দিল্লি জয় করে কলকাতায় ফিরলেন ইউসুফ। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
প্রশ্ন: কলকাতার হয়ে ম্যাচ জেতানো ইনিংস খেলতে পারার আনন্দকে কী ভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
ইউসুফ পাঠান: কলকাতার ক্রিকেটভক্তদের মধ্যে এত আবেগ দেখি যে, ওঁদের আনন্দ দিতে পারলে নিজেকে খুব তৃপ্ত মনে হয়। দিল্লিতে দলের জয়ে অবদান রাখতে পেরে আরও খুশি হয়েছি। কারণ, টিম সমস্যায় পড়েছিল। যখন তোমার টিম পড়ে যাচ্ছে, তখন যদি টেনে তুলতে পারো, তবেই না ভাল পারফরম্যান্স!
প্র: কলকাতা নিয়ে সব সময় বাড়তি আবেগ দেখতে পাই আপনার মধ্যে। এর কোনও বিশেষ কারণ আছে?
ইউসুফ: কলকাতায় খেলতে এসে একটা জিনিস দেখেছি। এখানকার মানুষ আমাদের জয় দেখতে চান। এটা আমার দারুণ লাগে। আমরা টিম মিটিংয়ে বার বার এই কথাটা বলি। মাঠে দাঁড়িয়ে বলি নিজেদের চাঙ্গা করতে যে, আমরা এমন একটা শহরের প্রতিনিধিত্ব করছি, যেখানকার মানুষ আমাদের জয় দেখতে ভালবাসে। আমাদের জয় দেখে আনন্দে উৎসব করে। এটা পুরো কেকেআর টিমের কাছেই বিরাট মোটিভেশন।
প্র: ছেলের জন্মদিনের উপহারটা কিনে নিয়েছেন? কবে ছিল জন্মদিন?
ইউসুফ (হাসি): কালই তো ছিল। ১৭ এপ্রিল। উপহার অর্ডার দিয়ে দিয়েছি।
প্র: আপনি গতকাল আইপিএলের ওয়েবসাইটকে বললেন, বেশ চমকে উঠেছেন ছেলের ব্যাট আর বল চাওয়ার আবদারে।
ইউসুফ: আয়ান (ছেলের নাম) ব্যাট আর বল চাওয়াতে অবাক তো হয়েইছি। আমার বাবা ওকে আমাদের ব্যাট নিয়ে গিয়ে হাতে দিয়েছে। ও সেটা ধরার কোনও আগ্রহই দেখায়নি। বাড়িতে আমাদের ব্যাটগুলো যেখানে থাকে, সেখানেই থাকে। আয়ানকে কখনও দেখিনি, সেগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। এ বার আমি কলকাতা থেকে দিল্লি রওনা হওয়ার সময়েই হঠাৎ বলল, ব্যাট আর বল চায়। কিন্তু আমি বেশি অবাক হয়েছি ওর গিফ্ট চাওয়ার মতো পরিণতিবোধ তৈরি হয়ে গিয়েছে দেখে। ওর বয়স মাত্র তিন বছর। এত ছোট বয়সে যে নিজে থেকে কেউ গিফ্ট চাইতে পারে, সেটাই আমার ধারণায় ছিল না!
আরও পড়ুন...
ক্রিকেটের বস দশহাজারি
প্র: কিন্তু ক্রিকেটার বাবা কি দেখে খুশি যে, ছেলেও ব্যাট-বলের খোঁজ করছে?
ইউসুফ (হাসি): এটা হঠাৎ কোনও বাচ্চার আপন মনে নতুন খেলা নাকি সত্যিই খেয়াল হয়েছে? কে জানে! আমি নিশ্চিত হতে পারছি না। আরও একটু দেখা দরকার (হাসি)। ওই যে বললাম না, বাড়িতে তো কখনও ব্যাট ধরতেও দেখি না। তবে আমি চাই, ছেলে নিজের খেয়াল মতোই বেড়ে উঠুক। এখনই আমার কোনও ব্যক্তিগত পছন্দ নেই।
প্র: দিল্লিতে ২১-৩ হয়ে গিয়েছিল টিম। ৩৯ বলে ৫৯ রানের এই ইনিংস নিয়ে কী বলবেন?
ইউসুফ: আমি যে ব্যাটিং অর্ডারে নামি, সেখানে অনেক ম্যাচে নামতেই হয় না। গত বারও তাই হয়েছে। ওপরের দিকের ব্যাটসম্যানরাই হয়তো খেলে দিল। বেশির ভাগ ম্যাচে দু’চার ওভার ব্যাট করার সুযোগ পেয়েছি আমি। সব ম্যাচে তো আমাকে দরকারই পড়ে না টিমের। তাই ঠিক করেছি, যখনই টিমের দরকার পড়বে আমি সুযোগটা হাতছাড়া করব না।
প্র: আপনি কেকেআরের গেমচেঞ্জার। কঠিন পরিস্থিতিতে বার বার ভাল খেলার রহস্য কী?
ইউসুফ: রহস্য কিছুই নেই। এ ভাবেই তো আমি আইপিএলে খেলে আসছি। কলকাতার হয়ে এর আগেও কঠিন পরিস্থিতিতে নেমে মাশাল্লা, ভাল খেলেছি। ম্যাচ জিতিয়েছি। রাজস্থানের হয়ে প্রথম তিন বছর খেলার সময়েও সেটাই আমার কাজ ছিল। রাজস্থানে শেন ওয়ার্ন খুব উৎসাহ দিয়েছিল। ভরসা করেছিল আমার ওপর। ওয়ার্নের ভরসা আমাকে আত্মবিশ্বাসী ক্রিকেটার করে তুলেছিল। ওয়ার্ন খুব বলত, কঠিন পরিস্থিতিতে তুমি জেতাতে পারবে। আমি তোমার ওপর ভরসা রাখি।
প্র: এখন জাক কালিস-রা কী বলছেন? কাল যখন ২১-৩ অবস্থায় নামছিলেন কোটলায়, ওঁরা কী বলছিলেন?
ইউসুফ: কালিস আর আমাদের সহকারী কোচ সাইমন ক্যাটিচ খুব সাহস দিয়েছিল কাল। বলেছিল, তিন উইকেট চলে গেলেও তোমাকেই আমরা পাঠাতে চাই। গিয়ে নিজের খেলা খেলো। বলল, তুমি যদি ভাল খেলো তা হলেই আমরা জিতে যাব।
প্র: তার পর মাঠে গিয়ে মণীশ পাণ্ডের সঙ্গে ওই পার্টনারশিপ। কী প্ল্যান ছিল আপনাদের?
ইউসুফ: আমরা ঠিক করেছিলাম, সিঙ্গলস নিয়ে স্ট্রাইক ঘোরাব। আর বিগ হিটের সুযোগ পেলে সেটাও ছাড়ব না। মাথায় ছিল, তিন উইকেট পড়ে গিয়েছে বলে খোলসে ঢুকে পড়লে হবে না। তা হলে ওরা একদম মাথায় চেপে বসবে। এমনিতেই দারুণ বোলিং আক্রমণ দিল্লির। সম্ভবত এই আইপিএলে সেরা আক্রমণ। তার ওপর কাল খুব আক্রমণাত্মক ছিল।
দিল্লিকে হারিয়ে ফিরলেন ম্যাচের সেরা মণীশ। নিজস্ব চিত্র
প্র: বার বার আপনাদের মুখের ওপর এসে পড়ছিল ওদের পেসাররা। কী ভাবে নিজেদের শান্ত রাখছিলেন?
ইউসুফ: আমি মাঠে ‘কুল’-ই থাকি। আমার যা আক্রমণাত্মক মনোভাব, সেটা থাকে আমার ভিতরেই। মাঠের মধ্যে আগ্রাসী শরীরী ভাষা দেখাই না। আমি মনে করি, ভিতরের আগুনটাই আসল যে, আমাকে লক্ষ্যে পৌঁছতেই হবে। কালও সেটাই ছিল। আমরা ঠিক করেছিলাম, নিজেদের স্ট্র্যাটেজি অনুযায়ী খেলে যাব। যদি খেলা লম্বা চালাতে পারি, তা হলে ওরাই পাল্টা চাপে পড়ে যাবে। তার পর যারা স্নায়ুর চাপটা সামলাতে পারবে, তারাই জিতবে। মণীশ শেষের দিকটা অসাধারণ খেলে ম্যাচ বার করল। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে শেষ পর্যন্ত থেকে জেতানো। মণীশ সেটাই করল।
প্র: দিল্লির বোলারদের আগ্রাসী মনোভাব দেখেও কি এক বারও মনে হল না, পাল্টা গর্জন করে উঠি?
ইউসুফ: না, মনে হয়নি। আর শুনুন, ওরা তিন উইকেট ফেলে দিয়েছিল ২১ রানে। ও রকম আগ্রাসী চোখমুখ তো হবেই ওদের। এটা নিয়ে আমি একদমই অভিযোগ করছি না।
প্র: মণীশকে নিয়ে কী বলবেন?
ইউসুফ: অসাধারণ! মণীশের জন্য আমি খুব খুশি। দুর্দান্ত সব শট রয়েছে ওর হাতে। সেটাই ওকে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে রেখেছে বরাবর। উল্টো দিক থেকে ওর ব্যাটিং দেখে মন ভরে যাচ্ছিল। মণীশের স্ট্রোক নেওয়ার ক্ষমতাটা বিশ্বমানের। ইতনা অচ্ছা খেল রহা হ্যায়, আমি চাই ও অনেক সাফল্য পাক জীবনে।
প্র: ক্রিকেটের বাইরেও তো আপনার অনেক নেশা রয়েছে। যেমন বাড়িতে পাখি পোষা। বাড়িতে নিজস্ব গার্ডেন আছে আপনার। আপনি নাকি পাখিদের সঙ্গে কথাও বলেন?
ইউসুফ: (হাসি) বাড়িতে অনেক পাখি আছে। আমি পশুপাখি-প্রিয় মানুষ। গাছ ভালবাসি। ফুল ভালবাসি। বাড়িতে নানা ধরনের তুলসি আছে। গোলাপ আছে। গাছের প্রতি অনুরাগটা আমার অনেক দিনের। মসজিদের প্রাঙ্গণে থাকার সময় ওখানেও গাছ লাগাতাম। যত জায়গায় আমি খেলতে গিয়েছি, নার্সারি থাকলে আমি যাবই। নানা জায়গার নার্সারি দেখে আরও ভাল ভাবে আইডিয়া তৈরি করেছি, কোন গাছকে কী ভাবে পরিচর্যা করতে হয়।
প্র: আরও তো আছে। এক বার নাকি গির অরণ্যে গিয়ে দু’দিন ধরে বসে ছিলেন নতুন আসা সিংহীকে দেখবেন বলে?
ইউসুফ: (হাসি) হ্যাঁ, গিয়েছিলাম। সিংহ আমি খুব ভালবাসি। লায়ন ইজ আ কিংগ। সিংহের কেশরটা আমার দারুণ লাগে। আর ওই রাজকীয় ভঙ্গিতে হেঁটে চলাটা। দেখে মনে হবে রাজা হেঁটে যাচ্ছে। আমি জঙ্গলে গিয়ে গিয়ে পড়ে থাকি দেখার জন্য। গির আমাদের বডোদরা থেকে কাছে। ৪০০-৫০০ কিলোমিটার দূরত্ব। আমি তাই মাঝেমধ্যেই চলে যাই।
প্র: সব সময় তো দেখতে চেয়েও দেখতে পান না? বসে থাকেন?
ইউসুফ: কত বার বসে থেকেছি। সিংহ আমি অনেক বার দেখেছি। কিন্তু আমার বহু দিনের শখ ওয়াইল্ড লাইফে বাঘ দেখব। জঙ্গলে গিয়ে সামনা-সামনি। এর জন্য আমি ভারতবর্ষের অনেক জঙ্গলে পড়ে থেকেছি। এক বার সকাল থেকে সন্ধে পেরিয়ে রাত পর্যন্ত বসে ছিলাম। সেটা নিয়ম বিরুদ্ধ ব্যাপার। তবু ইনিয়ে-বিনিয়ে ফরেস্ট অফিসারকে অনুরোধ করে থেকে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য যে, এখনও পর্যন্ত জঙ্গলে বাঘ দেখে উঠতে পারিনি। তবে আমি ছাড়ব না। আইপিএল শেষ হলেই শুনবেন, আবার জঙ্গলে ছুটেছি। পড়ে থাকব বাঘ দেখার নেশায়।
প্র: কেকেআর ভক্তরা চাইবেন, জঙ্গলে রওনা হওয়ার আগে বোলার-নিধনের নেশায় পড়ে থেকে আপনি তাঁদের আইপিএল উপহার দিন।
ইউসুফ: জরুর, জরুর। আমারও সে রকমই ইচ্ছা, মাশাল্লা! চেষ্টার কোনও কসুর থাকবে না, এই প্রতিশ্রুতি এখনই দিয়ে দিচ্ছে ইউসুফ ভাই। কলকাতার মানুষরা আমাদের খুব সমর্থন করেন। প্রচুর ভালবাসা পেয়েছি ওঁদের থেকে। তাই কলকাতার মানুষদের মুখে হাসি দেখলে আমার খুব আনন্দ হয়। জঙ্গলে বাঘ দেখতে ছোটার আগে কলকাতাকে তৃতীয় আইপিএল ট্রফি উপহার দিয়ে যেতে চাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy