উল্লাস: সমর্থকরাই আমাদের আসল শক্তি। ছবি পোস্ট করে টুইট সালাহর।
ম্যাঞ্চেস্টার সিটির বিরুদ্ধে পেনাল্টি থেকে চেলসির উইলিয়ান গোলটা করার সঙ্গে সঙ্গে তিরিশ বছর আগের স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে উঠল। আমি তখন ইংল্যান্ডের ক্লাব কোলচেস্টার ইউনাইটেডে খেলছি। এখনও মনে আছে, দিনটা ছিল ২৮ এপ্রিল ১৯৯০। অ্যানফিল্ডে কুইন্স পার্ক রেঞ্জার্সের বিরুদ্ধে শুরুতে পিছিয়ে পড়ে দুর্দান্ত ভাবে ঘুরে দাঁড়ায় লিভারপুল। প্রথমার্ধ শেষ হওয়ার আগে গোল শোধ করে ইয়ান রাশ। দ্বিতীয়ার্ধে পেনাল্টি থেকে জন বার্নস ২-১ করতেই লিগ খেতাব নিশ্চিত হয়ে যায় লিভারপুলের। সম্ভবত আরও কয়েকটা ম্যাচ বাকি ছিল।
লন্ডনে লিভারপুলের সমর্থকের সংখ্যা এমনিতেই খুব বেশি নয়। তার উপরে আর্সেনাল, চেলসি, ওয়েস্ট হ্যাম সমর্থকদের দাপটে ওঁরা একটু গুটিয়ে থাকেন। কিন্তু সে দিন একেবারে অন্য ছবি দেখেছিলাম। লিভারপুলের পতাকা নিয়ে রাস্তায় অনেক রাত পর্যন্ত উৎসব করেছিলেন ভক্তরা। লিভারপুলের ভক্ত না হওয়া সত্ত্বেও আমি যোগ দিয়েছিলাম ওঁদের সঙ্গে। কারণ, বছরখানেক আগে ভয়াবহ হিলসবরো বিপর্যয়ের ক্ষতে কিছুটা প্রলেপ দিয়েছিল এই জয়।
লিভারপুলের ১৯তম লিগ জয়ের সময়েও পরিস্থিতি খুবই উদ্বেগজনক। করোনাভাইরাসের সংক্রমণে ইংল্যান্ডে প্রচুর মানুষের মৃত্যু হয়েছে। সারা পৃথিবীতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্ব জুড়ে মন্দা শুরু হয়েছে। এই লিগ জয় কিছু মানুষের অন্তত যন্ত্রণা লাঘব করবে। শুনলাম, করোনা-আতঙ্ক ভুলে উৎসবে মেতে উঠেছেন লিভারপুল সমর্থকেরা। এই জয় যে তিরিশ বছরের খরা কাটিয়ে মুক্তির আনন্দ এনে দিল! অস্ট্রেলিয়ায় পার্থে বসে মনটা একটু খারাপ হয়ে গিয়েছিল। এ রকম দিনে লন্ডনে থাকতে পারলে হয়তো একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ হত আমার। নিজে এক সময়ে প্রিমিয়ার লিগে খেলেছি বলে জানি, এই লিগের উত্তেজনার সঙ্গে কোনও কিছুর তুলনা হয় না।
স্বপ্নপূরণ: তিন দশকের অপেক্ষার অবসান। লিভারপুলের প্রিমিয়ার লিগ খেতাব নিশ্চিত হতেই অ্যানফিল্ডের বাইরে উৎসব শুরু সমর্থকদের। গেটি ইমেজেস
ইংল্যান্ডের ক্লাবগুলোর মধ্যে লিভারপুলই এখন পর্যন্ত সব চেয়ে বেশি বার (৬) ইউরোপ সেরা হয়েছে। অথচ ১৯৯২ সালে ইংল্যান্ডের লিগ ফুটবল নাম বদলে ইপিএল হওয়ার পর থেকে ট্রফি অধরাই থেকে গিয়েছিল ‘দ্য রেড্স’-এর। তিরিশ বছর অপেক্ষার পরে য়ুর্গেন ক্লপের হাত ধরে অবশেষে এল সাফল্য। তাই কেনি ডালগ্লিশের পরে ক্লপের নামও লিভারপুলের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। ইয়ান রাশ, জন বার্নসদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, লিভারপুলের এই দলটা অনেক বেশি শক্তিশালী ১৯৮৯-’৯০ মরসুমের চেয়ে। কারণ, অনেক বেশি কঠিন লড়াইয়ের মধ্যে পড়তে হয়েছে মহম্মদ সালাহদের। তা সত্ত্বেও সাত ম্যাচ বাকি থাকতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। এই সাফল্যের নেপথ্যে মূল কারিগর অবশ্যই য়ুর্গেন ক্লপ।
জার্মানির বরুসিয়া ডর্টমুন্ড ছেড়ে বছর পাঁচেক আগে ক্লপ যখন দায়িত্ব নিয়েছিলেন লিভারপুলের, অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। আমার পরিচিতেরাই বলেছিলেন, এক জন জার্মানের পক্ষে ইংল্যান্ডের ফুটবল সংস্কৃতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। ক্লপের কোচিংয়ে লিভারপুল আরও তলিয়ে যাবে। আমি তখন বলেছিলাম, গান, কবিতা, সাহিত্যের মতো ফুটবলেরও কোনও দেশ হয় না। আর এখন কোনও ক্লাবেই শুধু সেই দেশের ফুটবলারদের নিয়ে দল গড়া হয় না। দেখে নিয়ো, একটু সময় পেলেই ক্লপ নিজেকে প্রমাণ করবেন।
ক্লপকে দেখলে কখনওই ফুটবল ম্যানেজার বলে মনে হয় না। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর বলে অনেকেই ভুল করবেন। ওঁর মানসিকতাও অন্য রকম। সব সময় নতুন কিছু আবিষ্কারের চেষ্টায় মগ্ন। ক্লপের কোচিংয়ের ধরনও আলাদা। একটা সময়ে ইংল্যান্ডের ফুটবল ঘরানা ছিল, নিজেদের মধ্যে কম পাস খেলে দ্রুত আক্রমণে উঠে বিপক্ষের পেনাল্টি বক্সে স্ট্রাইকারদের উদ্দেশে বল ভাসিয়ে দেওয়া। আর্সেন ওয়েঙ্গার, আলেক্স ফার্গুসনের মতো ম্যানেজারের হাত ধরে ইংল্যান্ড ফুটবলের বিবর্তন হয়েছে। এখন বিশ্ব ফুটবলের দুই সেরা কোচ রয়েছে ইপিএলে। পেপ গুয়ার্দিওলা এবং য়ুর্গেন ক্লপ। ওঁদের ছোঁয়ায় ইপিএলে ফুটবল সৌন্দর্যময় হয়ে উঠেছে।
মহম্মদ সালাহদের খেলা যাঁরা নিয়মিত দেখেন, তাঁরা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন ৪-৩-৩ ছকে দল সাজালেও প্রতি ম্যাচেই খেলার ধরন বদলে ফেলছে লিভারপুল। শুধু তাই নয়, ম্যাচের মধ্যে বার বার রণনীতি বদলেও ক্লপ সমস্যায় ফেলে দিচ্ছেন বিপক্ষের কোচকে। এটা তখনই সম্ভব, যখন সেই দলের ফুটবলারদের সব রকম পরিস্থিতির সঙ্গে দ্রুত মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা থাকে। রক্ষণের ভার্জিল ফান ডাইক থেকে ফরোয়ার্ড রবের্তো ফির্মিনো— প্রত্যেকের এই দক্ষতা তৈরি হয়েছে ক্লপের অধীনে। ধীরে ধীরে নিজের মনের মতো করে দলটা সাজিয়ে নিতে পেরেছেন ক্লপ। লিভারপুলের তাই সাফল্য আসতে দেরি হলেও চ্যাম্পিয়ন্স লিগের পরে এ বার তিন দশকের খরা কাটিয়ে লিগ জয়ের স্বপ্নও সফল করল। এ নিয়ে লিভারপুল লিগ জিতল ১৯ বার। সামনে শুধু ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড, যারা জিতেছে ২০বার।
শুক্রবারই দেখছি আমার ইপিএল বন্ধুদের মধ্যে তর্ক শুরু হয়ে গিয়েছে, স্যর আলেক্স ফার্গুসনের সেই স্বপ্নের দৌড় কি ধরতে পারবে ক্লপের লিভারপুল? সময়ই বলে দেবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy