ড্র ম্যাচে মাঠে হিট ফিকরু-মাতেরাজ্জি ডুয়েল। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস
বার্লিনের সেই বিশ্বকাপ ফাইনালে জিনেদিন জিদান তাঁকে ‘হেডবাট করার পর আহত মার্কো মাতেরাজ্জি বলেছিলেন, “জিদান জিদানই। ওর মাথাটা গরম হয়ে গিয়েছিল বলে ওটা করে ফেলেছে!”
শুক্রবার যুবভারতীতে ফিকরু তেফেরাকে হাল্কা টোকায় মাথা ফাটিয়ে দেওয়ার পর সেই মাতেরাজ্জি-ই উঠে যেতে চাইলেন মাঠ থেকে। বসে যেতে চাইলেন রিজার্ভ বেঞ্চে!
বিশ্বকাপজয়ী ডিফেন্ডারের কার্ড থেকে বাঁচার কৌশলী স্ট্র্যাটেজি কাজে লাগল। কড়া রেফারি প্রতাপ সিংহ-ও ঝুঁকি নিলেন না। যাঁকে দেখতে লোকে স্টেডিয়ামে ভিড় করেছে, তাঁকে কার্ড দেখানো ঠিক হবে কি না ভেবেই হয়তো সংযত থাকলেন ফিফা প্যানেলের প্রতাপ। চোট না পেলে ইতালিয়ান ‘লকগেট’ হয়তো ম্যাচের শেষ পর্যন্ত মাঠেই থেকেও যেতেন।
জিদানের সঙ্গে ফিকরুর কোনও অর্থেই কোনও তুলনা হয় না। কিন্তু আট বছর আগে আর পরের দুটো ঘটনা বোঝাল, প্রকৃত পেশাদার পেশার তাগিদে সর্বত্রই পেশাদার। তা সে বিশ্বকাপ ফাইনাল হোক কিংবা প্রথম আইএসএল!
জিদানকে সে দিন প্রতি মুহূর্তে উত্তেজিত করেছিলেন, এ দিন করে গেলেন ফিকরুকে— মাতেরাজ্জির পেশাদারিত্বে দু’জনই শেষ পর্যন্ত অন্ধকারে পড়ে রইলেন। জিদান কাপ হারিয়েছিলেন। ফিকরু গোল হারালেন।
মহাতারকার টানে যে মাঠে দর্শক আসে সেটা বুঝিয়ে দিল শুক্রবারের ম্যাচও। দেল পিয়েরোকে দেখার জন্য এসেছিলেন পঁয়ষট্টি হাজার। তার পর গ্যালারিতে দর্শক আসার গ্রাফ ক্রমশ নামতে শুরু করেছিল। সেটা ফের উর্দ্ধমুখী। যুবভারতীতে এ দিন উপস্থিত হাজার পঞ্চাশেক দর্শক দেখতে এসেছিলেন দু’জনকে মাঠে মার্কো মাতেরাজ্জি আর গ্যালারিতে অমিতাভ বচ্চন।
মাতেরাজ্জি মাঠে নেমে পয়েন্ট নিয়ে টিম হোটেলে ফিরলেন। কিন্তু বিগ বি-কে স্বচক্ষে দেখার সুযোগ হল না বেশির ভাগ দর্শকের। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে হল স্টেডিয়ামের জায়ান্ট স্ক্রিনে চোখ রেখে। ভিআইপি গ্যালারির দর্শকরা দূর থেকে মোবাইলে আপ্রাণ চেষ্টা করে গিয়েছেন বচ্চনের ছবি তোলার। কেউ কেউ তুলতে পেরেছেন ধাক্কাধাক্কি করে। বেশির ভাগই হতাশ হয়েছেন। যুবভারতীতে টুর্নামেন্ট উদ্বোধন দিনের মতোই সারাক্ষণ গ্যালারিতে বসে রইলেন অমিতাভ। তাঁকে খোলা জিপে মাঠ প্রদক্ষিণের জন্য রাজি করাতে পারলেন না সংগঠকেরা। অনেক চেষ্টা করেও। বাবার মাঠে নেমে চক্কর দেওয়ার ব্যাপারে আপত্তি ছিল নাকি ছেলে অভিষেকেরও। আটলেটিকো প্রতিশ্রুতি শেষ পর্যন্ত মাঠেই মারা গেল। ইয়ান বিশপ, শোয়েব আখতাররা ভারত-শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট ম্যাচের ধারাভাষ্য দেওয়ার পরের দিন এসেছিলেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের ফুটবল টিমের খেলা দেখতে। তাঁরা স্পনসর-চ্যানেলের আমন্ত্রণে মাঠেও নেমেছিলেন। এশিয়ার বৃহত্তম স্টেডিয়াম দেখে প্রতিক্রিয়া জানাতে। অমিতাভের জন্য জমিয়ে রাখা উচ্ছ্বাস তাই ওই দুই প্রাক্তন বিদেশি ক্রিকেটারদের জন্যই গ্যালারি থেকে বরাদ্দ হল।
যুবভারতীতে আন্তোনিও হাবাসের দল শেষ জিতেছে সেই আইএসএল উদ্বোধনের দিন। তার পর ঘরের মাঠে শুধুই অন্ধকার। পয়েন্ট খোয়ানোর সিরিজ চলছে। হার কিংবা ড্র। টানা চার ম্যাচে জয় নেই। হয়তো স্টেডিয়ামের বিশ্রী কৃত্রিম টার্ফ বদ্ধভূমি হয়ে উঠেছে হাবাসের টিমের কাছে। দেশের ফুটবলমহল জুড়ে কলরব ওই মাঠে খেলা মানেই চোট-আঘাত। আহত হওয়া। তার সঙ্গে এ দিন বাড়তি সংযোজন ম্যাচ চলাকালীন আচমকা স্টেডিয়ামের একটি অংশের আলো নিভে যাওয়া। মিনিট বারো মিনিট বন্ধ থাকল খেলা!
এক মাস হয়ে গেল আইপিএলের। দেশের কোনও শহরের মাঠে কখনও আংশিক অন্ধকারও নামেনি এক সেকেন্ডের জন্য। এ দিন সল্টলেক স্টেডিয়ামে আলো-বিভ্রাটের কারণ নাকি জেনারেটরের যান্ত্রিক ত্রুটি! যাতে অর্ধেক মাঠে অন্ধকার নেমে এল মুহূর্তে। দু’বছর আগে কলকাতা লিগে ইস্টবেঙ্গল-বিএনআর ম্যাচের পর আবার মুখ পুড়ল কলকাতার। যুবভারতীতে ম্যাচের মাঝে ঝুপ করে আলো নিভে যাওয়াটা যেন দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ দিন মাঠে এসেছিলেন ক্রীড়ামন্ত্রী মদন মিত্র। যাওয়ার সময় প্রতিবারই আলো নেভার পর যা বলেন এ বারও তাই বললেন, “কেন এমন হল তদন্ত করে দেখতে বলেছি।” সঙ্গে আনলেন সেই ইঁদুর তত্ত্ব। সবাই জানে সেই তদন্ত রিপোর্ট তৈরি হবে না। তবুও বলা! সাফাই গাইতে হয় বলেই।
টুর্নামেন্টের এক বনাম দু’নম্বরের লড়াই। ভাবা গিয়েছিল ম্যাচটা ধুন্ধুমার হবে। লড়াই হবে ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে। সেটা হয়েও হল না, দুই কোচের বাড়তি সতর্কতার জন্য। অঙ্ক কষে টিম নামানোর কারণে। কড়া ট্যাকল, ধাক্কাধাক্কি, পারস্পরিক তেড়ে যাওয়া ছিল।তার মধ্যে ভাল মুভও যে গোটা দুয়েক হয়নি তা নয়। তবে ওইটুকুই। নিট ফল, লিগ টেবিলে আপাতত অ্যাডভান্টেজ এফসি পুণে। আজ শনিবার নর্থইস্ট ইউনাইটেডকে হারালেই হাবাস-মাতেরাজ্জি, দু’জনের দলকেই টপকে যাবেন ত্রেজেগুয়েরা।
অথচ ম্যাচের আকাশে রামধনু তৈরির জন্য অনের রং ছিল। ম্যাঞ্চেস্টারের দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাবের তিন জন একই টিমের জার্সিতে খেললেন। ম্যান ইউয়ের জেম্বা জেম্বা, সিলভেস্ত্রের সঙ্গে ম্যান সিটির এলানো ব্লুমার, ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের সব তিক্ততা ভুলে নেমেছিলেন চেন্নাইয়ানের নীল জার্সিতে। আবার এল ক্লাসিকোর দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বার্সেলোনা আর রিয়াল মাদ্রিদের তিন ফুটবলার গার্সিয়া, হোফ্রে, বোরহা নেমেছিলেন আটলেটিকো দে কলকাতার লাল-সাদা জার্সিতে। এত এত তারকা, তবু সেই চোখের আরামদায়ক ফুটবল হল কই? অতি সাবধানী কোচেদের স্ট্র্যাটেজির জাতাকলে পড়ে সব রং-ই যে খতম!
চেন্নাইয়ের ফ্রি কিক মাস্টার এলানোর পিছনে কলকাতার নাতো আর বোরহা লেগে রইলেন স্টিকারের মতো। বল স্ন্যাচ করে হেলেন সারাক্ষণ। আইএসএলের সর্বোচ্চ গোলদাতাকে কিছুতেই যে নিজেদের বক্সের আশেপাশেই আসতে দিতে চান না কলকাতার স্প্যানিশ কোচ। জোনাল মার্কিংয়ের ফাঁদ পেতে ব্রাজিলিয়ান বিশ্বকাপারকে বন্দি রাখার করার চেষ্টা চালাল কলকাতা। সফলও হল। এলানো সে ভাবে নজরেই পড়লেন না। আর শুরুতে গার্সিয়াকে ছেড়ে রাখলেও পরে তাঁকে ধরার জন্য খেলতে খেলতেই মিডিও জেম্বা জেম্বাকে ডাকটিকিট করে দিলেন মাতেরাজ্জি। ফিকরুর জন্য চেন্নাইয়ান কোচ-কাম-ফুটবলার নিজে তো ছিলেনই। খেলাটা সে জন্যই সত্তর মিনিট মাঝমাঠেই ঘোরাফেরা করল।
গ্যালারিতে অভিষেক বচ্চন চিত্কার করে গেলেন। হতাশায় মাথা চাপড়ালেন। মাঠের মধ্যে আবার বেঞ্চে বসে হাবাস হাত-পা ছুড়লেন। চেঁচামেচি করে গেলেন ফিকরুদের গোল মিস দেখে। গার্সিয়ার ফ্রি কিক পোস্টে লেগে ফেরার পর সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের মুখ আরও গম্ভীর হল। শিশু দিবসের দিনে মনমরা হয়ে যে ফিরতে হল তাঁকে। অমিতাভ-অভিষেকের মতোই।
সেই ডিজে কিন্তু চিল-চিত্কার করে গেলেন ম্যাচের আগাগোড়া। ‘জিতবে কে....জিতবে কে...?’ কিন্তু গোলশূন্য ড্র-এর পর সাড়া নেই যে কোনও গ্যালারিতেই। নিজেদের মাঠে প্রিয় টিমের বারবার ড্র আর হার দেখতে কারই বা ভাল লাগে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy