ঋষভ পন্থ। —ফাইল চিত্র।
আইপিএলে ৯০৩ দিন পর অর্ধশতরান। সে বারও বিপক্ষে ছিল চেন্নাই সুপার কিংস। রবিবারও সেই দলের বিরুদ্ধেই ৫০ করলেন ঋষভ পন্থ। ২০২১ সালের পর আবার ২০২৪ সালে। প্রত্যাবর্তন পন্থের।
মহেন্দ্র সিংহ ধোনি-উত্তর পর্বে ভারতীয় দলে নিজের জায়গা পাকা করে নিয়েছিলেন ঋষভ পন্থ। কিন্তু ২০২২ সালের ৩০ ডিসেম্বর সব কিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। দিল্লি থেকে বাড়ি ফিরছিলেন পন্থ। নিজেই গাড়ি চালাচ্ছিলেন। ভোরের দিকে হয়তো হঠাৎ চোখ লেগে এসেছিল। গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ধাক্কা মারে ডিভাইডারে। তাতেই সব কিছু অনিশ্চিত হয়ে যায়। পন্থ প্রাণে বেঁচে গেলেও ক্রিকেট খেলতে পারবেন কি না তা নিয়েই প্রশ্ন উঠে গিয়েছিল। সেই সব কিছুর উত্তর এক এক করে দিচ্ছেন পন্থ। হয়তো টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতের জার্সি পরে মাঠে তাঁর প্রত্যাবর্তনের চক্র পূর্ণ হবে।
রবিবার ধোনির সামনে দাঁড়িয়েই ৩২ বলে ৫১ রান করে গেলেন পন্থ। দিল্লি ক্যাপিটালসের অধিনায়ক যখন মাথিসা পাথিরানাকে একের পর এক বাউন্ডারি মারছেন, তখন উইকেটের পিছন থাকা প্রাক্তন ভারত অধিনায়ক ধোনিরও হয়তো মনে আনন্দ হচ্ছিল। আইপিএল শেষ হলেই যে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। আর সেখানে পন্থকে পেলে ভারতীয় দল আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে। সেই সঙ্গে নিশ্চিন্ত হবেন নির্বাচকেরাও। অবাধ্য ঈশান কিশন বা অনভিজ্ঞ জিতেশ শর্মা, ধ্রুব জুরেলের থেকে পন্থ তো যেকোনও দিনই পছন্দের তালিকায় এগিয়ে থাকবেন।
৪৫৪ দিন পর মাঠে ফিরেছিলেন পন্থ। গাড়ি দুর্ঘটনার পর মাথায়, পিঠে, হাঁটুতে চোট লেগেছিল। অস্ত্রোপচারও করতে হয়। ক্রাচ নিয়ে হাঁটতেন। সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে এখন তিনি বিশ্বকাপের দলে ঢোকার জন্য নির্বাচকদের ঘরে কড়া নাড়তে শুরু করে দিলেন। এমন অবিশ্বাস্য প্রত্যাবর্তনের কথা সিনেমায় দেখালেও অবিশ্বাস্য মনে হত। কিন্তু পন্থ করে দেখালেন। আর রবিবার তিনি বুঝিয়ে দিলেন যে ফর্মেও রয়েছেন।
২০২২ সালের ৩০ ডিসেম্বরের কথা এখনও ভুলতে পারেনি ভারতের ক্রিকেটমহল। মনে রাখেননি শুধু এক জন। সেই দিনের কথা মনে রাখতে চান না পন্থ। পিছনে নয়, তাঁর চোখ ভবিষ্যতের দিকে। যে ভবিষ্যতের শুরুতেই রয়েছে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। তাই পঞ্জাব কিংসের বিরুদ্ধে প্রথম ম্যাচ খেলতে নেমে পন্থ বলেছিলেন, “এই মুহূর্ত আমার কাছে খুব আবেগের। কিন্তু খুব বেশি ভাবছি না। দুর্ঘটনার কথা এখন মনে রাখতে চাই না। এত দিন পরে মাঠে নেমেছি। খেলা উপভোগ করতে চাই।”
৩০ ডিসেম্বর, ২০২২ ভুলে যেতে চাইলেও পন্থ ভুলতে চাইবেন না ২৩ মার্চ, ২০২৪ দিনটিকে। সেই দিনই তো মাঠে ফিরলেন তিনি। আর গোটা ভারত দেখল তাঁর প্রত্যাবর্তন। পন্থের মাঠে ফেরার শান্তির মধ্যেও জড়িয়ে ছিল উৎকণ্ঠা। তিনি কি পারবেন আগের মতো খেলতে? পায়ে কোনও সমস্যা নেই তো? সেই দিন দিল্লির ইনিংসের নবম ওভারের তৃতীয় বল প্রথম খেলেছিলেন পন্থ। হরপ্রীত ব্রারের বল হাঁটু মুড়ে কাট করলেন। পয়েন্টের ফিল্ডার ধরতে না পারলেই চার। তা হয়নি। তবে ক্রিকেটমহলের স্বস্তির পরিমাণ কিছুটা বৃদ্ধি পেল। স্বচ্ছন্দে হাঁটু মুড়লেন পন্থ। অর্থাৎ কোনও সমস্যা নেই। বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণের মতো এক জন মনে করিয়ে দিলেন, দুর্ঘটনায় গুরুতর জখম হয়েছিল পন্থের ডান পায়ের হাঁটু। হরপ্রীতকে কাট মারার সময় বাঁ হাঁটু বেশি ভাঁজ করতে হয়েছে পন্থকে! দ্বিতীয় বল ডিপ কভারে ঠেললেন পন্থ। ২ রান হতে পারত। ১ রান নিয়েই থামলেন দিল্লির অধিনায়ক। প্রথম রান নেওয়ার পর তাঁর মুখে হাসি দেখা গেল। পন্থকে চোখের সামনে খেলতে দেখেও যেন সংশয়মুক্ত হতে পারছিলেন না ক্রিকেটপ্রেমীরা। ১ রান করে নিয়ে নিজের ইনিংস এগোচ্ছিলেন পন্থ!
আগ্রাসী ব্যাটিংয়ে অভ্যস্ত পন্থ তা হলে ১০০ শতাংশ ফিট নন? না কি এত দিন পর মাঠে ফিরে চাপে রয়েছেন? ক্রিকেটপ্রেমীদের একাংশ যখন প্রশ্নমালা সাজাতে শুরু করেছিলেন, ঠিক তখনই জবাব দিয়েছিল পন্থের ব্যাট। রাহুল চাহারের একটু খাটো লেংথের বল পন্থ পুল করেছিলেন ডিপ মিড উইকেটে। হর্ষল পটেলের ‘অলস’ প্রচেষ্টা কাজে আসেনি। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে পন্থের ৪০০তম চার সংশয়ী ভক্তদের আশ্বস্ত করেছিল। আর রবিবার সমস্ত ক্রিকেটপ্রেমীদের শান্ত করে দিলেন তিনি। চেন্নাইয়ের বিরুদ্ধে চারটি চার এবং তিনটি ছক্কা বুঝিয়ে দিল সমস্যা এখন অতীত। সামনে শুধুই প্রত্যাশা। পন্থকে ঘিরে যে প্রত্যাশা ছিল ভারতীয় ক্রিকেট সমর্থকদের। ধোনির জায়গায় উইকেটরক্ষক হিসাবে তাঁকে যে ভাবে বসাতে শুরু করেছিলেন তাঁরা। আরও এক বার নিজের সেই জায়গা নিতে ফিরে এসেছেন তিনি। আর সেই ফিরে আসার শুরুটা হল ধোনির সামনে দাঁড়িয়েই।
পন্থ যে সময়টা নিজের সঙ্গে লড়াই করছিলেন, সেই সময়টা ছিল ভারতীয় ক্রিকেটের জন্যেও এক ঘোর অস্থিরতার, অনিশ্চয়তার। পন্থের। রাহুল দ্রাবিড়ের। রোহিত শর্মার। জয় শাহদের। অজিত আগরকরদের। ক্রিকেটপ্রেমীদেরও। এই সময় শ্রীকর ভরত, ঈশান কিশন, জীতেশ শর্মা, ধ্রুব জুড়েলদের সুযোগ দেওয়া হয়েছে এক এক করে। লোকেশ রাহুলকে দিয়ে বিশ্বকাপ-সহ বেশ কিছু ম্যাচে পরিস্থিতি সামাল দিতে হয়েছে। আসলে পন্থের অনুপস্থিতির জন্য পরীক্ষার রাস্তায় হাঁটতে বাধ্য হয়েছেন নির্বাচকেরা। আর নজর ছিল পন্থের দিকে। আস্থা ছিল বিসিসিআইয়ের মেডিক্যাল স্টাফদের উপর।
দুর্ঘটনায় পন্থের ডান হাঁটুর প্রতিটি লিগামেন্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সে সময় তিনি ভেবেছিলেন, হয়তো বাঁচবেন না। সুস্থ হওয়ার পর চিকিৎসক এবং বিসিসিআইকে পন্থ কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন দ্বিতীয় জীবন দেওয়ার জন্য। মনের জোরে বিদায় জানিয়েছেন সঙ্গী হয়ে যাওয়া হুইলচেয়ার, ক্রাচকে। মাটিতে পা ফেলেছেন যন্ত্রণা উপেক্ষা করে। এক পা এক পা করে হাঁটার চেষ্টা করেছেন। জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন ধাপে ধাপে চিকিৎসকদের পরামর্শ মেনে। অনিশ্চিত ক্রিকেট ভবিষ্যৎকে নিশ্চিত করেছেন। চিকিৎসকদের কৃতিত্ব অস্বীকার করার জায়গা নেই। কৃতিত্ব কম নয় ২৬ বছরের তরুণেরও। মনে করা হয়েছিল তাঁর মাঠে ফিরতে অন্তত ১৮ মাস সময় লাগবে। পন্থের একাগ্রতা সেই সময় তিন মাস কমিয়ে দিয়েছে।
দিল্লি ক্যাপিটালসের ডিরেক্টর অফ ক্রিকেট সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘‘চোট সারিয়ে পন্থ ফিরে আসায় দিল্লির ব্যাটিং অনেক জোরদার হয়েছে। গত বছর পন্থের অভাবটা আমরা অনুভব করেছি। ওর শূন্যস্থান পূরণ হয় না।’’ দিল্লির অভাব পূরণ করে দিয়েছেন পন্থ। এ বার অপেক্ষা ভারতীয় দলের শূন্যস্থান পূরণের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy