Advertisement
০৬ নভেম্বর ২০২৪
ফিল্যান্ডারদের সামনে মাত্র ৪৩ ওভারে শেষ, কাঠগড়ায় ব্যাটিং

সুযোগ হাতছাড়া করে হার ভারতের

সবই বৃষ্টির মতো ঝরে পড়তে শুরু করেছে বিরাট কোহালির দলের উপর। কে বলবে, এই দলটার জনপ্রিয়তা কয়েক দিন আগেও বলিউড তারকাদের মতোই তুঙ্গে ছিল।

প্রোটিয়া পেসারদের সামনে ধরাশায়ী ভারতের তারকাখচিত ব্যাটিং লাইনআপ। ছবি: এএফপি।

প্রোটিয়া পেসারদের সামনে ধরাশায়ী ভারতের তারকাখচিত ব্যাটিং লাইনআপ। ছবি: এএফপি।

সুমিত ঘোষ
কেপ টাউন শেষ আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২০১৮ ০৩:৩৮
Share: Save:

টুইটারে ট্রোলিং শুরু হয়ে গিয়েছে। কেউ উপহাস করে লিখছেন, ‘দেশের পিচ আর শ্রীলঙ্কাকে মিস করছি’। কেউ লিখছেন, ডেল স্টেন-কে ছাড়াও পারল না। স্টেন থাকলে আরও কত কম রানে খতম হয়ে যেত, কে জানে!

হতাশা। আক্ষেপ। ক্ষোভ। নিন্দা!

সবই বৃষ্টির মতো ঝরে পড়তে শুরু করেছে বিরাট কোহালির দলের উপর। কে বলবে, এই দলটার জনপ্রিয়তা কয়েক দিন আগেও বলিউড তারকাদের মতোই তুঙ্গে ছিল। কে বলবে, কোহালির সঙ্গে তুলনা হচ্ছিল সর্বকালের সব কিংবদন্তিদের! কে বলবে, রোহিত শর্মা-কে দেশের মাটিতে ওয়ান ডে সিরিজ চলাকালীন ভালবাসায় ভরিয়ে দিচ্ছিল দেশের ক্রিকেট জনতা।

খেলোয়াড়ের জীবন! ফুলের অভ্যর্থনার পাশাপাশি কাঁটার আক্রমণের জন্যও তৈরি থাকতে হবে।

ক’দিন আগের সেই রোহিত ছিলেন ওয়ান ডে-তে ডাবল সেঞ্চুরির হ্যাটট্রিক করা অস্থায়ী অধিনায়ক। এই রোহিত দক্ষিণ আফ্রিকার কঠিন পরিবেশে টেস্ট খেলতে নেমে ১১ এবং ১০ রান করা ব্যাটসম্যান। যাঁকে আবার টিম ম্যানেজমেন্ট কি না খেলিয়েছে সহ-অধিনায়ক অজিঙ্ক রাহানে-কে বসিয়ে। রাহানে বিদেশের মাঠে পরীক্ষিত, সফল ব্যাটসম্যান। তাই ব্যর্থ হওয়ায় আরও বেশি করে রোহিতকে কথা শুনতে হচ্ছে।

আরও পড়ুন: ‘প্রথম দলে দরকার ছিল রাহানেকে’

সেই বিরাট ছিলেন দেশের মাঠে মহানায়ক। একের পর এক ম্যাচ জেতাচ্ছেন মোহময়ী দক্ষতায়। এখানে জেতাতে পারলেন না বলে প্রতিদ্বন্দ্বী স্টিভ স্মিথকে টেনে এনে উত্তেজিত ভাবে তুলনা শুরু হয়ে গিয়েছে।

নিউল্যান্ডসে প্রেস কনফারেন্স করতে যাওয়ার সময় যদিও এক খুদে ভক্ত বিরাটের দিকে দৌড়ে এল। নিরাপত্তারক্ষীরা আটকে দিচ্ছিল। ভারত অধিনায়ক ডেকে নিলেন। অটোগ্রাফ দিলেন, সেলফি তুলে দিলেন নিজে হাতে। খুদে ভক্ত জড়িয়ে ধরে থাকল কিছুক্ষণ। কঠিন দিনে এই উষ্ণতা নিশ্চয়ই উদ্বুদ্ধ করবে অধিনায়ককে।

ডেল স্টেন-এর অনুপস্থিতি বুঝতেই দিলেন না ফিল্যান্ডার, মর্কেল এবং রাবাডা।

সকালে মহম্মদ শামি, যশপ্রীত বুমরা-রা দুর্দান্ত ভাবে ম্যাচে ফেরালেন। দক্ষিণ আফ্রিকা শেষ মাত্র ১৩০ রানে। ২০৮ রানের টার্গেটকে এভারেস্ট মনে করার কোনও কারণই ছিল না। বরং মনে হচ্ছিল, কেপ টাউনের টেবল মাউন্টেনের মতোই ধরাছোঁয়ার মধ্যে। এখানকার টেবল মাউন্টেনে উঠতে গেলে যে কেব্‌ল কার রয়েছে, তাতে করেই উঠে পড়া যাবে। বড় কোনও অভিযান নয়। তার উপর ডেল স্টেন বল করতে পারবেন না। স্টেন চিড় ধরা গোড়ালি নিয়েই ব্যাট করতে নামলেন তুমুল হাততালির মধ্যে। কিন্তু জানাই ছিল, তাঁর পক্ষে কিছুতেই বল করা সম্ভব নয়। পা ঠিক করে ফেলতেই পারছেন না, কী ভাবে দৌড়ে আসবেন!

স্টেন নেই তো কী, ভার্নন ফিল্যান্ডার আছেন। আর আছে ভারতীয় ব্যাটিংয়ের সেই পুরনো থরহরিকম্প রোগ। রোহিতের মতোই প্রশ্ন উঠে পড়েছে শিখর ধবনের নির্বাচন নিয়ে। কে এল রাহুল অস্ট্রেলিয়ায় সেঞ্চুরি করেছেন। বিদেশের প্রাণবন্ত, বাউন্সি পিচে ফাস্ট বোলিং খেলার টেকনিক ধবনের চেয়ে ভাল। দুই ইনিংসেই তিনি আউট হলেন বাউন্সারে চোখ বন্ধ করে হুক করতে গিয়ে। টিম ম্যানেজমেন্টের যতই তাঁর প্রতি অনুরাগ থাকুক, দক্ষিণ আফ্রিকায় বাকি টেস্ট সিরিজে ধবনকে ব্যাট হাতে দেখা গেলে অবাক হতে হবে।

এই দক্ষিণ আফ্রিকাতেই ২০১১-র সফরে এসে সেঞ্চুরিয়নে প্রথম টেস্ট হেরে গিয়েছিল মহেন্দ্র সিংহ ধোনির ভারত। টেস্ট দলে তখন খেলানো হচ্ছে সুরেশ রায়না-কে। আর বাইরে বসে আছেন চেতেশ্বর পূজারা। দ্বিতীয় টেস্ট খেলতে ডারবানে পৌঁছল টিম। আর টিম হোটেলের লবিতে দাঁড়িয়ে এক সিনিয়র ক্রিকেটার বিরক্তি সহকারে বলে ফেললেন, ‘‘পূজারাকে খেলানো উচিত। রায়না কী করে আসে?’’ এই টিমে একতা আর সততার বুনোট যতই শক্তপোক্ত থাকুক, ভিতরে-ভিতরে প্রশ্ন উঠতে কতক্ষণ? যদি আড়ালে-আবডালে দলের সদস্যরা বলাবলি করতে থাকেন, রাহুল আর রাহানে-কে খেলানো উচিত, অবাক হওয়ার নেই।

টিম ম্যানেজমেন্টের মনে হয়েছিল, রোহিত ফর্মে আছেন। রাহানে রানের মধ্যে নেই। তাই ফর্মে থাকা ব্যাটসম্যানকেই খেলাই। কিন্তু বলে না, ক্রিকেট মহান অনিশ্চয়তার খেলা। কখন কার ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায়, কে বলতে পারে!

ধোনির সেই টিমই উদাহরণ হতে পারে বিরাট-বাহিনীর সামনে। সেঞ্চুরিয়নে হারার পরে ডারবানে জিতে সিরিজে ফিরে এসেছিল তারা। কিন্তু সে রকম কিছু ঘটাতে গেলে দলের প্রধান ব্যাটসম্যানদের দায়িত্ব নিতে হবে। ওপেনারের রান করতে হবে। পূজারাকে রান পেতে হবে। কোহালিকে শাসন করতে হবে। প্রথম ইনিংসে হার্দিক পাণ্ড্য এবং ভুবনেশ্বর কুমার দেখিয়েছেন, প্রতিকূল পরিবেশে দাঁড়িয়েও লড়াই করা যায়। দ্বিতীয় ইনিংসে সেটা দেখালেন অশ্বিন এবং ভুবনেশ্বর।

দক্ষিণ আফ্রিকা দ্বিতীয় ইনিংসে করেছিল ১৩০। ভারত শেষ হয়ে গেল ১৩৫ রানে। ম্যাচের দিকে ফিরে তাকিয়ে মনে হচ্ছে, দু’টো জায়গায় বড় তফাত হয়ে গেল দু’দলের মধ্যে। দক্ষিণ আফ্রিকার বোলাররা কোনও সহজ রান দেননি। গোটা ম্যাচে ভার্নন ফিল্যান্ডার-রা বাউন্ডারি দিয়েছেন ৪৮টি। সেখানে ভারতীয় বোলাররা প্রথম ইনিংসেই বাউন্ডারি দেন ৪১টি। কঠিন পিচ— যেখানে ব্যাটকে শাসন করছে বল, সেখানে বোলারদের এমন আলগা মনোভাব ম্যাচ থেকে ছিটকে দিতে পারে। নিউল্যান্ডসে ব্যাটিং করা যে সহজ ছিল না, সেটা তো সোমবার রৌদ্রজ্জ্বল আকাশের মতোই পরিষ্কার দেখাল। শুধু চতুর্থ দিনেই পড়ল ১৮টি উইকেট। দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে এটা নিজেদের দেশ। তারাও ১৩০ রানের বেশি তুলতে পারল না। কিন্তু প্রথম ইনিংসের আলগা রান তাদের দু’শোর উপর ‘লিড’ নিতে সাহায্য করল। সঙ্গে এ বি ডিভিলিয়ার্সের অনন্য প্রতিভা। খারাপ পিচেও দুই ইনিংসে তিনি করে গেলেন ৬৫ এবং ৩৫। কে বলবে, ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে এটা তাঁর দ্বিতীয় টেস্ট। দেখিয়ে দিলেন, কেন তাঁকে সব ফর্ম্যাটের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে মানে ক্রিকেট বিশ্ব। শুধু তা-ই নয়, প্রথম ইনিংসে ভারতের নায়ক হার্দিক পাণ্ড্য-র ক্যাচ ধরে যে ভাবে গর্জন করে তাঁকে ‘সেন্ড অফ’ দিলেন সচরাচর শান্ত স্বভাবের এ বি, মনে হচ্ছে, ভারতে গিয়ে ঘূর্ণিতে বিধ্বস্ত হওয়ার শোধ তোলারই লক্ষ্য স্থির করেছে দক্ষিণ আফ্রিকা টিম। অধিনায়ক ফ্যাফ ডুপ্লেসি যেটা বলে গিয়েছিলেন টেস্ট শুরুর আগে, ভারতের সঙ্গে হিসেব চোকানোর আছে তাঁদের।

শামি এবং যশপ্রীত বুমরা মিলে সোমবার সকালে প্রত্যাঘাত করলেন। সম্ভবত টিম থেকেও ইঙ্গিত পেয়েছিলেন তাঁরা যে, হয় পারফরম্যান্সে উন্নতি ঘটাও, না হলে ফল ভোগ করতে হতে পারে। কিন্তু শামিরা ঘুরে দাঁড়ালেও ম্যাচের ভাগ্য ঘুরল না। অনেক বেশি ধারাবাহিকতা দেখানো দক্ষিণ আফ্রিকার বোলাররাই বাজি জিতে বেরিয়ে গেলেন। ভার্নন ফিল্যান্ডার নতুন শিক্ষা হয়ে থাকলেন শামিদের জন্য। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেলেন, এক্সপ্রেস গতি না থাকলেও কী ভাবে মনঃসংযোগ করে বুদ্ধিদীপ্ত, নিয়ন্ত্রিত সুইং বোলিংয়ে টেস্ট ক্রিকেটে পার্থক্য গড়ে দেওয়া যায়। স্টেনের অনুপস্থিতিতে দ্বিতীয় ইনিংসে নিয়ে গেলেন ছয় উইকেট। আর ভারতীয় পেসারদের দারুণ বোলিং মানে হচ্ছে মেরেকেটে তিন বা চার উইকেট। পাঁচ উইকেট নিতেই জানেন না শামি-রা।

দুর্দান্ত ডেলিভারিতে কোহালির উইকেট তুলে নিয়ে ভারতের স্বপ্নভঙ্গও করলেন ফিল্যান্ডার। তার আগে পর্যন্ত খুব ইতিবাচক ব্যাটিং করছিলেন কোহালি। পিচ ক্রমশ খারাপ হচ্ছে বুঝতে পেরে রান তোলার দিকে নজর দিচ্ছিলেন। দারুণ এনার্জি দেখিয়ে খুচরো রান নিচ্ছিলেন, এক রানকে দুই করছিলেন। বাউন্ডারির বল পেলে ছাড়ছিলেন না। কিন্তু ফিল্যান্ডারের হাতে দু’টো সুইং-ই এত সুন্দর রয়েছে যে, প্রাণবন্ত পিচে তিনিই এই সিরিজে দক্ষিণ আফ্রিকার সবচেয়ে বিপজ্জনক বোলার হয়ে উঠতে পারেন। এখানেও আউটসুইং করাতে করাতে কোহালিকে বোকা বানালেন ক্ষিপ্র ইনসুইংয়ে। ডিআরএস নিয়েও রক্ষা পেলেন না ভারত অধিনায়ক।

কোহালি ২৮ রান করে ফিরে যেতেই দক্ষিণ আফ্রিকার গোটা দলের শরীরী ভাষাটাই বদলে গেল। কাগিসো রাবাডা ভয়ঙ্কর বাউন্সার দিলেন রোহিত শর্মাকে। মাথা বাঁচাতে গিয়ে কোনও রকমে খেলা পুল শট সহজ ক্যাচ হয়ে গেল কেশব মহারাজের কাছে। আর বাঁ হাতি স্পিনার সেটাই ফেলে দিলেন। রোহিত অবশ্য তাঁকে বেশি মন খারাপ করতে দেননি। কিছুক্ষণ পরেই ফিল্যান্ডারের বল স্টাম্পে টেনে এনে উইকেট উপহার দিয়ে গেলেন।

টেস্ট জেতা দক্ষিণ আফ্রিকা দল ছোটখাটো ভিকট্রি ল্যাপ দিল নিউল্যান্ডসের মাঠে। আর হাতের মধ্যে এসে যাওয়া টেস্ট জয় হাতছাড়া করার পাশাপাশি এই দৃশ্যটাও কোহালিদের গর্বে আঘাত করা উচিত। সিরিজের দুই টেস্ট বাকি থাকতে বিজয় মিছিল? এতেও যদি ঘুম না ভাঙে, বুঝতে হবে, নিউল্যান্ডসে স্বপ্নভঙ্গ হয়নি নতুন বছরে। স্বপ্ন দেখাটাই ভুল হয়েছিল!

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE