আকর্ষণ: গোলের পরে বিশেষ নাচ কোলাদো এবং জবির। নিজস্ব চিত্র
ম্যাচ শেষ হওয়ার পরে কখনও গ্যালারির সামনে গিয়ে ভাংরা নাচছেন। কখনও শিখর ধওয়নের ভঙ্গিতে গোঁফে তা দিচ্ছেন। ফটোগ্রাফারদের অনুরোধে অদৃশ্য বন্দুক হাতে ছবিও তুললেন। জবি জাস্টিন কী করবেন যেন বুঝতেই পারছিলেন না।
ইস্টবেঙ্গলের জয়ের নায়ক শান্ত হলেন ড্রেসিংরুমে ফিরে। আই লিগে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পথে যে এখনও অনেক কাঁটা ছড়িয়ে রয়েছে। কোচ আলেসান্দ্রো মেনেন্দেস গার্সিয়া ম্যাচের পরেই সবাইকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ডার্বি এখন অতীত। তাই মোহনবাগানকে হারিয়ে উচ্ছ্বাসে ভেসে গেলে চলবে না। জবিও তাই নিজেকে গুটিয়ে নিলেন। কিন্তু লাল-হলুদ সমর্থকদের কাছে টানা দু’টো ডার্বিতে মোহনবাগানকে হারানো আই লিগ জয়ের চেয়েও যেন বেশি। স্টেডিয়াম থেকে বেরনোর সময় ভক্তেরা ঘিরে ধরলেন। ঠিক ছিল যুবভারতী থেকে সোজা করুণাময়ীর ফ্ল্যাটে ফিরবেন জবি। কিন্তু ডার্বির নায়ককে স্টেডিয়ামের কাছেই নিজের ফ্ল্যাটে টেনে নিয়ে গেলেন এক বন্ধু। সঙ্গে দুই গোলরক্ষক উবেইদ সিকে ও মির্শাদ কে। বলছিলেন, ‘‘এ রকম অসাধারণ পারফরম্যান্সের পরে জবিকে না খাইয়ে ছাড়া যায় নাকি।’’ বন্ধুদের আবদার শেষ পর্যন্ত ফেলতে পারেননি আই এম বিজয়নের ভক্ত। রবিবাসরীয় রাতে জবিদের ডার্বি জয়ের সেই উৎসবের একমাত্র সাক্ষী আনন্দবাজার।
বসার ঘরের টেলিভিশনে তখন আইএসএলে মুম্বই সিটি এফসি বনাম বেঙ্গালুরু এফসি ম্যাচ চলছে। ছোট্ট ডিভানে বসে খেলা দেখছিলেন জবি। উবেইদ ও মির্শাদ টেনে তুললেন লাল-হলুদ জনতার নয়নের মণিকে। মুখে গুজে দিলেন চকোলেট। জবি বলার চেষ্টা করছিলেন, কোচ মেনেন্দেস ও ফিজিক্যাল ট্রেনার কার্লোস নোদার বেশি মিষ্টি খেতে বারণ করেছেন। কিন্তু এমন দিনে জবির আপত্তি কে শুনবে। জোর করে দুই বন্ধু খাইয়ে দিলেন চকোলেট।
আরও পড়ুন: এর পরে খেতাবের স্বপ্ন আর অধরা নয়
শুধু চকোলেট দিয়ে ডার্বির জয়ের উৎসব! জবি বললেন, ‘‘না না, চিকেন রান্না হচ্ছে। ডিনারে আজকের মেনু ডাল, চিকেন, আর রুটি।’’ আর কিছু নয়? লাল-হলুদ স্ট্রাইকারের জবাব, ‘‘কার্লোস আমাদের যে ডায়েট চার্ট বানিয়ে দিয়েছেন, তা মেনে চলতেই হবে। এখনও অনেক খেলা বাকি। কোনও ঝুঁকি নেওয়া চলবে না।’’
মোহনবাগানের বিরুদ্ধে আগের ডার্বিতে অ্যাক্রেবেটিক ভলিতে গোল করেছিলেন। রবিবার দুরন্ত হেডে বল জড়িয়ে দিলেন জালে। পরপর দু’টো ডার্বিতে অসাধারণ পারফরম্যান্সের রহস্য কী? জবির কথায়, ‘‘আগের ডার্বিতে গোলের পরে আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়ে গিয়েছিল। নিজের কাছেই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, ফিরতি ডার্বিতেও গোল করব।’’ অনেক বিখ্যাত ফুটবলার নাকি ডার্বির আগে অসম্ভব স্নায়ুচাপে ভুগতেন। আপনারও কী তাই হয়েছিল? হাসতে হাসতে লাল-হলুদ স্ট্রাইকার বললেন, ‘‘আমি বরং চাপ উপভোগ করি। মনে করি, চাপে পড়লেই আমার সেরা খেলাটা বেরিয়ে আসবে।’’
শুধু গোল করা নয়। প্রথমার্ধে খাইমে সান্তোস কোলাদোর গোলের নেপথ্যেও জবি। শরীরের দোলায় মোহনবাগানের দুই ডিফেন্ডারকে ছিটকে দিয়ে পেনাল্টি বক্সে ঢুকে পাস দিয়েছিলেন কোলাদোকে। ঠান্ডা মাথায় নিখুঁত প্লেসিংয়ে বল জালে জড়িয়ে দেন কোলাদো। স্ট্রাইকারদের সম্পর্কে অভিযোগ রয়েছে, তাঁরা নাকি স্বার্থপর হন। নিজেরাই চেষ্টা করেন গোল করার। আপনি তো নিজেই গোল করতে পারতেন। তা না করে কোলাদোকে পাস দিলেন কেন? জবি বললেন, ‘‘আমি মারলে বলটা গোলে না-ও ঢুকতে পারত। কোলাদো আমার চেয়ে অনেক ভাল জায়গায় ছিল। তাই ওকেই পাস দিয়েছিলাম। তা ছাড়া কে গোল করল তা গুরুত্বপূর্ণ নয়। আসল হচ্ছে দলের জয়।’’ তিনি যোগ করলেন, ‘‘আমাদের কোচ সব সময় বলেন, নিজের নয়, দলের জন্য খেলো। যে কোনও দলের সাফল্যের নেপথ্যে দলগত সংহতি।’’
কোলাদোর সঙ্গে মাঠের বাইরেও দুর্দান্ত বোঝাপড়া জবির। সতীর্থকে ভাংরা শিখিয়েছেন তিনিই। বললেন, ‘‘ইন্ডিয়ান অ্যারোজের বিরুদ্ধে ম্যাচের আগে যখন ড্রেসিংরুমে কেউ ছিল না, তখন কোলাদোকে ভাংরা শিখিয়েছিলাম। বলেছিলাম, গোল যেই করুক, দু’জনে মিলে ভাংরা নাচব।’’ হাসতে হাসতে যোগ করলেন, ‘‘কোলাদো শুধু ভাল ফুটবলারই নয়, দুর্দান্ত নাচে। তাই বেশি কষ্ট করতে হয়নি আমাকে। দ্রুত নাচটা তুলে নিয়েছে। রবিবারও জবি-কোলাদোর নাচ মাতিয়ে দিয়েছিল যুবভারতী।
কেরলের তিরুঅনন্তপুরমে জন্ম জবির। মাত্র দু’বছর কলকাতায় খেলছেন। ভাংরা শিখলেন কোথায়? জবির জবাব, ‘‘ছোটবেলা থেকে দু’টো জিনিসে আমার সব চেয়ে আগ্রহ। ফুটবল ও নাচ। কোথাও মিউজিক শুনলেই নাচতে শুরু করে দিতাম।’’ এখনও কী সেই অভ্যাস রয়েছে? ‘‘রাস্তায় নাচার সুযোগ এখন কম। তাই ঘরের মধ্যেই নাচি’’, বললেন জবি।
জবিকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত কোচ আলেসান্দ্রোও। সাংবাদিক বৈঠকে তিনি বললেন, ‘‘জবি এই ছন্দ ধরে রাখতে পারলে জাতীয় দলে অবশ্যই সুযোগ পাবে।’’
৭৫ মিনিটে জবি যে গোলটা করলেন, তা নিয়ে উত্তাল ফুটবলমহল। ধনুক থেকে যে ভাবে তির বেরিয়ে আসে, ঠিক সে ভাবে মোহনবাগানের রক্ষণের চক্রব্যূহ ভেঙে বেরিয়ে জবি হেড করেছিলেন লালরিন্দিকা রালতের কর্নার থেকে উড়ে আসা বলে। উচ্ছ্বসিত শ্যাম থাপা বলছিলেন, ‘‘জবি খুব ভাল হেডার নয়। কিন্তু ও জানে কখন, কোথায় পৌঁছলে বলটা পাবে। অসম্ভব সুযোগসন্ধানী।’’
জবি শোনালেন গোলের অন্য কাহিনি। বললেন, ‘‘আমরা জানতাম, পেনাল্টি বক্সের মধ্যে মোহনবাগানের ডিফেন্ডারেরা নানা ভাবে আটকানোর চেষ্টা করবে। কী ভাবে সেই বাধা টপকাতে হবে দু’দিন ধরে গোপনে তার অনুশীলনই আমরা করেছিলাম সল্টলেকের সাই কমপ্লেক্সে।’’ ২৫ জানুয়ারির আনন্দবাজারেই প্রকাশিত হয়েছিল, ফুটবলারদের ক্ষিপ্রতা বাড়াতে আলেসান্দ্রো ও কার্লোস এসএকিউ ট্রেনিং করিয়েছিলেন। রবিবাসরীয় যুবভারতীতে তারই ফলশ্রুতি জবির দুরন্ত গোল।
পরপর দু’টো ডার্বিতে ইস্টবেঙ্গলের জয়ের নায়ক। ইতিমধ্যেই অনেকে জবির সঙ্গে বিজয়নের মিল খুঁজে পাচ্ছেন। লিয়োনেল মেসির ভক্ত লাল-হলুদ স্ট্রাইকার শুনেই দু’কানে হাত দিয়ে জিভ বার করে বললেন, ‘‘বিজয়ন কিংবদন্তি। আমি এখন শিখছি।’’
তবে উৎসবের রাতেও প্রিয় সাইকেল খোয়া যাওয়ার যন্ত্রণা কাঁটার মতে বিঁধে রয়েছে জবির মনে। বললেন, ‘‘ফ্ল্যাটের নীচেই সাইকেল রাখা ছিল। নেমে দেখলাম লক ভেঙে কেউ সেটা চুরি করে নিয়ে গিয়েছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy