে গেলাম, বুঝতে পারছি আসল ব্যাপারটা শুরু হলে কী হতে পারে!’’
পরের বছর শহরের দুর্গা পুজো দেখতে চান প্রজ্ঞান। আর তার অনেক আগে বাংলাটা শিখে ফেলতে চান। ড্রেসিংরুমেই চলছে তাঁর বাংলা ক্লাস। বেশির ভাগ সতীর্থ তাঁর সঙ্গে বাংলায় কথা বলেন, যাতে ভাষাটার সঙ্গে তাড়াতাড়ি মানিয়ে নিতে পারেন। মাঠে বিপক্ষকে বুঝতে না দিয়ে তাঁর সঙ্গে স্ট্র্যাটেজি ঠিক করা যায়। কেমন আছ, ভাল আছির আগে তাই প্রজ্ঞান শিখে গিয়েছেন ‘আস্তে বল করো’, ‘ফিল্ডার কোথায় রাখব’ জাতীয় কথা।
বিদর্ভ ম্যাচের দুর্দান্ত পারফরম্যান্স, ‘চাকার’ তকমা ছুড়ে ফেলে অভাবনীয় প্রত্যাবর্তন প্রসঙ্গে উঠে আসে দুটো নাম। ভিভিএস লক্ষ্মণ তাঁর বহুকালের পথপ্রদর্শক, বড় ভাইয়ের মতো। কিন্তু ‘দাদা’ বলতে একজনকেই বোঝেন। যাঁর প্রতি প্রজ্ঞানের শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতার কথা শুনলে মনে হবে, এ তো গোটা বাংলার স্লোগান।
সর্বোপরি, কলকাতা মানে প্রজ্ঞানের কাছে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy