Advertisement
১৩ অক্টোবর ২০২৪

সিএবি-র গৃহযুদ্ধ এ বার প্রকাশ্যেই

এত দিন ছায়াযুদ্ধ চলছিল, আগুন জ্বলছিল ধিকিধিকি। কিন্তু এ বার সিএবি-র ‘গৃহযুদ্ধ’ চলে এলে প্রকাশ্যে। যখন তাতে জড়িয়ে গেলেন স্বয়ং সিএবি প্রেসিডেন্ট সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়! এক কথায়, শুক্রবার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দিলেন সিএবি প্রেসিডেন্ট। আকস্মিক সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে, নাম না করে কোনও কোনও সিএবি পদাধিকারীর বিরুদ্ধে বোমা নিক্ষেপ করে। চাঁচাছোলা ভাবে।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২০১৬ ০৩:৫৬
Share: Save:

এত দিন ছায়াযুদ্ধ চলছিল, আগুন জ্বলছিল ধিকিধিকি। কিন্তু এ বার সিএবি-র ‘গৃহযুদ্ধ’ চলে এলে প্রকাশ্যে। যখন তাতে জড়িয়ে গেলেন স্বয়ং সিএবি প্রেসিডেন্ট সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়!

এক কথায়, শুক্রবার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দিলেন সিএবি প্রেসিডেন্ট। আকস্মিক সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে, নাম না করে কোনও কোনও সিএবি পদাধিকারীর বিরুদ্ধে বোমা নিক্ষেপ করে। চাঁচাছোলা ভাবে।

উত্তেজিত সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় বলে দিলেন, গত পনেরো মাস নিজের নামে নানা কথা শুনেও তিনি কিছু বলেননি, কারণ নিজের সংস্থার লোকের বিরুদ্ধে মিডিয়ায় মুখ খোলা তাঁর রুচিবিরুদ্ধ। ক্ষুব্ধ সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় বলে দিলেন যে, দিনের পর দিন মিডিয়াকে মিথ্যে খবর দিয়ে গিয়েছেন সিএবির কেউ কেউ। তিতিবিরক্ত সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় বলে দিলেন, দেশের কোনও সংস্থায় এ জিনিস ঘটে বলে তাঁর জানা নেই। আর যাঁরা বলছেন, তাঁদের মুখে এত বড় বড় কথা মানায় না। আর আজ তাঁকে বলতে হচ্ছে কারণ তাঁর মনে হচ্ছে, নিজের দিকটাও জনসমক্ষে পরিষ্কার করা উচিত!

কোথাও নাম নেই। কিন্তু নাম সহজেই আন্দাজ করা যায়। তিনি— সিএবি কোষাধ্যক্ষ বিশ্বরূপ দে।

সিএবি যুগ্ম সচিব পদে সৌরভ বসার পর থেকেই দু’জনের ‘সুসম্পর্ক’ দিন-দিন বেড়েছে। সৌরভ সিএবি প্রেসিডেন্ট পদে আসার পর তো আরওই। কিন্তু এত দিন যা চলত, চলত আড়ালে-আবডালে। প্রকাশ্যে দু’পক্ষের লেগে যাওয়া কখনও ঘটেনি। শুক্রবার লাগল। পুরো ব্যাপারটা হয়ে গেল খুল্লমখুল্লা।

এ দিন আচমকাই ঘোষণা করা হয়, সন্ধেয় সাংবাদিক সম্মেলন ডাকছেন সিএবি প্রেসিডেন্ট। কিন্তু সেখানে যে এত বড় বড় সব বোমা নিক্ষেপ হবে, ন্যূনতম আন্দাজ পায়নি মিডিয়া। তিনটে ব্যাপার টেনে আনেন সৌরভ। গুলাম আলির অনুষ্ঠান বিতর্ক। ইডেনের নেমিং রাইটসের টেন্ডার। আর অ্যাম্বুশ মার্কেটিং। যে তিনটে ব্যাপার নিয়ে সাম্প্রতিকে টানাপোড়েন চলছিল সিএবিতে। তবে আসলটা— অবশ্যই ইডেনে গুলাম আলির অনুষ্ঠান ঘিরে ঘটে যাওয়া বিতর্ক। যা দিনভর নাটকের পর বৃহস্পতিবার ইডেনে বাতিল হয়ে যায় ঠিকই, কিন্তু একাধিক প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। বিশেষ করে বলা হতে থাকে, ওয়ার্কিং কমিটি বৈঠকে কেন এত বড় একটা ব্যাপার জানানো হল না? ইডেনে জলসার অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত কী করে নেওয়া হতে পারে?

সৌরভ উত্তরটা এ দিন দিলেন। বললেন, তিনি কোনও অনুমতিই দেননি। ‘‘আপনারা তো ছিলেন ওয়ার্কিং কমিটি বৈঠকের দিন। ডিসি সাউথ মুরলীধরকে নিশ্চয়ই দেখেছেন। উনি পরশু রাতে ব্যাপারটা যখন আমাকে বলেন, ততক্ষণে ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক শেষ হয়ে গিয়েছিল। আমি বলি, জানাব। গত কাল সকালে মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমকে বলি, ইডেনে অনুষ্ঠান সম্ভব নয়। বিশ্বকাপ ইন্সপেকশন আছে। মাঠে এত লোক বসবে। কিছু হয়ে গেলে তখন? ম্যাচ চলে গেলে তো সর্বনাশ হয়ে যাবে। পরে মুখ্যমন্ত্রীর অফিসেও জানাই। এটাই আসল ঘটনা,’’ উত্তেজিত ভাবে বলতে থাকেন সৌরভ। সঙ্গে যোগ করেন, ‘‘আমি যখন গুলাম আলির অনুষ্ঠান নিয়ে অনুমতিই দিইনি, তা হলে কেন সেটা ওয়ার্কিং কমিটি বৈঠকে তুলতে যাব? প্রয়োজন তো নেই।’’ এবং এটা শুধু মুখবন্ধ মাত্র, আসল বিস্ফোরণ শুরু হল এর পর পর।

‘‘মিডিয়াকে ভুল খবর খাওয়ানো হয় সিএবিতে। তার অবশ্যই কিছু কারণ আছে। কিন্তু আমার ফোনটাও খোলা থাকে। মিডিয়াকে অনুরোধ করছি, আমাকে একবার ফোন করে নেবেন।’’

‘‘স্টেডিয়ামের নেমিং রাইটস, অ্যাম্বুশ মার্কেটিং নিয়ে প্রচুর কথা শুনেছি। এখানেও আবার মিডিয়াকে ভুল জিনিস বলা হয়েছে। অ্যাম্বুশ মার্কেটিং আমি যথেষ্ট ভাল বুঝি। কোথাও সে সব হচ্ছে না।’’

‘‘আজ পর্যন্ত সিএবিতে কখনও টেন্ডার ডাকা হয়নি। আর নেমিং রাইটসের জন্য যা ডাকা হচ্ছে তা রেস্ট্রিক্টে়ড টেন্ডার।’’

‘‘পনেরো বছরের মধ্যে এ বারই প্রথম স্পনসরশিপ থেকে এত টাকা আসছে সিএবিতে। আর যা আসছে, তা সিএবির কাজেই লাগছে।’’

‘‘আমি যদি বলতে বসি, তা হলে গোটা দিন ধরে প্রেস কনফারেন্স চালাতে হবে। আমি বলেছি যাতে এ জিনিস আর না হয়। এ বার যার যার অভিরুচি।’’

‘‘আমি যদি বলি, যে কর্তা এত কথা বলছেন, তিনি পদে থাকার সময় ২০১১ বিশ্বকাপ বিশ্বকাপের ম্যাচ চলে গিয়েছিল সেটা কি ভাল শোনাবে?’’

‘‘আমি সে সময় সিএবিতে ছিলাম না। কিন্তু তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মিস্টার ডালমিয়াকে নিয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে পর্যন্ত গিয়েছিলাম। তাই আজ যাঁরা এত বড় বড় কথা বলছেন, সে সব তাঁদের মুখে মানায় না।’’

বোমার মুখে থাকা সংশ্লিষ্ট কর্তা কে, মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।

সাংবাদিক সম্মেলন যত এগিয়েছে, তত তার মেজাজ চড়া হয়েছে। কিন্তু তার পরেও যে বিতর্কের লাভাস্রোত বন্ধ হল, এমন নয়। বরং রাতের সঙ্গে সেটাও বাড়ল। যখন প্রায় গোটা সিএবি ব্যাপারটায় ঢুকে পড়ল।

যাঁকে ঘুরিয়ে এত কিছু বলা সেই বিশ্বরূপ দে রাতে গুলাম আলি বিতর্ক নিয়ে প্রেসিডেন্টের মন্তব্য শোনার পর বলে দিলেন, ‘‘আমি খুব অবাক হয়ে যাচ্ছি যে বিনা অনুমতিতে তা হলে সিএবিতে ডেকরেটর, পুলিশ গত কাল ঢুকে পড়ল কী ভাবে? এক জন সাংসদও তো টুইট করেছেন।’’ সঙ্গে আরও শ্লেষাত্মক সংযোজন, ‘‘আমি শুনলাম বিশ্বকাপের ম্যাচ ফিরে পেতে ডালমিয়াকে নাকি দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আমি যতদূর জানি, দেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিশ্বকাপের কোনও সম্পর্ক থাকে না। তা হলে তো ধরে নিতে হয়, ইডেনের এ বার কাপ ফাইনাল পাওয়ার পিছনেও নরেন্দ্র মোদীর হাত আছে!’’ কিন্তু এ ভাবে সংস্থায় দু’পক্ষে লেগে যাওয়া কি সংস্থার পক্ষে ভাল বিজ্ঞাপন? প্রেসিডেন্ট তো বললেন, এ জিনিস কোথাও দেখেননি। এ বার বিশ্বরূপের জবাব, ‘‘অবাঞ্ছনীয় বলা যায়। কিন্তু ঘটেনি তা নয়। কর্নাটক ক্রিকেট সংস্থায় অনিল কুম্বলকে হারতে হয়েছে। বরোদায় দু’টো গোষ্ঠীর ঝামেলা বোর্ডকে মেটাতে হয়েছে। আর এখানে এনসিসিতে কী হচ্ছে, সবাই দেখতেই পাচ্ছেন।’’ এবং শুধু বিশ্বরূপ নন। সিএবির যুগ্ম সচিব সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় সব শুনে বললেন, ‘‘আমি জানি না প্রেসিডেন্ট কাকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলেছেন। যদি আমাকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়, আমাকে সরাসরি বলা হোক। উত্তর দিয়ে দেব।’’ সঙ্গে তাঁর সংযোজন, ‘‘আমি টেন্ডার ডাকতে বলেছিলাম কারণ ইডেনের স্বচ্ছ্বতার প্রশ্ন এখানে। আর গুলাম আলির ব্যাপারটা জানতাম না। জানার পর প্রেসিডেন্টকে বলি, সামনেই বিশ্বকাপ। এখন অনুষ্ঠানের অনুমতি দিলে ম্যাচ চলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে।’’

বর্তমান পদাধিকারীতেই শেষ নয়, প্রাক্তনরাও ঢুকলেন পরে। সিএবির বর্ষীয়ান দুই সদস্য তথা প্রাক্তন যুগ্ম সচিব গৌতম দাশগুপ্ত ও চিত্রক মিত্র। গৌতম বললেন, প্রেসিডেন্ট হিসেবে যখন একজনকে বাছা হয়েছে তখন তার উপর বিশ্বাসটাও দেখানো উচিত। ‘‘সংস্থার ভাল বিজ্ঞাপন এতে হচ্ছে না। সৌরভ এত দিন সহ্য করেছিল। আজ আর পারেনি হয়তো।’’ চিত্রকের বক্তব্য, ‘‘সিএবিতে এ রকম খোলাখুলি দোষারোপ আর পাল্টা অভিযোগ গত পঁয়ত্রিশ বছরে দেখেছি বলে মনে করতে পারছি না। আজ জগমোহন ডালমিয়ার কথা খুব মনে হচ্ছে। উনি বেঁচে থাকলে দুঃস্বপ্নেও এ জিনিস ঘটত না।’’ গৌতম বললেন সৌরভের পক্ষে। কিন্তু চিত্রক— তিনি কি বললেন সৌরভের পক্ষে? কে জানে। আবার গত ওয়ার্কিং কমিটিতে লক্ষ্মীরতন শুক্ল নিয়ে প্রশ্ন তোলা মোহনবাগান সহ সচিব সৃঞ্জয় বসু বললেন, ‘‘এতে বোঝা গেল, সিএবিতে এখন খেয়োখেয়ি চলছে। এ সব না কমলে বাংলা ক্রিকেটে এঁরা কতটা মাথা দিতে পারবেন, বোঝা যাচ্ছে না।’’

কেউ কেউ বলছিলেন, এটা হওয়ারই ছিল। সৌরভের বিস্ফোরণ আসারই ছিল। আগেই ঘটত, বলেটলে আটকে রাখা হয়েছিল। এটাও শোনা গেল, সাংবাদিক সম্মেলনের আগে এক বৈঠকে সিএবি প্রেসিডেন্ট কোষাধ্যক্ষকে জিজ্ঞেসও করেন, কেন মিডিয়ায় এ সব ভুল ভাবে বলা হচ্ছে? তিনি তো গুলাম আলির অনুষ্ঠান নিয়ে কোনও অনুমতিই দেননি। বৈঠকে উপস্থিত কেউ কেউ বললেন, বিশ্বরূপ শুনে নাকি বলে দেন ও সব তিনি বলেননি। পরে জিজ্ঞেস করায় বললেন, ‘‘গুলাম আলির ব্যাপারটা নিয়ে আগে যা বললাম, বৈঠকেও তাই বলেছি। আর বাকি সব কি আমি একা বলেছি?’’

কী দাঁড়াল?

প্রকাশ্যে গৃহযুদ্ধ এর পর নিয়ম হবে কি না, সময় বলবে। শুধু একটা ব্যাপার কেউ কেউ বললেন। শুক্রবারের সৌরভ-বিস্ফোরণ শুধু শুষ্ক বিস্ফোরণ নয়। আদতে আগামী জুলাইয়ের সিএবি নির্বাচনের দামামা এতে বেজে গেল!

ক্ষিপ্ত সৌরভের সব ছবি তুলেছেন উৎপল সরকার

অন্য বিষয়গুলি:

MostReadStories
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE