মহমেডানের গোলরক্ষক শঙ্কর মন জিতলেন। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
ব্যর্থতার যন্ত্রণা নিয়ে হারিয়ে যেতে যেতেও নাটকীয় প্রত্যাবর্তন।
সোমবার কল্যাণী স্টেডিয়ামে তাঁর হাতেই হয়তো সাত বছর পরে কলকাতা প্রিমিয়ার লিগ জয়ের স্বপ্ন ধ্বংস হয়ে যেত মোহনবাগানের। কিন্তু শেষ মুহূর্তে আজহারউদ্দিন মল্লিকের গোলে বদলে যায় ছবিটা। তবে হারলেও মিনি ডার্বির নায়ক মহমেডান গোলরক্ষক শঙ্কর রায়।
কলকাতা প্রিমিয়ার লিগের প্রথম ম্যাচেই পাঠচক্রের বিরুদ্ধে মহমেডানের হারের জন্য দায়ী করা হয়েছিল শঙ্করকেই। তার পর টানা তিনটি ম্যাচে প্রথম একাদশ থেকে বাদ পড়েন বাংলাকে সন্তোষ ট্রফিতে চ্যাম্পিয়ন করা গোলরক্ষক। এখানেই শেষ নয়। খেপ খেলতে গিয়ে বিতর্কে জড়ান তিনি।
সপ্তাহখানেক আগে বারাসত স্টেডিয়ামে পিয়ারলেসের বিরুদ্ধে ম্যাচে নাটকীয় ভাবে বদলে যায় পরিস্থিতি। মহমেডানের আর এক গোলরক্ষক মহম্মদ রশিদ ব্যর্থ হওয়ায় পরিবর্ত হিসেবে শঙ্করকে নামিয়েছিলেন কোচ বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য। বছর বাইশের প্রতিশ্রুতিমান গোলরক্ষক ওই ম্যাচটাকেই বেছে নিয়েছিলেন নিজেকে প্রমাণ করার মঞ্চ হিসেবে।
সোমবার কল্যাণীতে মিনি ডার্বি শেষ হওয়ার পর শঙ্কর বলছিলেন, ‘‘পাঠচক্রের বিরুদ্ধে হারের পর সমর্থকদের কটাক্ষ আমার জেদ বাড়িয়ে দিয়েছিল। প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, ঘুরে আমি দাঁড়াবোই। পিয়ারলেসের বিরুদ্ধে মাঠে নামার সুযোগ পেয়ে তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করি।’’
কতটা কঠিন ছিল এই প্রত্যাবর্তনের লড়াই? শঙ্কর বললেন, ‘‘অনুশীলনের সময় বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। ক্লাবের প্র্যাকটিসের পর গোরা স্যারের (মহমেডানের গোলরক্ষক কোচ পার্থ চক্রবর্তী) কাছে আলাদা ভাবে অনুশীলন করেছি। আর পাঠচক্রের বিরুদ্ধে যে গোলগুলো খেয়েছিলাম, তার ভিডিও রেকর্ডিং দেখতাম ভুল শোধরানোর জন্য।’’ সন্তোষ ট্রফিজয়ী বাংলা দলের গোলরক্ষক কোচ হেমন্ত ডোরা বলছিলেন, ‘‘শঙ্করের অসম্ভব মনের জোর। দারুণ প্রতিশ্রুতিমান। তবে ওকে আরও ধারাবাহিক হতে হবে।’’
ম্যাচের সেরা হয়েও অবশ্য মন খারাপ মহমেডানের শেষ প্রহরীর। বললেন, ‘‘ম্যাচটাই তো জেতাতে পারলাম না। তাই এই পুরস্কারের কোনও মূল্য আমার কাছে নেই।’’
প্রথম একাদশে প্রত্যাবর্তনের মতোই চমকপ্রদ নাগেরবাজারের শঙ্করের উত্থানের কাহিনি। মাত্র আট বছর বয়সে বাবা বিকাশ রায়কে হারান তিনি। পরিচারিকার কাজ করে কোনও মতে সংসার চালাতেন মা রিনা রায়। আর্থিক সংকটে ক্লাস এইটেই লেখাপড়া বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন শঙ্কর। কিন্তু ফুটবল ছাড়েননি। সল্টলেক সেন্ট্রাল পার্কে বিধাননগর পুরসভার অ্যাকাডেমির দায়িত্বে তখন ছিলেন কিংবদন্তি কোচ অমল দত্ত। ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে সেখানে ভর্তি হন তিনি। শঙ্কর বলছিলেন, ‘‘অন্যের বাড়িতে কাজ করে মা আমাকে মানুষ করেছেন। কখনও কিছু বুঝতে দেননি। যখন যা চেয়েছি, আমাকে দিয়েছেন। মায়ের জন্যই এই জায়গায় আসতে পেরেছি।’’
বছর সাতেক আগে রেলওয়ে এফসি-র হয়ে কলকাতা ময়দানে অভিষেক হয় শঙ্করের। কিন্তু প্রথম নজর কাড়েন পিয়ারলেসে সই করার পরে। গত মরসুমে কলকাতা লিগে অসাধারণ খেলে বাংলার সন্তোষ ট্রফি দলে ডাক পান তিনি। ৩২ তম সন্তোষ ট্রফি জিতে বাংলার রেকর্ড গড়ার দিনেই সুব্রত পালের ভক্ত সিদ্ধান্ত নেন, কলকাতায় ফিরে মাকে আর পরিচারিকার কাজ করতে দেবেন না।
সংসার কী ভাবে চলবে? শঙ্করের পাশে সেই সময় দাঁড়িয়েছিলেন আইএফএ সচিব উৎপল গঙ্গোপাধ্যায়। নিজের সংস্থাতেই চাকরি ব্যবস্থা করে দেন বাংলার প্রতিশ্রুতিমান গোলরক্ষকের। কিন্তু তাতে অনুশীলনে সমস্যা হচ্ছিল বলে চাকরিই ছেড়ে দেন তিনি! এত বড় ঝুঁকি নিলেন? শঙ্কর বললেন, ‘‘আমাকে ফুটবলার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতেই হবে। তার জন্য সব কিছু ছাড়তে রাজি। লক্ষ্যে পৌঁছতে পারলে কিন্তু ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে হবে না।’’
এ যেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের চাঁদের পাহাড় কাহিনির শঙ্কর। স্বপ্নপূরণের জন্য যে চাকরি ছেড়ে হিরের খোঁজে আফ্রিকার অরণ্যে বেরিয়ে পড়েছিল। আর বাংলার প্রতিশ্রুতিমান গোলরক্ষক চাকরি ছেড়েছেন ফুটবলার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য।
ফুটবলার শঙ্করের স্বপ্নপূরণ হবে কি না, তা অবশ্য সময়ই বলবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy