বাদশা: ইস্টবেঙ্গল জার্সি গায়ে কলকাতায় অভিষেকেই নায়কের সম্মান পয়েছিলেন মজিদ বিসকার। ফাইল চিত্র
ডার্বি ম্যাচ মানেই আমার কাছে মুঠো মুঠো স্মৃতি। ডার্বি মানেই আমার মনে পড়ে ইরান থেকে আমার সঙ্গে ভারতে পড়তে এসে ফুটবলার হয়ে যাওয়া মজিদ বিসকারের কথা। আমার জীবনের একটা বড় অধ্যায় হিসেবে জুড়ে রয়েছে এই মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ডার্বি।
মজার ব্যাপার এটাই যে আমি যখন কলকাতা ময়দানে ফুটবল খেলতাম, তখন ডার্বি ম্যাচ বলতে মোহনবাগান বনাম ইস্টবেঙ্গল ম্যাচটাকেই শুধু বোঝাত না। কারণ, কলকাতায় তখন ছিল তিনটি বড় দল—মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল ও মহমেডান স্পোর্টিং। লাল-হলুদ ও সাদা-কালো জার্সি গায়ে আমি ও মজিদ অনেক স্মরণীয় ম্যাচ খেলেছি। ফলে আমরা একটা নয়। দুটো ডার্বিই খেলেছি কলকাতায়। তবে সন, তারিখ এখন মন থেকে অনেকটাই মুছে গিয়েছে। কিন্তু ডার্বি নিয়ে অম্লমধুর অনেক ঘটনাই মনে জেগে রয়েছে আজও।
মনে পড়ছে ১৯৭৯ সালের একদম শেষ দিকে প্রথম বার কলকাতায় এসেছিলাম আমি আর মজিদ। ইডেনে মোহনবাগানের বিরুদ্ধে ইস্টবেঙ্গল জার্সি গায়ে আমার কেরিয়ারের শুরুতে যে ম্যাচের কথা আজও ভুলব না, সেটি হল ১৯৮০ সালের ১৬ অগস্টের সেই অভিশপ্ত ম্যাচ। যে ম্যাচ কেড়ে নিয়েছিল একাধিক ফুটবলপ্রেমীর তাজা প্রাণ। এখনও মনে পড়ছে, দ্বিতীয়ার্ধে যখন একটি ফাউলকে কেন্দ্র করে ওই ঘটনার সূত্রপাত, তার কিছু পরেই গ্যালারিতে দর্শকদের দেখে মজিদ আমার কাছে এসে জানতে চেয়েছিল, বড় কিছু ঘটেছে কি? আমিই বরং ওকে বলি, না বোধহয়। তুই মন দিয়ে খেল। পরে বুঝেছিলাম, আমার সতীর্থ মজিদের ফুটবলের মতো অন্য ব্যাপারেও চোখ-কান আমার চেয়েও খোলা। পরের দিন কাগজে মর্মান্তিক ওই ঘটনার বিবরণ পড়ে আমরা দু’জনেই কেঁদে ফেলেছিলাম।
শুরুর দিকে ইস্টবেঙ্গলে মজিদের ম্যাজিক খুব কাছ থেকে দু’চোখ ভরে দেখেছি আমি। আর গ্যালারিতে বসে দেখেছে কলকাতার দর্শক। একটা বড় ম্যাচে মনে পড়ছে মোহনবাগানের এক মিডফিল্ডার মজিদকে লক্ষ্য করে একটা কড়া ট্যাকল করতে এগোচ্ছিল। কিন্তু মজিদ তার আগে আলতো টোকা মেরে বলটাকে শূন্যে এমন ভাবে ভাসিয়ে দিল যে তা বিপক্ষের গোলের দিকেই যাবে। আর নিজে গেল সরে। বেচারা মিডফিল্ডার ওকে মারতে গিয়ে, নিজেই চোট পেয়ে বাইরে চলে গেল। মজিদ যে কত বড় খেলোয়াড় ছিল, তা বলে বোঝানো যাবে না। ওর চোরা গতিটা অনেকেই বুঝতে পারত না। আটাত্তরে ইরানের বিশ্বকাপ স্কোয়াডে ছিল ও। কলকাতা ফুটবলে তার পরে অনেক বিদেশিকে আমি খেলতে দেখেছি। চিমা, এমেকা, স্টিভন, ওকোরো, জুনিয়র, ইগর, ব্যারেটো থেকে এ কালের সনি নর্দে। কিন্তু আমার কাছে ডার্বির বাদশা একজনই। সে হল, আমার বন্ধু মজিদ বিসকার। ও বল পেলে ধনুক থেকে তির বেরোনোর মতো ছিটকে বেরিয়ে যেত বিপক্ষ ডিফেন্ডারকে পিছনে ফেলে। গতিতেই পিছনে ফেলত ভারতের বাঘা বাঘা ডিফেন্ডারকে। পায়ে ছিল গোলার মতো শট। বল কন্ট্রোল দেখলে মনে হত বল পায়ে আঁঠা দিয়ে লাগানো আছে। আর ছিল অসম্ভব অনুমানক্ষমতা। বল কোথায় যাবে বা ডিফেন্ডার কোন জায়গা থেকে কতটা পা বাড়াবে ট্যাকলের আগেই তা বুঝতে পারত মজিদ। একটা ঈশ্বরপ্রদত্ত ক্ষমতা ছিল ওর। বিপক্ষ ডিফেন্ডাররা মজিদকে দেখলেই তাই ভয়ে কুঁকড়ে যেত।
এ প্রসঙ্গে আমার মনে পড়ছে মোহনবাগান বনাম ইস্টবেঙ্গলের একটা ম্যাচের কথা। খুব সম্ভবত খেলাটা ছিল রোভার্স কাপে। মাঠে নামার আগে আমরা দুই দলই দাঁড়িয়ে আছি। মজিদকে দেখতে পেয়ে মোহনবাগানের এক ডিফেন্ডার (নামটা জানা থাকলেও বলছি না) গুনগুন করে গান গাইতে শুরু করল। সঙ্গে সঙ্গে সবুজ-মেরুনের অন্য এক ডিফেন্ডার সেই গান গাইতে থাকা ফুটবলারকে দিল কড়া ধমক। বাংলায় বলল, ‘‘গান গাইছিস কেন? এখনই গান বন্ধ কর। মজিদ বুঝে যাবে তুই চাপে আছিস। তখন মাঠে নেমে তোর দিক থেকেই রক্ষণকে নিশানা বানাবে।’’ বাংলা না জানায় আমরা বুঝতে পারিনি। কিন্তু দলের বাঙালি ফুটবলাররা তা বুঝে নিয়ে আমাদের বলতে হাসিতে ফেটে পড়েছিল মজিদ। বলেছিল, ‘‘দাঁড়াও আজ ওকে নিয়ে মাঠে মজা করব।’’ মাঠে নেমে ঠিক তাই করেছিল মজিদ।
নিজের শৃঙ্খলা ধরে রাখতে পারলে মজিদ যে কোথায় যেতে পারত, তা ভাবলেই অবাক লাগে। মনে আছে এ রকমই একটা ডার্বি ম্যাচের আগে রাত করে মেসে ফেরায় খুব তিরস্কৃত হয়েছিল মজিদ। ম্যাচের দিন সকালে কর্তাদের বলছিল, আজ যদি জেতাতে পারি তা হলে কী হবে? মনে আছে মাঠে নেমে সে দিন মজিদ ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছিল মোহনবাগান রক্ষণকে। গোলও করেছিল।
দার্জিলিং গোল্ড কাপের কথা মনে পড়ছে। আমি আর মজিদ তখন ইস্টবেঙ্গলে। ফাইনালে সামনে মোহনবাগান। আমরা দুই গোলে হারছিলাম। আমি আর মজিদ গোল করে সমতা ফিরিয়েছিলাম। ইস্টবেঙ্গলের জয়ের গোলটা এসেছিল মজিদের পাস থেকেই।
ইস্টবেঙ্গল জার্সি গায়ে আমার সেরা ম্যাচ দু’টো। প্রথমটা কলকাতা লিগের ম্যাচে। যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে সেই খেলায় মোহনবাগানের বিরুদ্ধে বাঁক খাওয়ানো শটে গোল করেছিলাম। পরে অবশ্য মোহনবাগানের কৃষ্ণগোপাল চৌধুরী একটা দুর্দান্ত গোল করে ম্যাচটা ড্র করে দেয়।
১৯৮৫ সালে বেঙ্গালুরুতে ফেডারেশন কাপ ফাইনাল। বিপক্ষে মোহনবাগান। সে বার আমাদের দল দারুণ শক্তিশালী ছিল। ম্যাচের আগে ড্রেসিংরুমে প্রদীপদার সেই বিখ্যাত ‘ভোকাল টনিক’ আজও ভুলব না। আমার কাছে এসে উনি বিড়ালের মতো মিউঁ মিউঁ করে ডাকছিলেন। আমি বললাম, এ রকম ভাবে ডাকছেন কেন বিড়ালের মতো। শুনে কপট রাগ দেখিয়ে উনি বলতে শুরু করলেন, ‘‘আমি বিড়াল হইনি। মাঠে গত কয়েকটা ম্যাচে বিড়ালের মতো আচরণ করছ তোমরা। তাই তোমাদের সঙ্গে বিড়ালের মতো করেই কথা বলতে হচ্ছে। তোমাদের বুঝতে হবে ইস্টবেঙ্গল একটা বাঘ। লাল-হলুদ জার্সি যখন গায়ে, তখন বাঘের মতো হুঙ্কার ছাড়তে ছাড়তে যাও গিয়ে ট্রফিটা নিয়ে এসো। বাঘ সুযোগ পেলে শিকার করে ফেরে।’’ সেই ম্যাচে আমি একটা গোল করেছিলাম। সেই গোলেই জিতেছিল ইস্টবেঙ্গল। দ্বিতীয়ার্ধে ডিফেন্ডারদের জটলার মধ্য থেকে বল পেয়ে গোল করেছিলাম। মোহনবাগান ম্যাচে ফিরতে পারেনি।
আক্ষেপের ব্যাপার এটাই যে আমি ও মজিদ ইস্টবেঙ্গলে ও মহমেডানে খেললেও কোনও দিন মোহনবাগানে খেলিনি। মনে আছে, আশির দশকের শুরুতে এক বার আমি ও মজিদ একটি অনুষ্ঠানে মোহনবাগানের তৎকালীন সর্বময় কর্তা ধীরেন দের সঙ্গে আলাপ করি। সে দিন তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘‘আমাদের ক্লাবের সংবিধানে তো বিদেশি ফুটবলার খেলানোর নিয়ম নেই। তাই ইচ্ছে থাকলেও তোমাদের নিতে পারি না।’’
আমার বয়স এখন ষাটের কাছাকাছি। এই বয়সে এসে দুই ফুটবলারের কথা বলতে চাই। এই দু’জন হলেন সুব্রত ভট্টাচার্য ও মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য। মনে আছে প্রথম দিকে যখন ইস্টবেঙ্গলে আসি, তখন আমি আর মজিদ রোজ নিজেদের মধ্যে বলতাম, ভাগ্যিস মনাদার বিরুদ্ধে আমাদের খেলতে হয় না। তা হলে হয়তো বেশি দিন খেলতে পারতাম না। মনাদার মতো কড়া ট্যাকল আমি কলকাতা ময়দানে কাউকে করতে দেখিনি। আর সুব্রত ভট্টাচার্য ছিলেন হেডিং আর অনুমানক্ষমতায় এগিয়ে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy