এ বার নায়ক। পাঠান ২৪ বলে ৪২। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস।
বড়-বড় চোখ আর অদ্ভুত উচ্চারণে যে টাক মাথা ভদ্রলোককে আইপিএল মাঝেমধ্যেই চেঁচিয়ে উঠতে দেখে, তাঁর নাম বলতে সবচেয়ে খুদে আইপিএল-দর্শকও দেড় সেকেন্ড নেবে না। ভদ্রলোকের নাম ড্যানি মরিসন। অতীতে নিউজিল্যান্ডের পেসার ছিলেন। কিন্তু বর্তমানে বেশি বিখ্যাত নাটুকে কথাবার্তার জন্য। রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ দেখা গেল মরিসন ইডেন-আকাশ দেখে প্রবল উত্তেজিত। বড়-বড় চোখ আকাশে আর চেঁচাচ্ছেন, “দেয়ার গো দ্য গ্রেপস!”
এক নয়, দুই নয়, একশো-দু’শো। ইডেন প্রেসবক্স থেকে ডান দিকে তাকালেই যেটা চোখে পড়বে। বাঁ দিকে তাকালেও। মাটি ছেড়ে আকাশে উঠছে ধীরে-ধীরে, একসঙ্গে একঝাঁক। ‘গ্রেপস’ নয় অবশ্যই। বেলুন। বেগুনি রংয়ের, কেকেআরের জার্সির রঙের। কুচকুচে কালো ইডেন-আকাশে বেগুনি বেলুনের মিলিয়ে যাওয়া দেখতে যদি প্রেসবক্সের বাইরে বেরিয়ে আসেন, চেনা আওয়াজও শুনতে পাবেন। ঢাকের বাদ্যি! ঘোরের এখানে শেষ নয়, গ্যালারিতে তাকালে আর এক বিস্ময়। হাজার-হাজার আলোকবিন্দুতে সৃষ্টি ‘দীপাবলি’! অধুনা প্রজন্মের ক্রিকেট-দর্শককে ক্যামেরার ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে যা করতে দেখা যায় প্রিয় টিম জিতলে।
বেলুন উড়িয়ে, ‘দীপাবলি’ হাজির করিয়ে, শারদোৎসবের বাদ্যি বাজিয়ে শহরের নতুন উৎসবের আগমনী শুনিয়ে গেল বৃহস্পতিবারের ইডেন। আইপিএল নয়। আইপিএল প্লে অফ উৎসবের। যা এখনও শুরু হয়নি, তবে শুরু হল বলে। এগারোয় তেরো পয়েন্ট যখন, নিশ্চিত হচ্ছে। পড়ে আর তিনটে ম্যাচ, টিম এখনই তিনে। পরশুর কলকাতায় সামনে আরও একটা ‘দুগ্ধপোষ্য’ এবং ‘উইকএন্ডে’ প্লে অফ স্লটে সিলমোহর না পড়লে সেটাই বোধহয় ‘ব্রেকিং নিউজ।’ কিন্তু বেলুন-দীপাবলি-ঢাক কি শুধু নতুন ‘তেওহার’-এর আগমন ঘোষণা করেই থেমে থাকল? ফ্র্যাঞ্চাইজি পৃথিবীতে নিজেদের টিমের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের উৎসবটাও কি একই সঙ্গে সদর্পে করে গেল না?
কে বলল, কেকেআর বোলিংয়ে শুধু একটা ব্র্যাড হগ আছে? কে বলল, কেকেআর ব্যাটিং মানে শুধু একটা আন্দ্রে রাসেল? কে বলল, ‘ব্র্যান্ড কেকেআর’ মানে বিপক্ষকে টার্নারের কড়াইয়ে ভেজে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া?
নিন্দুকেরা সে সব যুক্তি-তর্ককে গঙ্গাবক্ষে বরাবরের মতো ভাসিয়ে দিতে পারেন। বৃহস্পতিবারের ইডেন দেখে নিল, কেকেআর মানে একটা সুনীল নারিন নয়। একটা জর্জ ব্র্যাডলি হগও নয়। ওটা এক-এক দিন পীযুষ চাওলাও। দেখে নিল, কেকেআর ব্যাটিং মানে আন্দ্রে রাসেল নয়। গৌতম গম্ভীর নয়। ওটা এক-এক দিন ইউসুফ পাঠান শুধু নয়, জোহান বোথাও! বৃহস্পতিবারের ইডেন চর্মচক্ষে দেখে গেল, ইডেনে কেকেআর মানে ধুলো ওড়া ঘূর্ণি নয়। ওটা এক-এক সময় সামান্য স্পিন-সহায়কে মারণ-স্পিন বোলিংও!
গম্ভীর বোধহয় গত কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সবচেয়ে নিশ্চিন্ত ঘুমটা আজ রাতে ঘুমোতে পারবেন। একই দিনে জোড়া সুখবর ক’বার আর আসে? প্রিয় ‘সানি’ মুক্ত। তার উপর টিম প্রমাণ করে দিয়েছে, তারা ব্যক্তিনির্ভর এগারো নয়। সমষ্টির এগারো।
পীযুষ চাওলা নিয়ে যদি ইন্টারনেটে সার্চ দেন, খুব বেশি মুচমুচে তথ্য পাওয়া যাবে না। চোখ আটকে যাবে দু’টো জায়গায়। এক, চ্যালেঞ্জার ট্রফিতে সচিন রমেশ তেন্ডুলকরকে গুগলিতে বোল্ড করে উত্তরপ্রদেশ লেগস্পিনারের প্রথম শিরোনাম। আর দুই, একই ম্যাচে পরের দিকে মহেন্দ্র সিংহ ধোনি ও যুবরাজ সিংহকে তুলে নেওয়া। এমএসডির বিশ্বজয়ী ওয়ান ডে ও টি-টোয়েন্টি, দুটো টিমেই ছিলেন। কেকেআরে গত বছর থেকে নিরন্তর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। এমনকী আইপিএল সেভেন জয়ে উইনিং স্ট্রোকটাও তাঁর। কিন্তু এ দিনের আগে মনে হয় না কেউ চাওলার স্পিন নিয়ে পাঁচ মিনিটের বেশি সময় খরচ করেছে। তাঁকে নিয়ে রাশি-রাশি নিউজপ্রিন্ট খরচ হয়েছে, এমন অভিযোগও নেই। এ দিনের পর কিন্তু করতে হবে। আর পাঁচ মিনিট কেন, নারিন-হগের মতো সম-গুরুত্ব দিয়ে তাঁর স্পিন নিয়েও ভাবতে হবে।
দিল্লির ডেয়ারডেভিলদের বিরুদ্ধে বোলিং হিসেবটা তো মারাত্মক। ৪-০-৩২-৪!
‘মুক্ত’ নারিন এত দিন পর টিমে ঢুকে প্রতিপক্ষের ধমনীতে স্পিনের বিষ ছড়াবেন, ভাবাটা অন্যায়। হগের এক-আধ দিন ওভারে নয় করে যেতে পারে। বোথা কোনও দিন মারাত্মক স্পিনার ছিলেন না, এ দিনও দেখাল না। কিন্তু দরকারের দিনে অনায়াসে ‘হগ-টু’ হয়ে গেলেন চাওলা। দিল্লি ব্যাটিংয়ের উপর চড়াও হলেন নিঃশব্দ ঘাতক হিসেবে! যে চার দিল্লি ব্যাটসম্যানকে আউট করলেন, তাঁদের মধ্যে দু’জন অন্তত থাকলে ম্যাচ বার করে দিতে পারতেন। যুবরাজ এবং জেপি দুমিনি, এঁদের বাইরে দিল্লি ব্যাটিং বলে কিছু নেই। যুবরাজ লিফট করে ফেলে দিতে গিয়ে বাউন্ডারি লাইনে লোপ্পা। দুমিনি স্লগ সুইপ করতে গিয়ে ধ্বংস। মাঝের একটা ওভারে এসে মাত্র দু’রান দিয়ে দু’টো বার করে দেন চাওলা। ম্যাচটা ওখানে ঘুরে যায়। শেষও হয়ে যায়। মনে রাখতে হবে, ওই সময় কিন্তু দিল্লি আর কেকেআরের রান সমানে-সমানে চলছিল। আর কেকেআর যতই চার স্পিনারের ‘স্পিন-আর্মি’ নামাক, উইকেট মোটেও ধুলো ওড়ানো ঘূর্ণি ছিল না। স্পিন-সহায়ক বড়জোর বলা যেতে পারে। কিন্তু তার সুবিধে নিতে ভাল বোলিংও লাগে।
উত্তরপ্রদেশ স্পিনারকে এ দিন ম্যান অব দ্য ম্যাচ দেওয়া হল। প্রায় সঠিক নির্বাচন। ‘প্রায়’ শব্দটা ব্যবহার করতে হচ্ছে কারণ ওটার অর্ধেক কৃতিত্ব ইউসুফ পাঠানও পেতে পারতেন। ২৪ বলে ৪২-এর সিনিয়র পাঠান যে ইনিংসটা এ দিন খেলে গেলেন, সেটা টি-টোয়েন্টির দুনিয়ায় ‘ক্রিস-কষাঘাতের’ ধারেকাছে থাকবে না। কিন্তু পরিস্থিতির বিচারে টিমের কাছে ‘লেটার মার্কস’ ইনিংস। দিল্লির দুই লেগস্পিনারকে সামলানোর জন্য এ দিন আচমকাই আন্দ্রে রাসেলের আগে চাওলাকে পাঠিয়ে দিলেন গম্ভীর। লেগস্পিনারদের বাঁ হাতি ব্যাটসম্যানরা ভাল সামলে থাকেন ঠিকই, কিন্তু বোলার চাওলা আর ব্যাটসম্যান চাওলা এক জিনিস নন। বরং পাঠান না থাকলে কেকেআর অধিনায়কের ওই সিদ্ধান্ত গতিপথ পাল্টে তাঁর দিকেই ছুটে আসতে পারত। কারণ ১৯ বল খেলে ২২-এর বেশি এগোতে পারেননি চাওলা। একটা সময় বাউন্ডারি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তার পর রাসেল নামতে না নামতেই আউট। ক্যারিবিয়ান ক্যালিপসো যা পারেনি, পাঠান-পরাক্রম এ দিনের মতো তা করে দিল। তাই তাঁকে অর্ধেক কৃতিত্ব। নাহ্, সেটাও বা কী করে? ব্যাটসম্যান বোথা— তাঁর কি কিছু প্রাপ্য নয়? আগাগোড়া দুর্ধর্ষ বোলিং করে যাওয়া জাহির খানকে শেষ ওভারে ইনিই তো আঠারো নিলেন! কেকেআরের জয়ের ব্যবধানটা ঠিক যেন কত আজ? তেরো না?
পরিশেষে: ম্যাচটার দু’টো অন্য আঙ্গিকও ছিল। দু’টো টিম মিলিয়ে তিন জন প্রাক্তন খ্যাতনামা ভারতীয় ক্রিকেটার ছিলেন। যাঁরা বহু দিন জাতীয় দলে নেই। জাহির খান এঁদের মধ্যে তুলনায় ভাল করলেন। গম্ভীর পারলেন না। জাহিরের কাছেই আউট। আর যুবরাজকে দেখলে ক্রিকেটপ্রেমীদের দুঃখ হবে। ব্যাটে শূন্য, উথাপ্পার একটা লোপ্পা ছাড়লেন। দ্বিতীয় আঙ্গিক, বাংলার মনোজ তিওয়ারির কলকাতার বিরুদ্ধে নেমে পড়া। অবদান? উথাপ্পার সহজ ক্যাচটা বাউন্ডারি লাইনে হাতে লেগে ছয় হয়ে গেল। ওপেন করলেন এবং ২৮ বলে ২৫। ঋদ্ধিমান সাহার বঙ্গ-বিক্রমের ইনিংস বোধহয় জীবদ্দশায় এক-আধবারই ঘটে!
সংক্ষিপ্ত স্কোর
নাইট রাইডার্স ১৭১-৭ (পাঠান ৪২, উথাপ্পা ৩২, তাহির ২-৪৬)।
দিল্লি ডেয়ারডেভিলস ১৫৮-৬ (শ্রেয়স ৪০, দুমিনি ২৫, চাওলা ৪-৩২)।
এগোচ্ছেন ধবনরাও
সংবাদ সংস্থা • মুম্বই
ডেল স্টেইন এবং ট্রেন্ট বোল্ট ছিলেন না। তা সত্ত্বেও রাজস্থান রয়্যালসকে সাত রানে হারিয়ে আইপিএলের পঞ্চম জয় পেল সানরাইজার্স হায়দরাবাদ। দশ ম্যাচের শেষে শিখর ধবনদের পয়েন্ট দশ। টেবলে স্থান পঞ্চম। ওপেন করতে নেমে ডেভিড ওয়ার্নার (১৮ বলে ২৪) না পারলেও হায়দরাবাদের হয়ে ব্যাটে রানের ফুলঝুরি দেখান আর এক ওপেনার ধবন (৩৫ বলে ৫৪) ও ইয়ন মর্গ্যান (২৮ বলে ৬৩)। সানরাইজার্স তোলে ২০১-৪। জবাবে রাজস্থানের দুই ওপেনার অজিঙ্ক রাহানে (৮) এবং শেন ওয়াটসন (১২) দ্রুত প্যাভিলিয়নে ফেরেন। মিডল অর্ডারে স্টিভ স্মিথ (৪০ বলে ৬৮) পরিস্থিতি কিছুটা সামাল দিয়ে আশা জাগিয়েছিলেন। কিন্তু তা কাজে আসেনি। শেষ পর্যন্ত রাজস্থানের ইনিংস ১৯৪-৭ থেমে যায়। ম্যাচের সেরা মর্গ্যান।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy