‘‘আই অ্যাম দ্য গ্রেটেস্ট’’... ’৬৫-র সেই বিখ্যাত ফাইট। এক মিনিটে নক-আউট সনি লিস্টন। রিং-এ সটান দাঁড়িয়ে মহম্মদ আলি। — ফাইল চিত্র
আলি লন্ডনে এসেছিলেন ওঁর জীবন নিয়ে তোলা ফিচার ফিল্ম ‘দ্য গ্রেটেস্ট’-এর প্রিমিয়ারে। উঠেছিলেন ‘লন্ডন হিল্টন’-এ।
১৯৭৭ সাল। হেমন্তকাল।
হাজারখানেক সাংবাদিক জড়ো হয়েছিল হোটেলের নীচে ওঁর বাইট নেবে বলে। ওই ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে কেন জানি না ওঁকে প্রশ্ন করে বসলাম, ‘‘ভারতে কি আপনার লড়াই দেখা যাবে না?’’
আশপাশ থেকে আরও প্রশ্ন উড়ে আসছিল, আলি কিন্তু উত্তরটা দিলেন আমাকেই। বললেন, ‘‘ভারতে কি আমার লড়াই দেখে?’’ বললাম, আপনি ভাবতেও পারবেন না, ভারতে আপনার কত ফ্যান এবং অনুরাগী, যাঁরা সত্যিই বক্সিংটা ভালবাসেন।
আলি বললেন, ‘‘তা হলে ওখানে আমার লড়াই করলেই তো পারে!’’
বললাম, মস্ত টাকার ব্যাপার, ওটা খুব শিগগির হবে বলে মনে হয় না।
আলি বললেন, ‘‘শুভেচ্ছা জানিয়ো আমার ফ্যানদের।’’
আরও প্রশ্ন উড়ে আসছিল। আলি বললেন, ‘‘আমার খুব খিদে পেয়েছে, এখন ডিনারে যাচ্ছি বাইরে।’’ বলে ওঁর ওই ছ’ফুট চার ইঞ্চি উচ্চতার শরীরটা নিয়ে এগোতে লাগলেন হোটেলের কার পার্কের দিকে। একটা লম্বা কালো স্ট্রেচ লিমুজিন এসে দাঁড়িয়েছিল ততক্ষণে। পিছনের সিটে বসে দরজা বন্ধ করার আগে হাত নেড়ে কাকে যেন কাছে ডাকতে লাগলেন আলি।
অগণিত সাংবাদিক জড়ো হয়ে আছে চারপাশে। কিন্তু আমার কেন জানি না মনে হল, উনি আমাকে ডাকছেন। আমি দৌড়ে গিয়ে ওঁর সামনে দাঁড়াতেই বললেন, ‘‘কাল দুপুর ১২টায় এসো, কথা বলব।’’
আমি ভাবতেও পারছি না, মুদ্রণ ও বৈদ্যুতিন মাধ্যমের এই এত সাংবাদিকের মধ্যে আলি হঠাৎ আমাকে কেন ডেকে বসেছেন! বললাম, নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই।
পরের দিন হোটেলের কাউন্টারে গিয়ে আমার নাম বলতেই, ওঁরা ওঁকে ফোনে ধরলেন। আর উনি ওপর থেকে বললেন, ‘‘ভারতীয় সাংবাদিক তো? পাঠিয়ে দাও।’’
বাকিটা ইতিহাস!
আলি ঠিক কোন মাপের, তা বলতে গেলে একটা গল্প বলতে হয়। ভারতীয় অঙ্কশাস্ত্রী শ্রীনিবাস রামানুজন-এর কেমব্রিজের শিক্ষক প্রফেসর হার্ডি সমস্ত শাস্ত্রের সেরাদের মাপার একটা গুণমান খাড়া করেছিলেন— ‘ব্র্যাডম্যান ক্লাস’। অর্থাৎ সেরার সেরা হতে হলে, তাকে ছুঁতে হবে ‘ব্র্যাডম্যান ক্লাস’।
স্যার ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যানের এতই ভক্ত ছিলেন হার্ডি যে, কোনও সেরার মাপটা দাঁড় করিয়েছিলেন ব্র্যাডম্যান ক্লাস-এ। সেই মাপ অনুযায়ী মহম্মদ আলি হলেন, ‘ট্রু ব্লু ব্র্যাডম্যান ক্লাস’।
বহুদিন হল, বলা শুরু হয়েছে মহম্মদ আলি আগে হয়নি, আর হবে না। দুর্ধর্ষ বক্সার তো বটেই, তিনি বক্সিংকে যে জনপ্রিয়তা দিয়ে গেলেন, তা সঙ্গীতকে দিয়েছিলেন ইগর স্ত্রাভিনস্কি, বিজ্ঞানকে স্টিফেন হকিং, এবং সাহিত্যকে মার্সেল প্রুস্ত।
একটা ঘুষোঘুষির খেলাকে স্টাইল, ক্রাফট, গতি, মাধুর্য, বুদ্ধিবৃত্তি, বীরত্ব এবং জনপ্রিয়তা দিয়ে গেলেন তিনি। বক্সিং রিংকে ব্যবহার করলেন অনেকটা দাবার ৬৪ খোপে অতর্কিতে হানা দেওয়া সব চালের মতো। কখন যে কোন চাল দেবেন বোঝা দায়। এতটাই আচমকা সব ঘটে যেত! যেমনটা বুঝতে পারেননি আলির বিপক্ষে রিংয়ে নামার আগে পর্যন্ত অপরাজিত জর্জ ফোরম্যান। কী ধূর্ত ছকই না উদ্ভাবন করেছিলেন তাঁর জন্য! যার নাম ‘রোপ আ ডোপ’।
আমার মনে আছে, ওঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনি নিজেকে কি খুব সাহসী মনে করেন? শব্দটা ব্যবহার করেছিলাম, ‘কারেজ’।
উনি আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন। বললেন, ‘‘সনি লিস্টন, জর্জ ফোরম্যান, জো ফ্রেজিয়ার, কেন নর্টন— এঁদের সঙ্গে লড়তে সাহস দরকার হবেই।’’
কখনও মৃত্যুভয় হয়নি? বললেন, ‘‘না। ওই ভয়টা আমার নেই।’’
তখন প্রশ্ন করতেই হল, হারের ভয় কখনও পেয়েছেন? আলি উত্তর দিলেন, ‘‘কক্ষনো না। আমি জেতা ছাড়া অন্য কিছু চিন্তাই করি না।’’
ফের জিজ্ঞেস করলাম, কিন্তু একটা ব্যাপার আপনার নানা লড়াই দেখে মাথায় এসেছে— আপনি অকারণে কাউকে পেটাতে চান না।
আলি এ বার হেসে বললেন, ‘‘জেতার জন্য অকারণ আঘাত করার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু তুমি এই প্রশ্নটা আমায় করলে কেন?’’
বললাম, ফোরম্যানের সঙ্গে আপনার লড়াই নিয়ে নরম্যান মেলার যে বইটা লিখেছেন, ‘দ্য ফাইট’— তাতে এক জায়গায় পাচ্ছি, ফোরম্যানের মাথার পিছনটা আপনার হাতের সামনে পড়তেও আপনি ওকে পিছন থেকে মারেননি। যেটা ফোরম্যান নিজে করেছিলেন ফ্রেজিয়ারকে।
আলি খুশি হয়েও বললেন, ‘‘আমি কোনও অন্যায় ঘুষি কাউকে কোনও দিন মরিনি। এটার জন্যও কিন্তু অনেক সাহস দরকার।’’
এর পর যে প্রশ্নটা করেছিলাম, তাতে খুব হাসলেন। জিজ্ঞেস করলাম, হলিউডের অভিনেত্রী ক্যান্ডিস বার্গেন আপনার লড়াইয়ের ছবি তুলেছিলেন এবং বলেছিলেন, আপনার মতো সেক্স সিম্বল উনি দেখেননি।
তাতে আলি এমন ভান করলেন, যেন ক্যান্ডিসের নামই শোনেননি। জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘কে ও?’’
পরে মনে হয়েছে, প্রসঙ্গটা এড়াবার জন্যই হয়তো অমন ভণিতাটা করেছিলেন। কারণ নরম্যান মেলারের নামটা বলার সময়ও উনি ভাব করেছিলেন, যেন প্রথম শুনলেন। অথচ দুনিয়া জানে, ওই ‘দ্য ফাইট’ বইটা লেখার জন্য মেলার কী ভাবে পিছনে পড়েছিলেন আলির!
আসলে আলি মানুষটাই এরকম। অজস্র রহস্যে ভরা, অসম্ভব রম্য অহমিকায় আচ্ছন্ন। অপূর্ব কথা বলেন এবং ওঁর দুই মুষ্টির মতো দ্রুততায়। পরে বুঝেছি, সেক্স সিম্বল বা গ্ল্যামার জাতীয় বিষয় নিয়ে কথা বলতে চান না, কারণ তত দিনে উনি সাত্ত্বিক মুসলমান। ওঁর প্রথম বিয়েটা ভেঙে যাওয়ার কারণও তো এটাই। স্ত্রী বেলিন্ডা একটা সময় পেরে উঠছিলেন না ওঁর কঠিন লাইফস্টাইলে। যেখানে ছোটখাট পোশাকআশাক পরা, এমনকী সিগারেট খাওয়াও নিষিদ্ধ।
আলি কিন্তু জীবনে এই সমস্ত কঠিন নিয়মকানুন পালন করে গিয়েছেন। নিয়মানুবর্তিতার আর এক নাম হয়ে গিয়েছিল— আলি। পরিশ্রম আর পরিশ্রম দিয়ে ভরিয়ে রেখেছিলেন অনুশীলন। আর প্রতিটি লড়াইয়ের জন্য ভেবে ভেবে নতুন মারের তরিকা। যে কোনও বক্সারের দু’টো ঘুষির জবাবে যাতে আটটা ঘুষি ছুড়তে পারেন, সেই ফিটনেসও রেখে গিয়েছেন, যত দিন রিং-এ নেমেছেন।
শেষ দিকে শরীরটা ভারী হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু ওঁর প্রতিদ্বন্দ্বীরা জানতেন যে, আলি যে কোনও মুহূর্তে একটা ম্যাজিক করে দিতে পারেন।
ওঁকে হারাবার পর লেয়ন স্পিঙ্কস নিজের কর্নারে ফিরে গেলেন যখন, ওঁর দলের লোকেরা চেঁচাতে শুরু করেছিল, ‘‘দ্য চ্যাম্প, দ্য চ্যাম্প’।
স্পিঙ্কস তখন বলেছিলেন, ‘‘চ্যাম্পিয়ন বসে আছেন উল্টোদিকে। আমি শুধু এই লড়াইটা জিতেছি।’’
আসলে গত শতাব্দীর গোটাটা জুড়েই চ্যাম্পিয়ন থেকে গেলেন মহম্মদ আলি। একষট্টিটা লড়াইয়ের মধ্যে ছাপ্পান্নটা জিতেছেন এবং খেলার ধরন নিয়ম প্রায় বদলে দিয়ে। অন্যরা বক্সিং লড়ত, উনি এক স্বর্গীয় শিল্প। ওঁর সেরা প্রতিদ্বন্দ্বীরা স্বীকার করছেন এখন, উনি চলে যাওয়াতে ওঁদের জীবনটাও শেষ হয়ে গেল।
আলির পাঞ্জাটা দেখতে চেয়েছিলাম। আমার পাঞ্জাটা ধরতে বুঝলাম, এ এক অন্য বস্তু। মস্ত বড় পাঞ্জা। কিন্তু কী নরম! তার পর ধীরে ধীরে সেই পাঞ্জাই ইস্পাতের মতো শক্ত হতে শুরু করল। কয়েক মুহূর্ত আগে যে পাঞ্জাটা ছিল সাধারণ মানুষের মতো, সেটাই সহসা একটা লোহার যন্ত্রের মতন হয়ে উঠল। আলি একটু একটু করে হাতের প্রেসার বাড়াতে লাগলেন। এক সময় হেসে বললেন, ‘‘মুহূর্তের মধ্যে আমার ঘুষিতে এই জোরটা আসে। এটাই আমার রহস্য।’’
সাক্ষাৎকার শেষে যন্ত্রপাতি গুটিয়ে সোফা থেকে উঠেছি, একটা প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করল। বললাম, আপনাদের বক্সিং কি শুধুই ঘুষোঘুষি, হারজিত আর রক্তপাত?
আলি নিজেও উঠে দাঁড়ালেন, আর একটা হাত রাখলেন আমার কাঁধে। বেশ ভারী হাত। কাঁধটা চেপে ধরলেন শক্ত করে। আর বললেন, ‘‘নো, ইটস লাইফ।’’
না, এটা জীবন!
এর পর আলির আর একটা যে অবিস্মরণীয় স্মৃতি আমার মনে ভাসে, সেটা বাড়ির কাছে ঢাকা শহরে।
আলিকে সে সময় বাংলাদেশ সরকার সাম্মানিক নাগরিকত্ব অর্পণ করছিল।
আমি গিয়েছিলাম সাংবাদিক হিসেবে রিপোর্ট করতে। হুড-খোলা গাড়িতে ওঁকে মিছিল করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। কাতারে কাতারে মানুষ রাস্তার দু’ধারে। আমি দাঁড়িয়েছিলাম সেই ভিড়ে।
চার দিক তুমুল উল্লাসধ্বনি, আলি হাত নেড়ে অভিবাদন গ্রহণ করছেন। হঠাৎ পাশ থেকে একটা অপূর্ব চিৎকার শুনলাম। কে একজন বলে উঠলেন, ‘‘আলি এখন বাঙালি।’’
আর অমনি চার দিকে ছড়িয়ে পড়ল চিৎকারটা।
বাঙালি! বাঙালি! বাঙালি!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy