কারিগর: রক্ষণ ও আক্রমণে সমতা রেখেছেন কিবু (মাঝখানে)। ফাইল চিত্র
শনিবারের সন্ধ্যা। স্থান গোয়ার ফতোরদা স্টেডিয়াম। সেখানে মোহনবাগান বনাম চার্চিল ব্রাদার্স ম্যাচের বয়স তখন সাতান্ন মিনিট। নিজেদের অর্ধে প্রথম পাসটি খেললেন সবুজ-মেরুন শিবিরের মিডফিল্ডার শেখ সাহিল। যা মোহনবাগান অর্ধে নেমে ধরেন স্ট্রাইকার পাপা বাবাকর জিয়োহারা। ৬০ সেকেন্ডে মাঠ জুড়ে আরও ২১টি পাস খেলে বিপক্ষকে চমকে দেবেন জোসেবা বেইতিয়ারা। তার পরে শেষ টাচ অর্থাৎ ২৩ নম্বর পাসে গোল কোমরন তুর্সুনভের।
আই লিগে মোহনবাগানের এই পাসিং ফুটবল দেখার পর আন্দোলিত গোটা ভারত। গোয়া থেকে আই লিগ জয়ী কোচ আর্মান্দো কোলাসো বলে দিলেন, ‘‘এই পাসিং ফুটবল দেখতেই তো লোক মাঠে ভিড় করে।’’ আর মোহনবাগানকে জাতীয় লিগ চ্যাম্পিয়ন করা প্রাক্তন কোচ সুব্রত ভট্টাচার্যের প্রতিক্রিয়া, ‘‘মেসিদের আর্জেন্টিনা ২০০৬ বিশ্বকাপে সার্বিয়া ও মন্টেনেগ্রোর বিরুদ্ধে ২৫ পাসে গোল করেছিল। দু’বছর আগে পেপ গুয়ার্দিওলার ম্যাঞ্চেস্টার সিটি চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ম্যান ইউয়ের বিরুদ্ধে ৪৪ পাসে গোল করেছিল। এত দিন যা আন্তর্জাতিক ফুটবলে দেখতাম, সে রকম গোল করল মোহনবাগান।’’
সমর্থকেরা অবশ্য আর্জেন্টিনার এস্তেবান ক্যাম্বিয়াসোর ২৫ পাসের গোল বা ম্যান সিটির ইলখাই গুন্দোয়ানের ৪৪ পাসের গোল নিয়ে ভাবছেন না। রবিবার সকাল থেকে তাঁরা সোশ্যাল মিডিয়ায় তুর্সুনভের ২৩ পাসের গোল নিয়ে তুলনা করছেন ২৩ বছর আগে প্রয়াত অমল দত্তের ডায়মন্ড সিস্টেমের সঙ্গে। কেউ লিখেছেন ‘ডায়মন্ড সিস্টেম ২.০’ (ডায়মন্ড জমানার দ্বিতীয় সংস্করণ)।
যা শুনে বিচলিত হন না কিবু ভিকুনা। তাঁর সোজা কথা, ‘‘এখনও চ্যাম্পিয়ন হইনি আমরা। আই লিগে আরও মনোনিবেশ করতে হবে। আমার ফুটবল দর্শন— বল ধরে নিজেদের দখলে রেখে বিপক্ষকে হতাশ করে দাও। বল মাটিতে রেখে খেলতে হবে পাসের পর পাস। তার পরে সুযোগ বুঝে গোলের দরজা খুলে ফেলো। সঙ্গে রক্ষণও জরুরি।’’
যা শুনে অমল দত্তের সেই মোহনবাগানের ফুটবলার ও বর্তমানে ফুটবল ধারাভাষ্যকার সৌমিত্র চক্রবর্তী বললেন, ‘‘এই মোহনবাগান সাতানব্বইয়ে আমাদের সেই দলটার মতোই পাসের ঝর্ণায় ভাসিয়ে দিচ্ছে প্রতিপক্ষকে।’’ সেই দলের স্ট্রাইকার ও বর্তমানে মহমেডান টিডি দীপেন্দু বিশ্বাসের বিশ্লেষণ, ‘‘অমল স্যার মাটিতে বল রেখে গোলমুখী পাস খেলাতেন প্রচুর। সাহিলরাও সে রকম খেলেই আই লিগে সব চেয়ে বেশি ৩০ গোল করেছে। সে বার এ রকম পাসিং ফুটবলেই চার্চিলকে নাস্তানাবুদ করে ৬-১ হারিয়েছিলাম। শনিবারের ম্যাচ দেখে সেই পুরনো স্মৃতি জেগেছিল।’’
মোহনবাগানের বর্তমান সহকারী কোচ রঞ্জন চৌধুরী সেই দলের মাঝমাঠে খেলতেন। ছাত্র হিসেবে অমল দত্ত আর সহকারী হিসেবে কিবু ভিকুনা—দু’জনের অনুশীলনই কাছ থেকে দেখেছেন। তিনি বলছেন, ‘‘প্রচুর পাস, ওভারল্যাপ অমলদার জমানা মনে করায়। তবে অমলদা অতিরিক্ত আক্রমণাত্মক ছিলেন। তাই প্রতি-আক্রমণে আমরা সমস্যায় পড়তাম। কিবু দলের রক্ষণ ও মাঝমাঠকেও পোক্ত রেখেছেন।’’ যোগ করেন, ‘‘কিবুর অনুশীলনে বৈচিত্র বেশি। ছোট মাঠে বল নিয়ে অনুশীলন করানোয় ছেলেদের কভারিং, মার্কিং, ফিটনেস ভাল হয়েছে। তুর্সুনভ ও সুহেরের চকিতে জায়গা বদল, গঞ্জালেস ও সাহিলের একে অপরের পরিপূরক হয়ে ওঠায় বিপক্ষ আমাদের বুঝতে সময় নিয়ে ফেলছে।’’
সাতানব্বইয়ে মোহনবাগান মাঝমাঠের দুই সেনাপতি সত্যজিৎ চট্টোপাধ্যায় আর দেবজিৎ ঘোষ। সেই সত্যজিৎ এখন ক্লাব কর্তা। দেবজিৎ ধারাভাষ্যকার। সত্যজিতের ব্যাখ্যা, ‘‘আমাদের রক্ষণে বিদেশি ছিল না। অমলদা ৩-৫-২ খেলাতেন। তিন ব্যাকে বিপক্ষের প্রতি-আক্রমণে চাপ বাড়ত। কিন্তু কিবু আক্রমণের সময়ে ৩-৫-২ ছকে যায়। রক্ষণের সময়ে ৪-৪-২ বা ৪-৫-১ ছকে থাকে। সেই রক্ষণে চার জনের দু’জন বিদেশি। সঙ্গে ফ্রান গঞ্জালেসরাও যোগ দেয়। তাই আক্রমণের সঙ্গে রক্ষণও পোক্ত।’’
দেবজিতের মন্তব্য, ‘‘ফ্রান গঞ্জালেস আমার মতোই অকুতোভয়। নেতৃত্ব দিয়ে খেলে। আমাদের দলে অমিত দাস, বাসুদেব মণ্ডলরা প্রান্ত দিয়ে গতিতে পাস খেলে চিমাকে বল বাড়াত গোলের জন্য। ১৩ ম্যাচে ৩২ পয়েন্ট নিয়ে শীর্ষে থাকা এই মোহনবাগানে সবাই গোলের জন্য ঝাঁপায়। তফাত এটাই। না হলে ২৩ বছর আগের সেই বিখ্যাত মরসুম মনে করিয়ে দিচ্ছে
কিবুর পাসিং ফুটবল।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy