ফ্লেচারের ক্লাসে বিরাট। শুক্রবার কোটলায়। ছবি: পিটিআই
অযত্নে বেড়ে ওঠা খোঁচা খোঁচা দাড়ির গোমড়া মুখ দেখলে কে বলবে, এ ছেলেই এখন ভারতীয় ক্রিকেটের সেরা গ্ল্যামার-বয়?
দিল্লির ক্রিকেট সাংবাদিক মহলে খবর, অনুষ্কার সঙ্গে তাঁর হাই প্রোফাইল বিয়েটা এখনই না হলেও বাগদানপর্বটুকু নাকি সেরে ফেলতে চাইছেন তাড়াতাড়ি। কিন্তু বিরাট কোহলির অভিব্যক্তিতে সে সবের ছিটেফোঁটা ইঙ্গিত নেই। বরং শুক্রবার ফিরোজ শাহ কোটলার লাগোয়া প্র্যাক্টিস নেটে যে কোহলিকে পাওয়া গেল, তার মেজাজ দিল্লির দুপুরের রোদের চেয়েও চড়া। যেন রাগে ফুঁসছেন।
আর রাগটা বোধহয় নিজের উপর। ফর্মে নেই, বহু দিন হয়ে গেল। নেটে মাঝে মাঝেই স্টেপ আউট করে চার-ছক্কা মারছিলেন বিরাট। ব্যর্থ আক্রোশে না ফর্মে ফেরার মরণপণ চেষ্টায়, ধরা গেল না। শুক্রবার ঘরের মাঠে পা রাখা ও হোটেলে ফেরার টিম বাসে ওঠার মধ্যে কত বার যে তাঁর ব্যাটে রানের আকুতি শুনতে হল, হিসেব রাখা সম্ভব নয়। ড্রেসিংরুমের কর্মী থেকে শুরু করে ডিডিসিএ কর্তারা প্রায় সবাইকেই বলতে শোনা গেল, “বিরাটের ব্যাট কাল একটু চলুক...নইলে ইন্ডিয়ার কী যে হবে...।”
একে নিজেকে রানে ফেরানোর জন্য নিজের সঙ্গে লড়াই। তার উপর ভারতজোড়া প্রত্যাশার চাপ। অবস্থা দেখলে মনে হবে, কোহলির ঘাড়ের উপর যেন গোটা হিমালয়টাই চেপে বসেছে বুঝি। “একটা ইনিংস। ওর একটা ঝাঁ-চকচকে ইনিংসেই দেখবেন এ সব চাপ-ফাপ কোথায় হাওয়া হয়ে গিয়েছে,” বলছিলেন কোহলির ছোটবেলার কোচ রাজকুমার শর্মা। সচিনের কাছে টিপস নেওয়ার পর এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজ শুরুর আগে যাঁর ‘গুরুকুলে’ এক সপ্তাহ কাটিয়েছেন কোহলি।
ঘরের মাঠে শাপমুক্তি হবে?
তাঁর দুই দিল্লিওয়ালা সতীর্থের এক জনের কিন্তু ইতিমধ্যে হয়েছে, আর এক জনের এ দিন হল। শিখর ধবন আর ইশান্ত শর্মা। কোচি ওয়ান ডে-তে ব্যাট কথা বলেছে ধবনের। যিনি ফিরোজ শাহ কোটলায় ভারতের জার্সি গায়ে এই প্রথম নামতে চলেছেন। রাজধানীর ক্রিকেট মহলে ‘গব্বর সিংহ’ বলে খ্যাত ওপেনার সাংবাদিক বৈঠকে এসে বললেন, “নিজের মাঠে প্রথম দেশের জার্সি গায়ে নামার অনুভুতিটা অসাধারণ।” কিন্তু সেই বলার মধ্যে কোনও উচ্ছ্বাস বা উত্তেজনা কোনওটাই নেই। বোধহয় সম্ভবও নয়। টিমের প্রথম ম্যাচে অপ্রত্যাশিত হার, এক নম্বর ব্যাটসম্যানের অফ ফর্মে স্বস্তি থাকে কী করে? চাপ আছে কোনও? প্রশ্নটা শুনে শিখর একটু স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলেন, “চাপ আর কি? এত অন্য চাপ থাকে যে এই চাপগুলো নিয়ে আর ভাবাই হয় না।”
ইশান্তও বোধহয় ভাবেননি জাতীয় দলে ডাকটা এ ভাবে আসবে। গত এক বছরে মাত্র সাতটা ওয়ান ডে খেলে আটটা উইকেট পেয়েছেন ইশান্ত। আর সেই তিনিই কিনা মোহিত শর্মার চোটের জন্য ঢুকে পড়লেন ভারতীয় দলে। যে খবরে টুইটারে জোক ছড়িয়ে পড়ল, ‘ইশান্ত দলে! কী দরকার ছিল, ওয়েস্ট ইন্ডিজ তো এমনিতেই জিতছে।’
বোর্ডের প্রেস রিলিজ অনুযায়ী ‘বাইল্যাটারাল শিন পেইন’-এর জন্য গোটা সিরিজের বাইরে মোহিত শর্মা। ফলে অগত্যা ইশান্ত। সিদ্ধান্তটা নিতে এতটাই দেরি হল যে, সকাল দশটায় ভারত নেট প্র্যাকটিসে নামার আগেও ইশান্ত জানতে পারলেন না, তাঁকে পরের দিনই ঘরের মাঠে ভারতের জার্সি গায়ে নামতে হতে পারে। ফলে প্র্যাক্টিসেও নামা হল না তাঁর। শনিবার তাঁকে কোটলায় নামতে দেখা যাবে কি না, জানা নেই। তবে মোহিত ছিটকে যাওয়ার খবরেই হয়তো প্র্যাকটিসে বিশ্রাম দেওয়া হল মহম্মদ শামিকে। ডেথ বোলিংয়ের দায়িত্ব এ বার যাঁর উপর বর্তাবে। শামি নিজেও বললেন, “আজ অপশনাল প্র্যাকটিস ছিল বলে করিনি। বিশ্রাম নিয়েছি।”
তবে এই দুই দিল্লিওয়ালা নন। আলোচনাটা মুখ্য প্রথম দিল্লিওয়ালাকে নিয়েইবিরাট কোহলি। শোনা গেল, পশ্চিম দিল্লিতে বিরাটের পাড়া উত্তম নগর থেকে না কি শনিবার প্রচুর লোক মাঠে আসবেন তাঁদের ছেলের জন্য গলা ফাটাতে। ভারতের সিরিজে সমতা আনার চেয়েও বিরাট কোহলির রানে ফেরাটাই যে এই ম্যাচের থিম, বলা বাহুল্য। আর থিমটা বুঝতে পেরে কি না কে জানে, টগবগে আত্মবিশ্বাস সমেত ক্যারিবিয়ান অধিনায়ক ডোয়েন ব্র্যাভো দুপুরে প্রেস কনফারেন্সে প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়ে গেলেন, “আমরা আপনাদের কোহলির দুর্বলতা বুঝে ফেলেছি। শনিবার ফের সেই জায়গাতেই আক্রমণ করব। ও বড় ব্যাটসম্যান হতে পারে। নিজের জায়গায় ফিরেও আসুক, ক্ষতি নেই। কিন্তু এই সিরিজে নয়।” কোহলি মুখে চুপচাপ থাকলেও এ কথা শুনে তাঁর কোচ রাজকুমার শর্মা আর চুপ থাকতে পারলেন না। বলে দিলেন, “দেখুন, কালই না ওর ব্যাট ক্যারিবিয়ান ক্যাপ্টেনের মুখের উপর জবাব দেয়। আমার মন বলছে কালই সেই দিন।” কিন্তু ক্রিকেটের ব্যাকরণ কী বলছে? শর্মার বক্তব্য, “এই সিরিজের আগেই তো এক সপ্তাহ বিরাটকে নিয়ে প্র্যাকটিস করেছি। কোনও টেকনিক্যাল গলদ ওর ব্যাটিংয়ে নেই। যে টেকনিকে আগে ব্যাটে ঝড় তুলেছে, সেই টেকনিকেই খেলছে। সব খেলোয়াড়েরই এমন খারাপ সময় আসে। ওরও এটা ব্যাড প্যাচ যাচ্ছে। সব ঠিক হয়ে যাবে এবং সেটা খুব তাড়াতাড়ি।”
তা হলে বিরাট কি মানসিক চাপে? প্রসঙ্গটা তুলতেই রাজকুমার প্রায় ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, “জানেন, ২০০৬-এ ওর বাবার মৃত্যুর ঠিক পরেই এই মাঠে একটা রঞ্জি ম্যাচে ৯০ রানের অসাধারণ একটা ইনিংস খেলেছিল ও। আমার নিজের চোখে দেখা। শনিবারও সে রকমই একটা ইনিংস দেখার আশায় মাঠে যাব।”
শুক্রবার নেটে বেশ খানিকক্ষণ কোহলির সঙ্গে সময় কাটাতে দেখা গেল ‘ক্যাপ্টেন কুল’-কে। দেখে মনে হল, দলের ব্যাটিংয়ের প্রধান অস্ত্রের ধার ফিরিয়ে আনতে প্রবল চেষ্টায় নেমেছেন এমএসডি। দলের সবাই যে তাঁর পাশে, তা সাফ জানিয়ে দিয়ে শিখর ধবন বললেন, “বিরাট খুব দৃঢ় চরিত্রের ছেলে। এই অবস্থাতেও যে ভাবে ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে লড়ে যাচ্ছে বিরাট, এটাই অবাক করার মতো। ও ফর্মে ফিরবেই। আর খুব তাড়াতাড়িই।”
তাই শনিবার কোটলার ম্যাচের থিম যতটা না ভারতের সিরিজে সমতা আনার লড়াই, তার চেয়ে অনেক বেশি কোহলির ফর্মে ফেরার যুদ্ধ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy