Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪

দুই ‘মঙ্কের’ সাধনায় খুলছে টেস্ট জয়ের দরজা

ইংলিশ সামার: টেস্ট পাঁচ। সেঞ্চুরি এক। হাফসেঞ্চুরি দুই। নব্বইয়ের ঘরে একটা। ডাউন আন্ডার: টেস্ট চার। সেঞ্চুরি এক। হাফসেঞ্চুরি চার। নব্বইয়ের ঘরে একটা। বাংলাদেশ মনসুন: টেস্ট এক। ইনিংস এখনও পর্যন্ত এক। সেঞ্চুরি এক। তবে বড়। দেড়শো।

জুটিতে লুটি। ফতুল্লায় রাহানে-মুরলী। শুক্রবার। ছবি: এএফপি।

জুটিতে লুটি। ফতুল্লায় রাহানে-মুরলী। শুক্রবার। ছবি: এএফপি।

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়
ফতুল্লা শেষ আপডেট: ১৩ জুন ২০১৫ ০৩:৩১
Share: Save:

ইংলিশ সামার: টেস্ট পাঁচ। সেঞ্চুরি এক। হাফসেঞ্চুরি দুই। নব্বইয়ের ঘরে একটা।

ডাউন আন্ডার: টেস্ট চার। সেঞ্চুরি এক। হাফসেঞ্চুরি চার। নব্বইয়ের ঘরে একটা।

বাংলাদেশ মনসুন: টেস্ট এক। ইনিংস এখনও পর্যন্ত এক। সেঞ্চুরি এক। তবে বড়। দেড়শো।

স্ট্যাটসবুকের দিকে তাকালে মুরলী বিজয়ের আজ ঠিক কী মনে হয়, জানার উপায় নেই। ভাল লাগে নিশ্চয়ই। কে জানে, সঙ্গে বোধহয় একটু খারাপও লাগে। ক্রিকেট-জীবনের প্রথম ভাগে ঠিক করে ফেলেছিলেন টি-টোয়েন্টি আর ওয়ান ডে-টা চুটিয়ে খেলবেন। খেলতেনও। কিন্তু দেশের জার্সিতে সে ভাবে ও দু’টোয় ডাক আসত না, ছুটতেন ব্যাটিং-গুরুর কাছে। বলতেন, হচ্ছে না কেন? গুরু বোঝাতেন, হবে না। এ দু’টো তো তোমার জায়গাই নয়। তোমার পৃথিবী টেস্ট। ওটায় হবে।

শুক্রবার সন্ধেয় চেন্নাই থেকে ফোনে ডব্লিউ ভি রামন বলছিলেন, “কতটা চাপ ভেবে দেখুন। বাকিরা বছরে অন্তত গোটা পঞ্চাশেক ওয়ান ডে খেলছে। পাঁচটায় ফেল করলে, পরের পাঁচটায় তুলে দিচ্ছে। ওর হাতে সুযোগই সেখানে বছরে পাঁচটা!” বলে রাখা ভাল, বিজয়ের ব্যাটিং-গুরু ইনি। দাবি সত্যি হলে, যিনি দাক্ষিণাত্য ওপেনারকে ‘গড়েপিঠে’ টেস্ট ক্রিকেটে পাঠিয়েছেন। ব্যাটিংয়ের সহজ পাঠ ফের মুখস্থ করতে বলেছেন। বিশ্বাস করিয়েছেন যে, টিমে স্ট্রোকপ্লেয়ার অনেক। শিখর, রোহিত, বিরাট, রাহানে। তোমাকে শিট অ্যাঙ্কর হতে হবে।

কিন্তু গুরু-দর্শনই যদি সাফল্যের একমাত্র নির্ণায়ক হত, তা হলে আজাদ-আচরেকরের ক্রিকেট-আখড়া থেকে আরও গোটা পাঁচেক কপিল-তেন্ডুলকর বেরোত! পৃথিবীর আর পাঁচটা স্পোর্টের মতো ক্রিকেটেও তাই যেমন ভাল গুরুর দরকার, তেমন প্রতিভাবান এবং সম-নিষ্ঠাবান ছাত্রেরও প্রয়োজন। ভুল হল। ক্রিকেটে দ্বিতীয়টার প্রয়োজন আরও বেশি। বিজয় শুনলে খুশি হবেন যে, বাংলাদেশ ক্রিকেটমহলের কারও কারও শিরদাঁড়ায় এত গরমেও তিনিই সবচেয়ে বেশি হিমস্রোত বইয়ে দিয়েছিলেন। যাঁর টানা দেড় দিনের নিশ্ছিদ্র ব্যাটিং দেখে এ পারের ক্রিকেটমহলের কেউ কেউ বলে ফেললেন, টেস্ট ক্রিকেটে মধ্যবিত্ত আর উচ্চবিত্ত ব্যাটসম্যানের যেটা ফারাক করে দেয়, অর্থাত্‌ ক্রমাগত বল ছাড়ার সেই বিরল ক্ষমতা— বিজয়ের সেটা আছে। বলা হল, ভারতীয় টেস্ট টিমের ‘ভীষ্ম’ নাকি এখন একজনই। বিজয়। তাঁর নাকি ‘ইচ্ছামৃত্যু’!

যা খুব একটা বাড়াবাড়ি নয় বোধহয়। ফতুল্লা মাঠে শিখর ধবন ১৭০ করে গেলেন। বিজয় দেড়শো। তফাত দু’টো। ধবনের ‘দে ঘুমাকে’ ইনিংস প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের মতো আছড়ে পড়েছে বঙ্গ বোলিং-উপকূলে। বিজয়েরটা নিঃশব্দে। রাতের অন্ধকারে অতর্কিত হানার মতো। ধবন অস্ট্রেলিয়ার মাঠে চরম ব্যর্থ। বিজয় সেখানে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, উপমহাদেশ তিন জায়গাতেই সফল। আর বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রভাবে দু’জনের ইনিংসই এক।

বোধহয় বিজয়েরটা কিছু বেশি। সোজাসুজি বললে, বাংলাদেশকে মোটেও আজ টেস্ট দুনিয়ার ‘দুগ্ধপোষ্য’ সদস্য দেখায়নি। ফতুল্লা উইকেটে এ দিন থেকে ভাঙন ধরতে শুরু করল। আর সেখানে সাকিব আল হাসান এবং লেগস্পিনার জুবের হোসেন মিলে ফ্লাইট আর ঢিমে গতির ফাঁদে এতটাই বন্দি করে ফেললেন ভারতীয়দের যে, রোহিত-বিরাটের মতো ব্যাটসম্যানরা পর্যন্ত সামলাতে পারলেন না। সঙ্গে আবার বড়-বড় টার্ন। রোহিত বোল্ড। বিরাট বোল্ড। বিনা উইকেটে ২৮৩ থেকে স্কোরটা আচমকাই ৩১০-৩ হয়ে গেল। জুম্মাবারের ফতুল্লা স্টেডিয়াম উত্তেজনায় তখন কাঁপছে। সাকিবের নাম ধরে তীব্র গর্জন তুলছে। মাঠে ঢোকার জন্য স্টেডিয়াম গেট ধরে ঝাঁকাচ্ছে শ’য়ে শ’য়ে দর্শক। পাঁচিল টপকে মাঠের দিকে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটছে খুদে। যুবক জুবের এক-একটা বল এমন টার্ন করাচ্ছেন যেন মনে হচ্ছে শেন ওয়ার্নকে অবসর ভাঙিয়ে ফিরিয়ে আনা হয়েছে!

বিজয় ওখান থেকে ধরলেন। সতীর্থদের কাছে বিজয়ের একটা ডাকনাম আছে। মঙ্ক। মদের একটা বিশেষ ব্র্যান্ড নাকি তাঁর অতীব পছন্দের, তাই। দেখা গেল, মঙ্কের ব্যাটিংও অনেকটা পুরনো ওয়াইনের মতো। যত সময় যাবে, তত তার স্বাদ খুলবে। কখনও কপিবুক-জেরক্স কভার ড্রাইভ। কখনও দর্শনীয় স্লগ সুইপ মেরে বাউন্ডারি তুলে নেওয়া। বিজয়কে দেখে একবারও মনে হয়নি কোনও চাপ ঘাড়ে উপস্থিত হয়েছে বলে। তবে হ্যাঁ, আরও একজন ক্রিকেট-সাধক পেয়ে গিয়েছিলেন তিনি। অজিঙ্ক রাহানে এ দিন সেঞ্চুরি না পেতে পারেন। কিন্তু তাঁর ১০৩ বলে ৯৮ মনে থাকবে অন্য একটা কারণে। নিঃস্বার্থ ব্যাটিংয়ের কারণে। নেমে শুধু ওভারে দু’টো করে বাউন্ডারি তুলে যাওয়া নয়, আটানব্বইয়ে দাঁড়িয়ে স্রেফ টিমের দ্রুত রান তোলার কথা ভেবে যে শটটা তিনি খেললেন, একশোর মধ্যে নব্বই জন ক্রিকেটার যাবে না। ও রকম ঝুঁকিপূর্ণ পুল মারার কথা ভাববেও না। কিন্তু রাহানে ভাবলেন। ইনিংসের মর্যাদাও এক ঝটকায় ওখানে অনেক বেড়ে গেল। ‘মঙ্ক’ ডাকনামটা রাহানের ক্ষেত্রে আক্ষরিক অর্থেই বসানো যায়।

শুক্রবার বিজয়-রাহানের ইনিংস নিঃসন্দেহে টেস্ট জয়ের দরজা খুলে দিয়ে গেল। কিন্তু সে দরজা দিয়ে ঢুকে পড়া যাবে কি না, বলা মুশকিল। আগামী দু’দিনে ক’টা সেশন বাংলাদেশ-বধের জন্য ভারতীয় বোলাররা ঠিকঠাক পাবেন, সেটাই প্রশ্ন। বৃষ্টি যা ভোগাচ্ছে!

বৃষ্টি বারবার বিঘ্ন না ঘটালে এ দিনই পাঁচশো ওঠে। ডিক্লেয়ারও করে দেওয়া যায়। কিন্তু চা বিরতির পর পুরোপুরি ম্যাচ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সেটা হল না। বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই ড্রয়ের লক্ষ্যে ছুটতে শুরু করেছে। ভারত এখন তাদের কতটা ছুটতে দেবে, দাঁড়িয়ে ভারত অধিনায়কের উপর। বিরাট শনিবার কখন ডিক্লেয়ার করবেন, কতটা ঝুঁকি নিয়ে বৃষ্টিতে মেজাজ খিঁচড়ে দেওয়া টেস্ট ম্যাচকে আকর্ষণীয় করে তুলবেন, ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরা এ বার সে সব দেখবেন। এত দিন ক্রিকেটবিশ্ব কঠিন পরিস্থিতিতে তাঁর ব্যাটিং দেখেছে, এ বার কঠিন পরিস্থিতিতে বিরাটের আর একটা জিনিস দেখবে।

আর্ট অব ক্যাপ্টেন্সি!

ভারত

প্রথম ইনিংস

বিজয় এলবিডব্লিউ সাকিব ১৫০

শিখর ক ও বো সাকিব ১৭৩

রোহিত বো সাকিব ৬

কোহলি বো জুবায়ের ১৪

রাহানে বো সাকিব ৯৮

ঋদ্ধিমান বো জুবায়ের ৬

অশ্বিন ব্যাটিং ২

হরভজন ব্যাটিং ৭

অতিরিক্ত

মোট ৪৬২-৬

পতন: ২৮৩, ২৯১, ৩১০, ৪২৪, ৪৪৫, ৪৫৩।

বোলিং: শাহিদ ২২-২-৮৮-০, সৌম্য ৩-০-১১-০, শুভাগত ১৪-০-৫২-০,

সাকিব ২৪.৩-১-১০৫-৪, তাইজুল ২০-০-৮৫-০, জুবায়ের ১৯-১-১১৩-২,ইমরুল ১-০-৩-০।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE