কী কী রোগ বাড়ছে, কী ভাবে সতর্ক থাকবেন? ছবি: ফ্রিপিক।
শীতে সর্দিকাশির সমস্যায় সবচেয়ে বেশি ভোগেন অধিকাংশ। জ্বর, শুকনো কাশি তো রয়েছেই, সেই সঙ্গে অ্যালার্জির সমস্যাও বাড়ে অনেকের। ঘুম থেকে উঠেই নাগাড়ে হাঁচি, নাক দিয়ে অনবরত জল পড়া, হাঁটাচলার সময়ে শ্বাস নিতে কষ্ট, রাতে শুয়ে বুকে চাপ অনুভব করা বা দমবন্ধ হয়ে আসার মতো লক্ষণ ইদানীং কালে অনেকেরই দেখা যাচ্ছে। কেবল হাঁচি বা শুকনো কাশি নয়, শ্বাসের সমস্যা ভোগাচ্ছে ছোটদেরও। এখানেই শেষ নয়। শীতকালে মস্তিষ্কে এবং হার্টে রক্তচলাচলকারী নালির সঙ্কোচন বেশি মাত্রায় হয় তাই হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোক শীতকালেই বেশি হয়। ব্রঙ্কাইটিস বাড়ে। বড়দের রক্তচাপ বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়া শিশুদের ভাইরাল ডায়েরিয়াও হয়।
এখন কথা হল, শীতে যে এত রকম অসুখবিসুখ বাড়ে, এর কারণ কী? কাদের এমন সমস্যা বেশি হয়? এই বিষয়ে কলকাতার এক হাসপাতালের স্ত্রীরোগ বিভাগের চিকিৎসক চন্দ্রিমা পাল বলেছেন, “শীতের সময়ে সংক্রমণজনিত রোগের প্রকোপ বাড়ে। প্রতি বছরই তা হয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে, ওপিডিতে আসা রোগীদের বেশির ভাগই ভুগছেন সর্দিকাশি, জ্বর, শ্বাসকষ্ট বা অ্যালার্জিক রাইনাইটিসের মতো সমস্যায়। রোগীদের মধ্যে অন্তঃসত্ত্বা মহিলারাও রয়েছেন। অনেকেই বলছেন, সর্দি বা কাশি এক বার ধরলে আর সারতেই চাইছে না। সেই সঙ্গে নানা রকম অ্যালার্জির লক্ষণও দেখা দিচ্ছে।”
ছোটরাও রয়েছে সেই তালিকায়। শরীরে রোগ প্রতিরোধ শক্তি কমে গেলে ভাইরাস বা ব্যাক্টেরিয়া জনিত সংক্রমণের আশঙ্কা বাড়ে। শীতের সময় যে হেতু দূষণের মাত্রা বাড়ে, তাই ধুলোবালি বা জলকণাকে আশ্রয় করে কয়েক রকম ভাইরাস বা ব্যাক্টেরিয়াও খুব দ্রুত রোগ ছড়াতে পারে। শিশুরোগ চিকিৎসক রুমা রায়ের কথায়, “শিশুদের সাধারণ সর্দিকাশি যাকে আমরা বলি ‘কমন কোল্ড’ তা তো হচ্ছেই, সেই সঙ্গে ভাইরাল ডায়েরিয়াও দেখা দিচ্ছে। শরীরে জলশূন্যতার উপসর্গ দেখা দিচ্ছে অনেকের।”
শীতে বাতাস ভারী থাকে। সেই কারণে বিভিন্ন ধরনের ভাইরাস বাতাসের নীচের স্তরে নেমে আসে। এর ফলে মানুষের শরীরে চট করে ভাইরাস ঢুকে যায়। এর জন্য ভাইরাসজনিত রোগ শীতে বেশি হয়। শুকনো কাশি, শ্বাসকষ্ট বা অ্যালার্জির সংক্রমণের জন্য দায়ী রাইনোভাইরাস নামে এক ধরনের ভাইরাস। এই ভাইরাস মূলত নাক, মুখ, চোখ দিয়ে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। শীতের সময়ে এই ভাইরাস মূলত নাসারন্ধ্রে বাসা বেঁধে সংখ্যা বৃদ্ধি করে। ফলে নাক দিয়ে অনবরত জল পড়া, একনাগাড়ে হাঁচি হওয়া, নাক বন্ধ হয়ে থাকা বা শ্বাস নিতে সমস্যা হয় অনেকের। সেই সঙ্গে জ্বর জ্বর ভাবও থাকে। চিকিৎসক অনির্বাণ দলুইয়ের মতে, “বিভিন্ন ভাইরাস যেমন অ্যাডিনোভাইরাস, রাইনোভাইরাস, ইনফ্লুয়েঞ্জা ইত্যাদি মূলত শীতকালীন নানা অসুখবিসুখের জন্য দায়ী। বিশেষ করে শিশু, বয়স্ক ও যাঁদের শরীরে অন্যান্য রোগ আছে যেমন, ডায়াবিটিস, ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিস, হাঁপানি বা সিওপিডি, তাঁদের ভোগান্তি বাড়ে। তাই এই সময়টাতে পর্যাপ্ত বিশ্রাম, প্রচুর তরল জাতীয় খাবার, বিশেষ করে বেশি জল খাওয়া দরকার।”
শীতল বাতাস, ধুলো, ধোঁয়া, পরাগরেণুর কারণে হাঁপানির সমস্যাও বাড়ে। যদি ফুসফুসের বড় রকম ক্ষতি হয় না, তবে সতর্ক থাকতেই হয়। এমনটাই জানালেন পালমোনোজিস্ট দেবরাজ যশ। তাঁর কথায়, “দূষণ মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে গিয়েছে। বাতাসে ভাসমান দূষিত কণা শ্বাসনালি দিয়ে ঢুকে শ্বাসযন্ত্রে প্রদাহ তৈরি করছে। ফলে শ্বাসের সমস্যা হচ্ছে অনেকেরই। তা ছাড়া রাইনোভাইরাসের প্রকোপ তো রয়েছেই। এই ভাইরাস বাতাস ও স্পর্শে ছড়ায়। রোগীরও সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। যাতে তাঁর থেকে অন্য কারও এই রোগ না হয়। হাঁচি, কাশির সময়ে রুমাল বা টিস্যু পেপার ব্যবহার করা উচিত। অ্যালার্জিক রাইনাইটিস থাকলে তার জন্য নির্দিষ্ট কিছু ওষুধ আছে। সেই ওষুধ খেতে হবে। সঙ্গে ইনহেলার রাখলে ভাল। যদি মাস্ক পরতে পারেন তো খুবই ভাল হয়।”
শীতে ভাইরাল জ্বর নিয়েও সতর্ক থাকা জরুরি। এখন শুনবেন, ঘরে ঘরে লোকজনের পেটের সমস্যা হচ্ছে। আজ জ্বর, সর্দিকাশি তো কালই ডায়রিয়া। ওষুধ সাময়িক ভাবে রোগ ঠেকাতে পারলেও, তা নির্মূল করতে পারছে না। এর কারণও কিন্তু ভাইরাস। সাধারণত রোটা ভাইরাস এই ভাইরাল ডায়রিয়ার জন্য দায়ী। রোটা ভাইরাস মুখগহ্বর দিয়ে খাদ্যনালিতে প্রবেশ করে। এর উৎস হল জল, বাসি খাবার, রাস্তার কাটা ফল বা কাঁচা স্যালাড। শিশুরা শীতের সময়ে এই ভাইরাল ডায়রিয়ায় সবচেয়ে বেশি ভোগে, এমনটাই জানালেন চিকিৎসক ডায়রিয়ার মারাত্মক আকার নিলে শরীরে জলশূন্যতার লক্ষণ দেখা দেবে। তখন স্যালাইন দিয়ে শরীরে জল ও খনিজের ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। ডায়রিয়া হলেই কিন্তু মুঠো মুঠো অ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে ফেলবেন না। পর্যাপ্ত জল, ওআরএস খেতে হবে। আর সময় থাকতে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।”
শীতে চোখেও সংক্রমণ হয় অনেকের। ধূলিকণার সঙ্গে ভাইরাস ঢুকে চোখের নানা সংক্রমণজনিত রোগ হতে পারে। এতে চোখ জ্বালা করবে, চোখে ব্যথা হবে, চোখ ফুলে অনবরত জল পড়তে থাকবে। একে চিকিৎসার ভাষায় বলা হয় ‘অ্যালার্জিক কনজাংটিভাইটিস’ । শীতে চোখ লাল হওয়ার প্রবণতা বেশির ভাগটাই অ্যালার্জি থেকে। শুধু জলের ঝাপটা দিয়ে চোখ-মুখ ধুলে সে ক্ষেত্রে সুরাহা না-ও মিলতে পারে। তখন ‘অ্যান্টি অ্যালার্জি’ আইড্রপ নিতে হতে পারে। তবে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া আইড্রপ ব্যবহার করা উচিত নয়
শীতে রোগ থেকে বাঁচতে
১) মাস্ক পরা খুব জরুরি। এতে দূষণ তো বটেই জীবাণু সংক্রমণও কিছুটা হলেও রুখে দেওয়া যায়।
২) ধূমপান থেকে বিরত থাকতে হবে। ধোঁয়া-ধুলোবালি বেশি আছে এমন জায়গা এড়িয়ে চলবেন।
৩) জ্বর বা সর্দিকাশি হলেই অ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে ফেলবেন না। ভাইরাল জ্বর বা সংক্রমণ অ্যান্টিবায়োটিকে সারে না। তাই না জেনেবুঝে ওষুধ খেলে অসুখ তো সারবেই না, উল্টে অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী জীবাণু তৈরি হয়ে যাবে শরীরেই।
৪)হাঁপানি, সিওপিডি বা শ্বাসের কোনও সমস্যা থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ মতো ইনহেলার ও আনুষঙ্গিক ওষুধ খেতে হবে। প্রতি পাঁচ বছরে এক বার নিউমোকক্কাস টিকা আর ফি-বছর ইনফ্লুয়েঞ্জার টিকা নেওয়া খুব জরুরি।
৫) শীতের সময়ে বাইরের খাবার, কাটা ফল বা দীর্ঘ সময়ে কেটে রাখা কাঁচা স্যালাড খাওয়া ঠিক হবে না। এই ধরনের খাবার থেকেই রোগজীবাণু ছড়ায় বেশি। তা ছাড়া যে কোনও রকম ঠান্ডা পানীয়, প্যাকেটের পানীয় বিপজ্জনক হতে পারে।
৬) ভিটামিন সি যুক্ত ফল, মরসুমি সব্জি বেশি খেতে হবে।
৭) ম্যাগনেশিয়াম আছে এমন খাবার বেশি খেতে হবে। সবুজ শাকের মধ্যে ম্যাগনেশিয়াম বেশি থাকে। বাদাম, কুমড়োর বীজ, পেস্তা, কাঠবাদাম , সূর্যমুখীর বীজে ম্যাগনেশিয়াম বেশি থাকে। মাছ, কলা এবং ডার্ক চকলেটে ম্যাগনেশিয়াম থাকে। এই ধরনের খাবার খেলে শরীরে রোগ প্রতিরোধ শক্তি বাড়বে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy