গোয়ার টিমের বিরুদ্ধে শুক্রবার ঝলমলে বাগানের দুই বিদেশি গোলদাতা কাতসুমি ও সনি নর্ডি।
মোহনবাগান-৩ (ডেনসন, কাতসুমি, সনি)
সালগাওকর-১ (অগাস্টিন)
পুরাণে বলা হয়েছে, ত্রিশূল হাতে ‘দুষ্টু লোক’ সংহার করেন মহাদেব শিব।
এ বারের আই লিগে মোহনবাগানে এক ‘ত্রিশূল’ আবিষ্কৃত হয়েছে! যেটা দিয়ে বাগান কোচ সঞ্জয় সেন ‘দুষ্টু ট্রফি’ সংহারে বেরিয়েছেন! বাংলার ফুটবলপ্রেমী মানুষের সঙ্গে ‘প্রতারণা’ করে গত বারো বছর যে ট্রফি ভিন রাজ্যের সম্পদ, তাকে ফের সোনার বাংলায় ফেরানোর সংকল্পে।
সঞ্জয়ের বাগান লক্ষ্যে আরও এক ধাপ এগোল শুক্রবার। গোটা মরসুম যে টিমকে এক বারও হারাতে পারেনি সবুজ-মেরুন, সেই সালগাওকরকে ত্রিশূলে বিদ্ধ করে।
ত্রিশূল— তিন গোল।
ত্রিশূল— সনি-বোয়া-কাতসুমি।
বাগানের তিন বিদেশির দাপটে বারাসত স্টেডিয়ামে এক সঙ্গে তিনটে মিথের অবসান ঘটালেন সঞ্জয়। এক) মোহনবাগান এখনও ‘দশে দশ’ অপরাজিত থাকতে পারে। দুই) যে ডার্বি জেতে, সে পরের ম্যাচও জিততে পারে। তিন) সালগাওকর কোনও জুজু নয়, যার সামনে থরথর করে কাঁপতে হবে।
বারাসতের ছোট মাঠে দ্রুত মানিয়ে নেওয়ার ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন সঞ্জয়। সেই মতো আগের দিন অনুশীলন করান। ছোট ছোট পাস। সেট পিসে জোর। গতিময় ফুটবল। শুক্রবার এই তিনটেতেই লেটার মার্কস পেলেন বাগান ফুটবলাররা। সালগাওকরের ছোট বক্সের সামনে সনি-বোয়া-কাতসুমির যে ত্রিভূজ বারবার তৈরি হচ্ছিল, তার তীক্ষ্মতায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠেন গোয়ান টিমের ফুটবলাররা। তিনের ফুটবল-কনসার্ট আরও সুরেলা হয়ে উঠল হাফটাইমের পর। ত্রিভূজের তিন শীর্ষবিন্দু তখন অনবরত জায়গা বদল করে গেল। সালগাওকর ডিফেন্সে তখন ন’জন মিলেও সঞ্জয়ের ‘ত্রিশূল’ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন। যেমন সনির গতি, তেমন কাতসুমির ‘উইথ দ্য বল’ দৌড়, তেমনই বোয়ার ডিস্ট্রিবিউশন। মোহনবাগান তখন যেন ৪৪০ ভোল্টের বিদ্যুৎ!
ম্যাচের গোড়ায় অবশ্য বাগান অত বেশি ভোল্টে ঝলসায়নি। সেটা যুবভারতী থেকে আচমকা বারাসতের ছোট মাঠে এসে পার জন্য হোক, কিংবা সালগাওকরের অতি-আক্রমণাত্মক স্ট্র্যাটেজিকে সতর্ক ভাবে মাপতে। মাঝমাঠের দখলে হোঁচট খেতে দেখা যাচ্ছিল বাগানকে। বিক্রমজিৎ ঠিক আছেন। কিন্তু ডেনসন যে ফুটবলটা খেললেন তাতে ট্রফির স্বপ্ন দেখা বাগানকে আগামী দিনে সমস্যায় পড়তে হতে পারে। গোটা টিমে তাঁকেই শুধু বেমানান দেখাচ্ছিল। অজস্র মিস পাস। বিশ্রী বল কন্ট্রোল। তার পরেও তালেগোলে বাগানের প্রথম গোলটা তাঁরই পা থেকে এলেও, সেটার পিছনে বেলোর হেড আর সনির ফ্রিকিকের ভূমিকাই বেশি। এমনকী প্রথমে তো ভুল করে স্কোরারের নাম ‘বেলো’ ঘোষিতও হয়। সঞ্জয়ের দলের মাঝমাঠের গাফিলতিতেই কাউন্টার অ্যাটাকে ১-১ করে ফেলে সালগাওকর। ম্যাচ শেষে বাগান কোচও বললেন, ‘‘একটা সেট মাঝমাঠ খেলাতেই পারছি না। কখনও কার্ড সমস্যা, কখনও কারও চোট। এক-এক সময় বিরক্ত লাগে।’’
সঞ্জয়ের বিরক্তির দোষই বা কী? মাঝমাঠে যাঁকেই তৈরি করছেন, তিনি কোনও না কোনও কারণে ছিটকে পড়ছেন। বারবার পরিকল্পনা বদলাতে হচ্ছে কোচকে। কিছু দিন আগে শেহনাজ অহেতুক লাল কার্ড দেখায় এই ম্যাচের বাইরে চলে যান। এ দিন শেষ মিনিটে লাল কার্ড দেখে সঞ্জয়ের দুশ্চিন্তা বাড়ালেন বিক্রমজিৎ। ক্ষুব্ধ কোচ বলে দিলেন, ‘‘ক্লাবকে বলব ওদের শো-কজ করা হোক। যাতে এ রকম ঘটনা ভবিষ্যতে আর না ঘটে।’’
বিপক্ষের এলোমেলো মাঝমাঠ পেয়েও সুবিধে করতে পারেনি ডেরেক পেরেরার দল। শুধু সঞ্জয়ের ত্রিশূলের জন্য। যার সবচেয়ে ধারালো মুখ বোয়া। মরসুমের প্রথম দিকে যখন শুরু করেছিলেন, তাঁর দিকে উড়ে এসেছিল বাগান সমর্থকদের কটুক্তির কাঁটা। এখন আই লিগের মাঝপথে তাঁর দিকেই উড়ে আসছে জয়ধ্বনির ফুল। নিজেকে একেবারে বদলে ফেলেছেন বাগানের মার্কি ফুটবলার। এত ঠান্ডা মাথার বল প্লেয়ার সম্ভবত ব্যারেটোর পরে আর দেখা যায়নি বাগানে। বোয়া নিজেও বলছিলেন, ‘‘শুরুতে আমার মানাতে একটু অসুবিধা হচ্ছিল। একা একা নিজের সঙ্গে কথা বলতাম। খেতে পারতাম না। ঘুম আসত না। আসতে আসতে নিজেকে বদলেছি।’’
বদলে যাওয়া বোয়া যখন নিজের অভিজ্ঞতা টিমে ছড়িয়ে দিচ্ছেন, তখন সনি গতি আর স্কিলে মুগ্ধ করছেন। এ দিনও হাফলাইন থেকে দুরন্ত একক দৌড়ে একটা চোখ ধাঁধানো গোল তো করলেনই, দু’টো গোল করালেনও। জটলা থেকে কাতসুমির ৩-১ করার পিছনেও সনির অবদান অনবদ্য। ম্যাচ শেষে বাগানের হাইতি স্ট্রাইকার বলছিলেন, ‘‘ফেড কাপের বদলা নিলাম। এই ছোট মাঠটায় গোল করা আমার কাছে একটা চ্যালেঞ্জ ছিল। বড় দৌড়নোর জায়গাই নেই। তাও যে ভাবে একটা লং রান-এ গোল পেলাম তাতে এটাই লিগে এখনও পর্যন্ত আমার সেরা গোল। রাতের ডিনারে চিংড়ি দিয়ে উৎসব করব।’’
ছুটকো-ছাটকা সমস্যা থাকলেও সঞ্জয়ের বাগানের ৪৪০ ভোল্টের সংস্পর্শে আসলেই এখন ‘দ্য এন্ড’ হয়ে যাচ্ছে যে কোনও বিপক্ষের। শুধু দেখার, মে মাসের শেষে যখন আই লিগ চ্যাম্পিয়নের নাম ঘোষণা হবে তখন এক বাঙালি ও তাঁর ত্রিশূল অমরত্ব অর্জন করতে পারে কি না!
মোহনবাগান: দেবজিৎ, আনোয়ার, বেলো, কিংশুক, ধনচন্দ্র, বিক্রমজিৎ, ডেনসন (শৌভিক), বোয়া, কাতসুমি, নর্ডি, জেজে।
ছবি: শঙ্কর নাগ দাস।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy