সানরাইজার্স হায়দরাবাদ: ১৪২-৭ (২০ ওভারে)
কলকাতা নাইট রাইডার্স: ১৪৬-২ (১৮.২ ওভারে)
হাত মুঠো করে আকাশে ছোড়া। স্টাম্প তুলে নেওয়া। সতীর্থদের সঙ্গে সেলিব্রেশন। সাধারণত ম্যাচ জিতিয়ে ওঠা নায়ককে এর কোনও না কোনও একটা করতে দেখা যায়।
গৌতম গম্ভীরের থেকে এ সব আশা করা অবশ্য এপ্রিলের উত্তপ্ত কলকাতায় তুষারপাতের স্বপ্ন! কর্ণ শর্মাকে দিনের শেষ ও ম্যাচ নির্ণায়ক বাউন্ডারিটা মেরে কেকেআরের ক্যাপ্টেন প্রথমে বলের গতিপথটা দেখে নিলেন। তার পর আম্পায়ারের সঙ্গে ক্ষণিকের হ্যান্ডশেক, নন-স্ট্রাইকার মণীশ পাণ্ডের সঙ্গে একটু কথা। জয়ী অধিনায়ককে ম্যাচের পরে কিছু না কিছু বলতেই হয়। তার উপর তিনি ম্যান অব দ্য ম্যাচ। দুটো মিলিয়ে মেরেকেটে পাঁচ লাইন বললেন গম্ভীর। ব্যস। ওইটুকুই।
অন্য কোনও ক্যাপ্টেন হলে এ রকম একটা দিনে অবধারিত সাংবাদিক সম্মেলনে আসতেন। শিরোনামে নিজের অবস্থান আরও মজুবত করতেন। কিন্তু আর পাঁচ জন ক্যাপ্টেনের থেকে কলকাতার গৌতম যে আলাদা। একটু নয়, বেশ বেশিই। নিজে না এসে তাই পাঠিয়ে দিলেন সহ অধিনায়ক সূর্যকুমার যাদবকে। নিজের কলামে লেখা ছাড়া একটাও বেশি কথা এ দিন বলবেন বলে মনে হল না।
অথচ আজ তো তাঁরই বলার দিন। আজ গম্ভীর দেড়শো স্ট্রাইকরেট রেখে ৬০ বলে নব্বইয়ের অপরাজিত একটা ইনিংসই শুধু খেলে ওঠেননি, খেলে টিমকে সহজ একটা জয় এনে দিয়েছেন। আইপিএল নাইনে তিন ম্যাচে তাঁর রান ইতিমধ্যেই প্রায় দুশো। শনিবার সন্ধের পর আপাতত তিনি সম্মানের কমলা টুপির মালিক। আর এমন একটা দিনের পরেও গৌতম কিনা গম্ভীর!
নাইট অধিনায়কের ঘনিষ্ঠমহলে কারও কারও সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ব্যাপারটা তাঁদের অন্তত একটুও আশ্চর্যের লাগেনি। জানা গেল, নাইট অধিনায়কের অসম্পূর্ণ একটা বাসনার কথা। যেটাকে নাকি ‘আনফিনিশড জব’ বলে অভিহিত করেন গম্ভীর। যে কাজ সম্পূর্ণ করতে গেলে এক দিন নয়, আইপিএলের প্রত্যেকটা ম্যাচেই হয়তো এ রকম একটা করে ইনিংস খেলতে হবে তাঁকে। এখন আইপিএল-পক্ষে তাঁর শয়নে-স্বপনে কেকেআর, ঠিক। কিন্তু টিমকে তৃতীয় ট্রফি এনে দেওয়ার পাশাপাশি গৌতম গম্ভীর তো আরও একটা বৃহত্তর যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। জাতীয় জার্সি ফিরে পাওয়ার যুদ্ধ। আর সেই যুদ্ধ জিততে গেলে তো আরও কয়েকটা ষাট বলে নব্বই দরকার!
দু’বছর আগে ইংল্যান্ড সফরের টেস্টে শেষ দেশের হয়ে খেলেছেন গম্ভীর। চার ইনিংস মিলিয়ে স্কোর পঁচিশ। তার পর থেকে শুধু আইপিএলে আটকে থাকতে হয়েছে। তবু নাইট অধিনায়ক নাকি মনে করেন, ইন্ডিয়া ক্যাপ ফিরে পাওয়াটা স্বপ্ন নয়, সম্ভব। নাইট অধিনায়ক নাকি মনে করেন, দেশের হয়ে অন্তত একটা শেষ ইনিংস এখনও বাকি আছে তাঁর মধ্যে।
না হলে ঘরবাড়ি ছেড়ে দিনের পর দিন সুদূর পারথে পড়ে থাকেন! তেত্রিশের শরীরকে জিমন্যাস্টিক্স, মার্শাল আর্টসের রগড়ানিতে ডুবিয়ে দেন! এই তো গত বছর আইপিএলের পরপরই অস্ট্রেলিয়া পাড়ি দিয়েছিলেন গম্ভীর। জাস্টিন ল্যাঙ্গারের স্পেশ্যাল কোচিং ক্লাস করবেন বলে। ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া এবং পারথ স্কর্চার্সের কোচ ল্যাঙ্গারের সঙ্গে তাঁর দেখা ২০১৪ চ্যাম্পিয়ন্স লিগে। তার চার বছর আগে ছোটবেলার কোচ পার্থসারথি শর্মা মারা গিয়েছেন, ব্যক্তিগত কোচের খোঁজে ঘুরছিলেন গম্ভীর। কয়েক দিন ডব্লিউ ভি রামনকে কোচ হিসেবে দেখে নিয়েছিলেন, কিন্তু প্রিয় ‘জেএল’-এর সঙ্গে যে সম্পর্কটা এত স্বচ্ছন্দে এত তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে যাবে, ভাবতে পারেননি।
ব্রেকফাস্ট টেবল থেকে নেট সেশন— দুই বাঁ-হাতির সম্পর্ক ক্রমশ গভীর হয়েছে। এবং গম্ভীরের ক্রিকেটে সঞ্চারিত হয়েছে নতুন প্রাণ। গম্ভীর নাকি সব সময় চেয়েছিলেন, শর্ট বল মোকাবিলায় আরও অনায়াস হতে। ল্যাঙ্গারের ক্লাসে যেটা বারবার ঝালিয়ে নিয়েছেন। ল্যাঙ্গার নাকি তাঁকে বলেন, ‘তোমার চোখ যা দেখতে পাচ্ছে, তোমার হাত সেটা মারতে পারবেই।’ যে পরামর্শ মেনে নিজের স্টান্স আর একটু ওপেন করেছেন নাইট অধিনায়ক। শট খেলতে সুবিধে হচ্ছে, তিনি নিজেও নাকি অনেক স্বচ্ছন্দ বোধ করছেন।
নতুন স্টান্সে তিনি কতটা স্বচ্ছন্দ, এ দিন ভালই বুঝল ডেভিড ওয়ার্নারের সানরাইজার্স। চুয়াল্লিশ ডিগ্রি ছুঁইছুঁই গরমে টানা দেড় ঘণ্টার ইনিংসে একটা কেন, অর্ধেক সুযোগও বিপক্ষকে দেননি গম্ভীর। মুস্তাফিজুর ‘দ্য ফিজ’ রহমানের দেরিতে সুইং করা ইয়র্কারে বিসদৃশ ভাবে মিডল স্টাম্প সহ মাটিতে লুটোপুটি খেয়েছেন আন্দ্রে রাসেল। কিন্তু তিনি, গম্ভীর অবিচল ভাবে এগিয়ে গিয়েছেন নিজলক্ষ্য পূরণের রাস্তায়। কর্ণ শর্মার একটা ওভারে তিনটে বাউন্ডারি মেরেছেন, কিন্তু এক মুহূর্তের জন্য বাড়তি ঝুঁকি নেননি। উইনিং স্ট্রোকটা মারার জন্যেও তাড়াহুড়ো করেননি। দু’দলের স্কোর যখন এক, ওভারের প্রথম বলটা মিডল স্টাম্পের দিকে আসছে দেখে সযত্নে ব্লক করেছেন!
হায়দরাবাদের রান্না যত মশলাদার, হায়দরাবাদের এই টি-টোয়েন্টি টিমের বোলিংয়ে যেন ততটাই মশলার অভাব। একা মুস্তাফিজুরকে বাদ দিলে যাঁরা পড়ে থাকেন, সেই ভুবনেশ্বর কুমার, বারিন্দর স্রান, কর্ণ শর্মা, মোজেস এনরিকেদের কাউকেই ম্যাচ জেতানো বোলারের আখ্যা দেওয়া যাবে না। কিন্তু তাতে গম্ভীরের ইনিংসের একটা রানেরও গুরুত্ব কমে যায় না। কারণ তাঁর প্রতিপক্ষ তো শুধু আজকের হায়দরাবাদ বা সে দিনের মুম্বই নয়। তাঁর যুদ্ধ যে একটা ম্যাচের নব্বইয়ে শেষ হওয়ার নয়।
শনিবারের জয়-উত্তর যুযুধান দু’পক্ষের তুলনামূলক অবস্থানে গম্ভীর হয়তো কিছুটা এগিয়ে। কিন্তু এটা সাময়িক যুদ্ধবিরতি মাত্র। আজ বাদে কাল ফের লড়াই শুরু। এক দিকে ব্যাট-প্যাড নিয়ে গৌতম গম্ভীর। উল্টো দিকে তাঁর ‘পুরনো শত্রু’। যা আসে নানা রূপে, নানা জার্সিতে। কখনও মিচেল জনসন, কখনও জসপ্রীত বুমরাহ! আসলে যে বাউন্সার হাতে তাঁর দিকে বারবার তেড়ে আসে ক্রিকেট-নিয়তি স্বয়ং!
আরও পড়ুন:
আইপিএলের সময়সূচি
আইপিএলের পয়েন্ট টেবল
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy