চেহারায়, চলনে-বলনে, ব্যাটিং ধরনে দু’জনে ঠিক ততটাই মিল, যতটা মগনলাল মেঘরাজ আর প্রদোষচন্দ্র মিত্তিরে।
প্রথম জনকে পুরুষ্ট গোঁফজোড়া দেখে দিব্য চেনা যাবে। অধুনা যৌবনধর্ম মেনে ইনি ট্যাটুর দুনিয়ায় বিচরণ করবেন অতীব স্বচ্ছন্দে। গরগরে একটা ভাবমূর্তি নিয়ে উনি পছন্দ করবেন চলতে, সেঞ্চুরির পর দু’পা ফাঁক করে এমন মারণভঙ্গিতে দাঁড়াবেন যে, নয়াদিল্লির ক্রিকেটমহলে তাঁর পরিচিত ডাকনাম মনে পড়ে যাবে এক ঝটকায়।
গব্বর।
দ্বিতীয় জন ক্রিকেটের মেধাবী ছাত্র হয়েও আবার দেখনদারিটা আমদানি করতে পারলেন না। টি-টোয়েন্টির যুগেও ইনি খেলবেন ক্রিকেট-ম্যানুয়াল মেনে। কভার ড্রাইভে ভরসা থাকবে বেশি, ‘হেলিকপ্টারে’ কম। মুখচোখে ক্ষুধার্ত মেজাজ খুঁজে পাওয়া যাবে না, পাওয়া যাবে বরফশীতল মস্তিষ্ক। জাভেরি বাজারে ছেড়ে দিলে এখনও হয়তো রাস্তা হারানোর আশঙ্কা থাকবে, কিন্তু বাইশ গজে বোধহয় আর নয়। অস্ট্রেলিয়াগামী ফ্লাইটে যদি ওপেনিং স্লটে কারও নাম সর্বপ্রথম জাতীয় নির্বাচকদের বসাতে হয়, তা হলে তাঁরটা। সন্দীপ পাটিলরা তো বরাবাটিতে বসে দেখে গেলেন, রোহিত শর্মা নামক মুম্বইকরকে কী ভাবে ওপেনিং থেকে মিডল অর্ডারে ঠেলে দিচ্ছেন আর এক মুম্বইকর।
বেসবল থিওরি দিয়ে।
রবিবার কটকের স্কোরবোর্ড বলছে, প্রথম জন শিখর, ১০৭ বলে ১১৩। দ্বিতীয় জন রাহানে, ১০৮ বলে ১১১। দেখাচ্ছে, ভারত জিতল ১৬৯ রানে। কিন্তু রাহানেরা যত না আজ ভারতকে জেতালেন, তার চেয়ে কোথাও যেন বেশি নিজেরা জিতে গেলেন নির্বাচকদের টেবলে। দুই ভারতীয় ওপেনারের ফর্ম যদি এমনই চলে, তা হলে অস্ট্রেলিয়ায় ওয়ান ডে ওপেনিং স্লটে হাত দেওয়ার খুব জায়গা থাকবে কি?
অজিঙ্ক রাহানে রাতের দিকে ঠিক করতে পারছিলেন না, কোন সেঞ্চুরিটাকে আগে রাখবেন। দু’মাস আগে বার্মিংহামে করা সেঞ্চুরিকে? না কি আজকেরটা? স্বাভাবিক। বার্মিংহ্যামে যদি তিনি প্রথম ওয়ান ডে সেঞ্চুরির আস্বাদ নিয়ে থাকেন, তা হলে কটকের দ্বিতীয়টার মাহাত্ম্য আবার প্রভাবে। টেকনিক তাঁর বরাবরের সেফ ডিপোজিট সবাই জানত, কিন্তু একই রাহানে যে সাড়ে পাঁচ ফুটের চেহারা নিয়েও স্টেপ আউট করে সিমারকে মিড অন দিয়ে ফেলে দিতে পারেন, সময়ে ‘গব্বরে’র চেয়েও বেশি খুনে হতে পারেন এ দিনের আগে ক’জন দেখেছিল?
মুম্বইয়ে ফোন করে শোনা গেল, রাহানের এমন পাওয়ার হিটিংয়ের পিছনে কারণ আছে। যেটা ক্রিকেট নয়, বেসবল। আইপিএল সেভেনের সময় থেকে যা আমদানি করেছেন তাঁর কোচ প্রবীণ আমরে। গত ছ’বছর ধরে যাঁর ছাত্র রাহানে। আমরের মনে হয়েছিল, অস্ট্রেলীয়রা যদি থ্রো করার কায়দাটা বেসবল থেকে ধার নিতে পারে, তা হলে রাহানের ব্যাটিংয়েও তিনি বেসবল পেটানোর টেকনিকটা জুড়তে পারেন। ফোনে সেটা বললেনও যে, “আসলে ক্রিকেট এখন পাওয়ার গেম। শুধু টেকনিক আর প্লেসমেন্টে চলবে না। শট মারলেই হবে না, শট ফিনিশ করতে হবে। রাহানেকে তাই বলেছি শর্টার ফর্ম্যাটে বেসবল পেটানোর টেকনিকটা ঢোকাও। তাতে ক্লিন হিট পাবে। প্রথমে ধরবে, তার পর বেসবল!” মুম্বইকর শিখেছেন। তাঁর চোদ্দো বাউন্ডারি, তিন বিশাল ছক্কার ইনিংসে ‘নারকীয়তা’ তোলা ছিল ইনিংসের শেষার্ধের জন্য। ঠিক তেমন ‘গব্বর’ও আর শুরু থেকে ধ্বংসের স্ট্র্যাটেজিতে ঢুকলেন না। কাটগুলো মাটি ছুঁয়ে গেল, হাওয়ায় না থেকে। সুইপ-রিভার্স সুইপে ঢুকলেন অনেক দেরি করে, গোটা তিরিশেক রান পকেটে ঢুকিয়ে। অস্ট্রেলিয়া সফরকে সামনে রেখে যে ভাবে শিখর তৈরি হচ্ছেন বলে জানা গেল।
আর জোড়া রোষে লঙ্কা ভস্মীভূত।
কত যে রেকর্ড তৈরি হল, কতগুলো যে ভাঙতে ভাঙতে বেঁচে গেল কলিঙ্গরাজ্যে। ওপেনিং জুটিতে উঠল ২৩১, যা ভারতীয়দের মধ্যে তৃতীয় সর্বোচ্চ। অল্পের জন্য অক্ষত থেকে গেল ওপেনিং জুটিতে সচিন-সৌরভের করা ২৫৮ রানের রেকর্ড। ওয়ান ডে ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি বার সাড়ে তিনশো পার করার রেকর্ড কুক্ষিগত হল ভারতের। শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে দ্বিতীয় বৃহত্তর জয়টাও এল। যা দেখে রাসেল আর্নল্ডের মতো কোনও কোনও হতাশাবিদ্ধ লঙ্কা-প্রাক্তন টুইট করে বসলেন, এর চেয়ে খারাপ আর হতে পারত না শ্রীলঙ্কার। এখান থেকে ভাল হওয়াই সম্ভব।
আর ভাল! পাঁচ বছর আগে রাজকোটে ভারতের ৪১৪ তাড়া করতে নেমে ৪১১ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল শ্রীলঙ্কা। তিলকরত্নে দিলশান সেই ম্যাচে ১৬০ করেছিলেন। এ বারও দিলশান আছেন, মাহেলা আছেন, সঙ্গকারা আছেন। কিন্তু ঔদ্ধত্যটা নেই। নইলে ন্যূনতম যুদ্ধও বিশ্বকাপ ফাইনালিস্টদের থেকে আসবে না? সবচেয়ে দুর্ভাগ্য বোধহয় কুমার সঙ্গকারার। এত বড় ক্রিকেটার তিনি, আর তাঁরই হাত থেকে কিনা আজ দু’টো মোক্ষম ক্যাচ পড়ল। গলি ক্রিকেটের বোলিং নিয়েও শিখর-রাহানেকে পেয়ে গিয়েছিল শ্রীলঙ্কা। কিন্তু গলি থেকে আর রাজপথে উঠে আসা যায়নি সঙ্গার কিপিং গ্লাভস দু’বার শত্রুতা করায়।
ক্যাপ্টেন কোহলিকেও বাহবা দিতে হবে। সত্যিই সীমিত ওভারের ক্রিকেটে আজ তাঁকে মহেন্দ্র সিংহ ধোনির যোগ্য উত্তরসূরি দেখিয়েছে। কোহলি টস হেরেছেন, ওড়িশা-আকাশের শিশিরের পাল্লায় পড়েছেন। কিন্তু সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে দু’বার ভাবেননি। জয়বর্ধনেকে পার্ট টাইম স্পিনারের সামনে ফেলে বিভ্রান্ত করা থেকে ইশান্ত শর্মাকে লেলিয়ে শ্রীলঙ্কা ব্যাটিং সাফ সব জায়গায় নিখুঁত দেখিয়েছে তাঁকে। তবে দুঁদে অধিনায়কত্বের সবচেয়ে বড় প্রমাণ বোধহয় দিলেন ব্যাটিং পাওয়ার প্লে নির্বাচনে।
যা এ দিন তিরিশ থেকে চল্লিশ ওভারের মধ্যের সময়ে আসেনি। ২৩ ওভার থেকে নিলেন কোহলি, আর ম্যাচটাও ওখানে ঘুরল। ড্রিঙ্কস ব্রেকেই বার্তা এসে গিয়েছিল ড্রেসিংরুম থেকে। ১৮ ওভার পর্যন্ত রান রেট ছিল সাড়ে চার। পঁচিশ ওভার পেরোতে না পেরোতে সেটা মগডালে। ওই পাঁচ ওভারে উঠল ৬২ আর সেট হয়ে মারার যে মঞ্চ খুঁজছিলেন রাহানে-ধবন, সেটা তাঁরা পেয়ে গেলেন। যে মোমেন্টামের সামনে পড়ে কখনও শ্রীলঙ্কান বোলাররা দিলেন ওভারে পনেরো, কখনও কুড়ি।
এক দিক থেকে ভাবলে মনে হবে, ঠিকই হল। ভারতের আজ সব ভাল গিয়েছে। ওপেনাররা সেঞ্চুরি পেলেন, সুরেশ রায়না ২০০তম ওয়ান ডে-কে স্মরণীয় করে রেখে গেলেন। আবার আবু ধাবিতে পাকিস্তানও মিসবার দাপটে অস্ট্রেলিয়াকে শাসন করে গেল। বাংলাদেশ, তারাও তো বহু দিন পর টেস্টে ফেভারিট হিসেবে শুরু করছে জিম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে। ২ নভেম্বর, ২০১৪ সত্যিই উপমহাদেশের দিন। এশীয় ক্রিকেটের দিন।
অ্যাঞ্জেলো ম্যাথেউজের কপাল সত্যিই খারাপ। এশীয় ক্রিকেটের এমন গর্বের দিনে তাঁকেই কিনা শুধু মাইকেল ক্লার্কের পৃথিবীতে ঢুকে পড়তে হল!
সংক্ষিপ্ত স্কোর
ভারত ৩৬৩-৫ (ধবন ১১৩, রাহানে ১১১)
শ্রীলঙ্কা ১৯৪ (জয়বর্ধনে ৪৩, ইশান্ত ৪-৩৪)।
• ইশান্ত, বরুণ অ্যারন ও উমেশ যাদব শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে একসঙ্গে এই প্রথম ওয়ান ডে খেললেন।
• ভারতের দুই ওপেনার একই ওয়ান ডে-তে সেঞ্চুরি করলেন এই নিয়ে ৬ বার।
• ২০ ওয়ান ডে-তে ৩৫০+ তুলল ভারত। সব ম্যাচই জিতেছে তারা।
• ২১ থেকে ৩০ ওভারের মধ্যে ভারত তোলে ১০৫। ২০০১-এর পর ওয়ান ডে-তে যা সর্বোচ্চ।
• ওপেনিং জুটিতে ওঠা ২৩১ ওয়ান ডে-তে ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ ওপেনিং পার্টনারশিপ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy