উল্লাস: সেই মূহূর্ত। শামির থ্রোয়ে রান আউট হচ্ছেন জো রুট। ছবি: রয়টার্স।
কোহালি যুগের সব চেয়ে বড় পরীক্ষার দিন হাজির। রবিবার শেন ওয়ার্নের কাউন্টি মাঠে সেটা দিতে নামবেন তাঁরা।
মোটামুটি ধরে রাখা যেতে পারে এই টেস্ট জিতে ডন ব্র্যাডম্যানের দলের ইতিহাস তাড়া করতে গেলে ভারতকে অন্তত আড়াইশো তুলতে হবে শেষ ইনিংসে। পারলে কোহালি যুগের তো বটেই, ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা জয়। উৎসব করতে করতে ওভাল চলো। না পারলে টাইটানিকের যাত্রা শুরুর শহরে স্বপ্ন তলিয়ে যাওয়া।
যদি প্রথমটা ঘটাতে হয়, কোহালিকে ওয়ান ডে-র ‘চেজমাস্টার’ হয়ে উঠতে হবে। বিস্ময়কর যে, সীমিত ওভারের ক্রিকেটে রান তাড়া করায় দুর্দান্ত রেকর্ড থাকা সত্ত্বেও টেস্টে শেষ ইনিংসে দু’শোর আশেপাশে তুলতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ছে তাঁর দল।
দু’টো সাম্প্রতিকতম উদাহরণ ভারতীয় ক্রিকেট ভক্তদের গভীর উদ্বেগে রাখবে। এ বছরই দক্ষিণ আফ্রিকায় কেপ টাউনে ২০৮ রানের টার্গেট ছিল। কোহালিরা পারেননি। এই সিরিজে এজবাস্টনে চতুর্থ ইনিংসে জেতার জন্য দরকার ছিল ১৯৪। শেষ ইনিংসে ১৬২ অলআউট হয়ে তাঁরা প্রথম টেস্ট হারেন ৩১ রানে। পরিসংখ্যানও খুব একটা ভারতের পাশে নেই। দেখা যাচ্ছে, এশিয়ার বাইরে দু’শোর ওপর রান তাড়া করতে নেমে ৬১ টেস্টের মধ্যে ভারত জিতেছে তিন বার, হেরেছে ৩৬ বার। ড্র ২২। রান তাড়া করে জেতার তিনটে ঘটনা ঘটেছে ২০০৩-০৪ সালে অ্যাডিলেডে (২৩৩-৬), পোর্ট অব স্পেনে ১৯৭৫-৭৬ সালে (৪০৬-৪) এবং ১৯৬৭-৬৮ সালে ডানেডিনে (২০০-৫)।
টেস্ট ক্রিকেটের সেরা রান তাড়া করার ঘটনার মধ্যেও ভারত পড়বে। পোর্ট অফ স্পেনে তেতাল্লিশ বছর আগে ৪০৩ রান তাড়া করে সেই ঐতিহাসিক জয়। কিন্তু সেটা আপাতত ইতিহাসের পাতায়। এই সিরিজে এমনিতেই ব্যাটসম্যানদের রক্তাল্পতা চলছে। সঙ্গে এই প্রজন্মের দলের চতুর্থ ইনিংসে বিপর্যয়ের এক্স-রে রিপোর্ট। সব মিলিয়ে হার্ট স্পেশ্যালিস্টকে সঙ্গে রাখাই ভাল।
ভাগ্যের চাকা কি এখানে ঘুরিয়ে দিতে পারবেন কোহালি? এখনও পর্যন্ত সিরিজে দুর্দান্ত ফর্মে রয়েছেন তিনি। সাত ইনিংসে ৪৮৬ রান নিয়ে সিরিজে এখনও পর্যন্ত সর্বোচ্চ রান সংগ্রহকারী। দ্বিতীয় স্থানে থাকা জস বাটলার অনেক পিছিয়ে। তাঁর সংগ্রহ ২৬০। কোহালির সঙ্গে চেতেশ্বর পূজারাও ফর্ম ফিরে পেয়েছেন। একা কুম্ভ হয়ে পূজারা প্রথম ইনিংসে টেনেছেন। অজিঙ্ক রাহানে ট্রেন্ট ব্রিজে রান পেয়েছেন। ওপেনাররা খুব খারাপ শুরু দিচ্ছেন না। পারবে কি ভারতের ব্যাটিং ইউনিট অগ্নিপরীক্ষায় পাশ করতে? সৌরভের দলকে বিশ্বের অন্যতম সেরা করে তুলেছিল ইডেনে স্টিভ ওয়ের দলকে নাটকীয় যুদ্ধে হারানো। কোহালিরা যদি এই টেস্ট বার করতে পারেন সাউদাম্পটন তাঁদের কাছে হয়ে উঠতে পারে কলকাতা।
তাঁদের আশায় রাখবে পিচ থেকে গতি কমে যাওয়া। এ দিন দেখা গেল নতুন বলেও তুলনামূলক ভাবে অনেক মন্থর গতি। যে কারণে ব্যাটসম্যানের পক্ষে বিপজ্জনক বলও শেষ মুহূর্তে আটকে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। পূজারা দিনের খেলা শেষে সেটাই মনে করিয়ে দিয়ে গেলেন। মইন আলি প্রথম ইনিংসে পাঁচ উইকেট নিয়েছেন। ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় স্পিনারও আছে— লেগস্পিনার আদিল রশিদ। কী ভাবে সামলানো যাবে? পূজারা বললেন, ‘‘মইন আলিকে আমরা বাজে শট খেলে উইকেট উপহারও দিয়েছি। সেই ভুল নিশ্চয়ই শেষ ইনিংসে হবে না।’’
আর যদি টাইটানিকের মতোই বিপর্যয়ের মুখে পড়ে কোহালির দল, তা হলে হিমশৈল হিসেবে থেকে যাবেন স্যাম কারেন। এজবাস্টনে দ্বিতীয় ইনিংসে তাঁর ব্যাট হাতে ঝড়ই খেলা ঘুরিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। এখানে প্রথম ইনিংসে একই কাজ করেছেন। বল হাতে সেট হয়ে যাওয়া কোহালির দুষ্প্রাপ্য উইকেট তুলেছেন। আবারও বুক চিতিয়ে তিনি দাঁড়িয়ে পড়েছেন ভারতীয় বোলারদের সামনে। তৃতীয় দিনের শেষে ইংল্যান্ড ২৬০-৮। তারা এগিয়ে গিয়েছে ২৩৩ রানে। কারেন ৩৭ নট আউট। আদিল রশিদকে শেষ ওভারে তুলে শরীরী ভাষায় আগ্রাসন ফিরিয়ে আনতে পেরেছেন মহম্মদ শামি। তিন উইকেট নিয়ে যিনি এ দিনের সেরা বোলার।
কোহালিকে দেখা গেল রশিদ আউট হতেই আম্পায়ারের ভঙ্গিতে আঙুল তুলে আউট দিচ্ছেন। তার আগের এক ঘণ্টা মতো সময় বেশ শান্ত লাগছিল তাঁকে। যিনি সকালে ইংল্যান্ডের ব্যাটসম্যানের ঘাড়ের উপরে গিয়ে কথা বলছিলেন, তাঁকেই বেশ ম্রিয়মান লাগছিল উইকেট না পড়ায়। জো রুট ব্যাটিং অর্ডারে পিছিয়ে চারে নামলেন। এ সব জায়গায় প্রতিপক্ষ দল অস্ট্রেলিয়া হলে আর দেখতে হবে না। সারাক্ষণ তাঁরা সেই অধিনায়ককে স্লেজ করে যাবে আর মুখের উপরে বলতে থাকবে, কী হে! ভয় পেয়ে ব্যাটিং অর্ডারে পিছিয়ে গেলে?
দেখা গেল কোহালি একই নীতি নিলেন। মইন আলি এলেন তিন নম্বরে। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর কাছে পৌঁছে গেলেন কোহালি। বোঝাই গেল, মইনকে জিজ্ঞেস করছেন, তোমার ক্যাপ্টেন কোথায়? আইপিএলে কোহালির রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোরেই খেলেন মইন। তিনি হেসে ফেললেন। রুট ব্যাট করতে আসার পরে ঝাঁকে ঝাঁকে শব্দবাণ উড়ে গেল তাঁর দিকে।
রুট সব কিছু সহ্য করে লড়াই চালিয়ে গেলেন। তাঁর ৮৮ বলে ৪৮ পরিস্থিতির বিচারে বেশ দামি ইনিংস। ইংল্যান্ড অধিনায়ককে সরাসরি থ্রোতে রান আউট করে মোড় ঘোরানো মুহূর্ত এনে দিয়েছিলেন মহম্মদ শামি। যাঁকে কেউ কখনও দারুণ ফিল্ডার বলে ধরবেই না। এর পর জস বাটলার করে গেলেন ১২২ বলে ৬৯। তিনি এবং স্যাম কারেনই সব চেয়ে বেশি করে কাঁটা বিছিয়ে দিয়েছেন কোহালিদের জয়ের পথে। আপাতত বলা যেতেই পারে অ্যাডভ্যান্টেজ ইংল্যান্ড।
কোহালিদের সব চেয়ে ভোগাল অশ্বিনের ব্যর্থতা। যেখানে মইন আলির মতো স্পিনার প্রথম ইনিংসে নিয়েছেন পাঁচ উইকেট, সেখানে খারাপ হতে থাকা তৃতীয় দিনের পিচে অশ্বিন পেলেন মাত্র এক উইকেট। কোহালি তাঁকে সব চেয়ে বেশি বল করিয়েছেন— ৩৬ ওভার। টেস্ট ম্যাচ শুরুর আগে প্র্যাক্টিসে দেখে আনন্দবাজারে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল, অশ্বিন পুরো ফিট হয়েছেন কি না? এ দিন বিতর্ক শুরু হয়ে গিয়েছে সেটা নিয়েই। মাইকেল ভন প্রশ্ন তুলেছেন, অশ্বিন কি ফিট ছিলেন? এজবাস্টনে যে রকম বল করতে দেখা গিয়েছিল অশ্বিনকে, তার কিছুই তো দেখা গেল না!
অশ্বিনকে ‘ম্যাচ কা মুজরিম’ হওয়া থেকে এখন রক্ষা করতে পারেন দলের ব্যাটসম্যানরাই। আবার মনে হচ্ছে, এই ম্যাচ জিততে গেলে ব্যাটসম্যান নয়, বক্সার লাগবে!
স্কোরকার্ড
ইংল্যান্ড ২৪৬ ও ২৬০-৮
ভারত ২৭৩
ইংল্যান্ড (আগের দিন ৬-০-র পর থেকে দ্বিতীয় ইনিংস)
অ্যালেস্টেয়ার কুক ক রাহুল বো বুমরা ১২
কিটন জেনিংস এলবিডব্লিউ বো শামি ৩৬
মইন আলি ক রাহুল বো ইশান্ত ৯
জো রুট রান আউট শামি ৪৮
জনি বেয়ারস্টো বো শামি ০
বেন স্টোকস ক রাহানে বো অশ্বিন ৩০
জস বাটলার এলবিডব্লিউ বো ইশান্ত ৬৯
স্যাম কারেন ব্যাটিং ৩৭
আদিল রশিদ ক ঋষভ বো শামি ১১
অতিরিক্ত ৮
মোট ২৬০-৮
পতন: ১-২৪ (কুক, ১২.১), ২-৩৩ (মইন, ১৫.৪) ৩-৯২ (জেনিংস ৩১.৫), ৪-৯২ (বেয়ারস্টো, ৩১.৬), ৫-১২২ (রুট, ৪৫.৬), ৬-১৭৮ (স্টোকস, ৬৮.১), ৭-২৩৩ (বাটলার, ৮৪.৬), ৮-২৬০ (রশিদ ৯১.৫)।
বোলিং: আর অশ্বিন ৩৫-৭-৭৮-১, যশপ্রীত বুমরা ১৯-৩-৫১-১, ইশান্ত শর্মা ১৫-৪-৩৬-২, মহম্মদ শামি ১৩.৫-০-৫৩-৩, হার্দিক পাণ্ড্য ৯-০-৩৪-০।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy