শনিবার রাতে স্তাদ দ্য ফ্রাঁসে ইতিহাস গড়লেন জুলিয়েন আলফ্রেড। ছবি: রয়টার্স।
ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের ছোট্ট একটি দেশ। জনসংখ্যা মাত্র এক লক্ষ ৮০ হাজার। অতীতে কোনও দিন অলিম্পিক্সে তারা পদকই জেতেনি। সেই সেন্ট লুসিয়া একেবারে সোনা জিতল প্যারিস অলিম্পিক্সে এসে। সেই কাজ করলেন যিনি, তাঁকে কয়েক মাস আগেও কেউ চিনতেন কি না সন্দেহ। শনিবার রাতে স্তাদ দ্য ফ্রাঁসে ইতিহাস গড়লেন জুলিয়েন আলফ্রেড। এমন একটা দিনে তিনি নজির গড়লেন যে দিন জামাইকার কেউ তাঁকে চ্যালেঞ্জ জানানোর ছিলেন না। যাঁকে সোনার দাবিদার ধরা হচ্ছিল, সেই শাকারি রিচার্ডসনও টক্কর দিতে পারলেন না। হিটে সবার আগে শেষ করেছিলেন। ফাইনালেও সবার আগে শেষ করে ইতিহাস তৈরি করলেন জুলিয়েন।
ইনস্টাগ্রামে তাঁর পরিচিতি দেখতে গেলে তিনটি লাইন পাওয়া যাবে। প্রথমে লেখা ‘অ্যাথলিট’, অর্থাৎ ক্রীড়াবিদ। দ্বিতীয় লাইনে সেন্ট লুসিয়ার পতাকা। তৃতীয় লাইনে লেখা ‘রোমান্স ৮.১৮’। এটি বাইবেলের একটি শ্লোক, যার সারমর্ম, তুমি আগামী দিনে যে সাফল্য পেতে চলেছ তার সঙ্গে এখনকার কষ্টের কোনও মিল নেই।
২২ বছরের জীবনে কষ্ট প্রচুর দেখেছেন জুলিয়েন । অবশেষে সাফল্যের মুখ। তা-ও আবার অলিম্পিক্সের মতো বড় মঞ্চে। ১২ বছর বয়সে তিনি হারিয়েছিলেন বাবাকে। দু’বছর পর বাড়ি ছেড়ে জামাইকা চলে যান। গত বছরের ডিসেম্বরে নিজের শারীরশিক্ষার শিক্ষক সাইমন স্টিফেনকে হারান, যিনি প্রথম জুলিয়ানের মধ্যে প্রতিভা দেখতে পেয়ে তাঁকে স্প্রিন্টে আসার পরামর্শ দিয়েছিলেন।
অবশেষে সাফল্য।
আমেরিকার জাতীয় কলেজিয়েট প্রতিযোগিতায় ইন্ডোরে ৬০ এবং ২০০ মিটারে গত বারের বিজয়ী তিনি। আউটডোরে ১০০ মিটারে এবং ২০০ মিটারে চ্যাম্পিয়ন। কলেজিয়েট প্রতিযোগিতার সেরা খেলোয়াড়কে যে ‘বাওয়াম্যান পুরস্কার’ দেওয়া হয়, তা জিতেছেন ২০২৩ সালে। ৬০ মিটার এবং ২০০ মিটারে এ বছর দ্রুততম মহিলা দৌড়বিদ তিনি।
ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের সেন্ট লুসিয়ায় জনসংখ্যা দু’লাখেরও কম। সে রকম একটি দেশ থেকে উঠে এসেছেন জুলিয়েন। তিনি যেটাই করছেন সেটাই সেই দেশের প্রথম খেলোয়াড় হিসাবে ইতিহাস। জুলিয়েনও যেন ইতিহাস তৈরি করার খেলায় নেমেছেন।
পাঁচ বছর আগে যুব অলিম্পিক্সের সময়টা ভুলতে পারেন না জুলিয়েন। ওই একটা প্রতিযোগিতা তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। ১০০ মিটারে রুপো পেলেও আন্তর্জাতিক মঞ্চে দেশের প্রতিনিধিত্ব কতটা বড় হতে পারে, সেটা বুঝতে পেরেছিলেন। আরও বড় স্বপ্ন দেখার ইচ্ছা শুরু হয়েছিল সেখান থেকেই। অলিম্পিক্সের ওয়েবসাইটে জুলিয়েন বলেছিলেন, “একটা দারুণ কিছু যে শুরু হতে চলেছে, সেটা তখনই বুঝতে পেরেছিলাম। আমেরিকার কলেজে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছাটা তখন থেকেই শুরু হয়।”
বুয়েনোস আইরেসের ওই প্রতিযোগিতার পরেই আলফ্রেড টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। যুব অলিম্পিক্সে খেলার সময়েই পরিচয় হয় এডরিক ফ্লোরিয়ালের সঙ্গে। তাঁর ইচ্ছেতেই টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি এবং জীবনের মোড় ঘুরে যাওয়ার শুরু। সেই কোচের সম্পর্কে জুলিয়েন বলেছেন, “উনি আমার বাবা, পরামর্শদাতা এবং কোচ। এই পর্যায়ে খেলতে গেলে কখনও-সখনও প্রচণ্ড চাপের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। উনি আমার জন্য যা করেছেন তার কোনও তুলনা নেই। শুধু মাত্র কোচ হিসাবে নিজের দায়িত্ব সারা নয়, মানুষ হিসাবেও আমাকে অন্য ভাবে গড়ে তুলতে সাহায্য করেছেন। আমাকে শুধু একজন ক্রীড়াবিদ নয়, একজন মানুষ হিসাবে দেখেছেন। আজ আমি যে জায়গায় পৌঁছেছি, যে মানসিক শক্তি তৈরি হয়েছে, সব ওঁর জন্যই।”
সেন্ট লুসিয়ার রাজধানী ক্যাস্ট্রিসে বড় হয়েছেন জুলিয়েন। ছয় বা সাত বছর বয়সে তাঁর প্রতিভা প্রথম প্রকাশ্যে আসে। স্কুলে দৌড়নোর সময় তা চোখে পড়ে ছোটবেলার কোচ স্টিফেনের। তিনি জুলিয়ানকে ছেলেদের সঙ্গে দৌড়তে বলেন। জিতেও যান জুলিয়েন। এর পর স্থানীয় অ্যাথলেটিক্স ক্লাবে যোগ দেন জুলিয়ান। অনুশীলন শুরু করেন সেখানকার কোচ কাথবার্ট মোডেস্টের সঙ্গে। ছোটবেলা থেকেই উসাইন বোল্টকে আদর্শ হিসাবে মেনেছেন জুলিয়েন। ট্র্যাকে নেমে এক দিন বোল্টের মতোই সোনা জেতার স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেই স্বপ্ন সত্যি হয়েছে শনিবার।
অথচ তা হওয়ার কথা ছিল। বাবার মৃত্যুর পর অ্যাথলেটিক্স ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি। আর না খেলার পণ করেছিলেন। কিন্তু স্টিফেনই তাঁকে ট্র্যাকে ফিরিয়ে আনেন। ২০১৫ সালে জামাইকায় সেন্ট ক্যাথারিন হাইস্কুলে ভর্তি হন। সেখানে কোচ মার্লন জোন্সের অধীনে প্রশিক্ষণ নেন কয়েক বছর। এর পর টেক্সাসে যান। সব ঠিক থাকলে টোকিয়ো অলিম্পিক্সেও তাঁর নামার কথা ছিল। কিন্তু একটি চোট সেই স্বপ্ন শেষ করে দেয়।
গত বছর বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে সোনা জেতার লক্ষ্যে নেমেছিলেন জুলিয়েন। তা সফল হয়নি। ১০০ মিটারে পঞ্চম এবং ২০০ মিটারে চতুর্থ হন। কিন্তু এনসিএএ ইন্ডোর প্রতিযোগিতায় ৬০ এবং ২০০ মিটারে জিতে শিরোনামে চলে আসেন। তার পর থেকে শুধুই উন্নতি।
শনিবারের আগে অলিম্পিক্সে সেন্ট লুসিয়ার কোনও পদক না পাওয়ার বিষয়টি জানতেন জুলিয়েন। সেই নিয়ে মাথার মধ্যে হালকা হলেও একটা চাপ ছিল। যদিও খুব বেশি পাত্তা দেননি। অলিম্পিক্সে আসার আগে জুলিয়েন বলেছিলেন, “সংবাদমাধ্যমে কী লেখা হচ্ছে তা নিয়ে আমি ভাবি না। তবে দেশের অনেক মানুষ আমার পরিবারকে শুভেচ্ছাবার্তা দেয়। পরিবারের থেকে সেগুলো জানতে পারেননি। প্যারিসে আমি অন্তত একটা পদক জিততেই চাই। সেটা সোনা বা রুপো যা-ই হোক না কেন।”
কে জানত শনিবারের রাতটা তাঁর নামেই লেখা হতে চলেছে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy