Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Neymar

বিশ্বকাপের আগে কি জেলে যাবেন নেমার? কার জন্যে তাঁকে ছুটতে হচ্ছে স্পেনের আদালতে?

নেমারের বিরুদ্ধে অভিযোগ, স্যান্টোস থেকে বার্সেলোনায় যাওয়ার সময় যে চুক্তি হয়েছিল, তাতে প্রতারণা এবং বিপুল পরিমাণে আর্থিক তছরুপ জড়িয়ে রয়েছে। বিশ্বকাপের আগে কি জেলে যেতে হবে তাঁকে?

বিশ্বকাপের আগে জেলে যাওয়ার সম্ভাবনা নেমারের।

বিশ্বকাপের আগে জেলে যাওয়ার সম্ভাবনা নেমারের। ছবি রয়টার্স

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২০ অক্টোবর ২০২২ ১৪:২৫
Share: Save:

ক’দিন পরেই ব্রাজিলের জার্সি গায়ে বিশ্বকাপ খেলতে নামবেন। গোটা দেশ তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। ২০ বছর পর ট্রফি কি তিনি এনে দিতে পারবেন? নেমার দ্য সিলভা স্যান্টোস জুনিয়র জানেন না। দেশবাসীকে দরাজ গলায় তিনি ভরসাও দিতে পারছেন না। কারণ বিশ্বকাপের এক মাস আগে মাঠের বদলে তাঁকে হাজিরা দিতে হচ্ছে বার্সেলোনার আদালতে। নেমারের বিরুদ্ধে অভিযোগ, স্যান্টোস থেকে বার্সেলোনায় যাওয়ার সময় যে চুক্তি হয়েছিল, তাতে প্রতারণা এবং বিপুল পরিমাণে আর্থিক তছরুপ জড়িয়ে রয়েছে। স্যান্টোসে থাকাকালীন নেমারের আর্থিক স্বত্ব যে সংস্থার হাতে ছিল, তার মালিক প্রাপ্য অর্থ ফেরত পাওয়ার আবেদন জানিয়ে মামলা করেছেন। সেই মামলার শুনানিতেই হাজিরা দিতে হচ্ছে নেমারকে।

অনেক দিন আগেই বার্সেলোনা ছেড়ে ফ্রান্সের ক্লাব প্যারিস সঁ জরমঁতে চলে গিয়েছেন নেমার। বিশ্ব ফুটবলে নিজেকে আরও প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন দেখেছিলেন। এখনও তা বাস্তবায়িত হয়নি। পিএসজি-র হয়ে যে দিন গোল করে উৎসব করলেন, পরের দিনই স্যুট-টাই পরে তাঁকে হাজির হতে হল বার্সেলোনার আদালতে। নেমারকে আদালতে টেনে আনার পিছনে রয়েছেন একজনই, দেলসির সোন্দা।

কে এই সোন্দা?

সংক্ষেপে বলতে গেলে, ব্রাজিলের এক বিরাট সুপারমার্কেট চেনের মালিক। সেই সঙ্গে তাঁর সংস্থা ডিআইএস ব্রাজিলের উঠতি ফুটবলারদের আর্থিক স্বত্বের মালিক। তাঁর সংস্থা ব্রাজিলে বিভিন্ন উঠতি এবং প্রতিভাবান ফুটবলার দেখলেই তাঁদের সঙ্গে আর্থিক স্বত্বের চুক্তি করে নেয়। সেই ফুটবলার সোন্দার সংস্থা থেকে বড় অঙ্কের অর্থ পান। পরে তাঁকে অন্য ক্লাবে বিক্রি করে দেওয়া হলে ডিআইএস-ও নিজেদের আর্থিক স্বত্ব সংশ্লিষ্ট ক্লাবের কাছে বিক্রি করে মোটা মুনাফা রোজগার করে। তবে সোন্দার দাবি, নেমারের ক্ষেত্রে চুক্তির নিয়ম মানা হয়নি। ফলে তাঁর সংস্থার বড় ক্ষতি হয়েছে। তিনি টাকা ফেরত চান বটেই, তবে সোন্দার কাছে অর্থই মূল কথা নয়। তিনি চান সঠিক বিচার। বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবলার এবং বার্সেলোনা কী ভাবে তাঁর সংস্থাকে ফাঁকি দিয়ে মোটা মুনাফা করল, সেই সত্য প্রকাশ্যে আনার দাবি করেছেন। আদালতের এই ‘লড়াই’ তাঁর কাছে অনেক বেশি আত্মসম্মানের। নেমার এবং তাঁর পরিবারকে যদি জেলে যেতে হয় এবং বিশ্বকাপের আগে যদি ব্রাজিল ধাক্কাও খায়, তাতেও সোন্দা পরোয়া করবেন না।

দেলসির সোন্দা।

দেলসির সোন্দা।

নেমারকে সোন্দা প্রথম দেখেছিলেন অনেক বছর আগে। তখন ব্রাজিলের আর চার-পাঁচ জন বাচ্চা ছেলের মতো কংক্রিটের মাঠে ফুটবল খেলতেন নেমার। এক দিন নৌকাবিহার করার সময় নেমারকে প্রথম দেখতে পান। নৌকা থামিয়ে খেলা দেখতে দেখতে হঠাৎই ঝাঁকড়াচুলো একটি ছেলেকে খুবই পছন্দ হয়ে যায় সোন্দার। এ ছেলেকে তো সহজেই বাকিদের থেকে আলাদা করা যায়। সোন্দা খোঁজখবর রাখতে শুরু করেন সেই ছেলেটির দিকে।

প্রতিভা থাকায় নেমারের ক্লাব পেতে অসুবিধা হয়নি। তিনি যোগ দেন স্যান্টোসে। সেই স্যান্টোস, যে ক্লাবে খেলে বিখ্যাত হয়েছেন পেলে। নেমার যে সময় ক্লাবে যোগ দেন, তখন আর্থিক সঙ্কটে ভুগছে স্যান্টোস। নেমার যে প্রতিভাবান, সেটা বুঝতে পেরে অনেক আগে থেকে ইউরোপের বিভিন্ন ক্লাবের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে স্যান্টোস। ক্লাবের হয়ে তখন প্রতি ম্যাচেই মাঠ মাতাচ্ছেন নেমার। ১৪ বছরের নেমারকে এক মাসের জন্য রিয়াল মাদ্রিদে গিয়ে অনুশীলন করান বাবা। রিয়াল তখনই নেমারকে চুক্তি করানোর তোড়জোড় শুরু করে দেয়। কিন্তু ফিফার নিয়মের দোহাই দেখিয়ে নেমারকে ব্রাজিলে ফেরত আসার নির্দেশ দেয় স্যান্টোস।

এই সময়েই স্যান্টোস নেমারের ৪০ শতাংশ আর্থিক স্বত্ব বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেয়। সোন্দা তা কিনে নেন। তখন তিনি ২০ লক্ষ ডলার খরচ করেছিলেন তার জন্যে। রাতারাতি বড়লোক হয়ে যান নেমার। ওই অর্থের একাংশ দিয়ে কিনে নেন নতুন বাড়ি। ব্রাজিলের ফুটবল ব্যবস্থায় সেই সময়ে সোন্দার মতো ব্যবসায়ীদের খুবই চাহিদা। আর্থিক সঙ্কটে ভুগতে থাকা বেশির ভাগ ক্লাবই অতিরিক্ত অর্থের আশায় নিজেদের দলে থাকা বিভিন্ন প্রতিভাবান ফুটবলারদের আর্থিক স্বত্ব বিক্রি করত। ওই ব্যবসায়ীরা সেটি কিনে নিয়ে সংশ্লিষ্ট ফুটবলার এবং ক্লাবকে অর্থ দিতেন। পরে সেই ফুটবলার অনেক বেশি দামে অন্য ক্লাবে চলে গেলে সেই ব্যবসায়ী এবং ক্লাব, দু’পক্ষেরই লাভ হতেন। সোন্দাও ছিলেন তেমন এক জন। নেমারের আর্থিক স্বত্ব নিশ্চিত করার পর তিনি খুলে ফেলেন নিজের সংস্থা, নাম দেন ‘ডিআইএস’। পরের দিকে অনেক প্রতিভাবান ফুটবলারের আর্থিক স্বত্ব কিনেছে তার সংস্থা। তাঁদের অনেকে দেশের হয়েও খেলেছেন। যাঁরা খেলতে পারেননি, তাঁদের নিজের সুপারমার্কেট চেনে কাজ দিয়েছেন সোন্দা।

নেমার সবার থেকেই আলাদা ছিলেন। উচ্চাকাঙ্ক্ষী বরাবরই। সোন্দা বুঝতে পেরেছিলেন, আর যা-ই হোক, নেমারকে কখনও তাঁর সুপারমার্কেটে কাজ করতে হবে না। নেমার তখন সোন্দার কাছে সোনার হাঁস, যাঁকে ঠিক মতো ব্যবহার করতে পারলে রাতারাতি ফুলেফেঁপে ওঠা সম্ভব। বাগড়া দেন নেমারের বাবাই। ডিআইএস-এর সঙ্গে তখনও আর্থিক চুক্তি হয়নি নেমারের। তার আগে নেমারের বাবা অন্য কিছু সংস্থার কথা বলা শুরু করেন। লক্ষ্য ছিল আরও বেশি টাকার আর্থিক স্বত্ব। ব্যাপারটা ভাল ভাবে নেননি সোন্দা। তিনি জানিয়ে দেন, ২০ লক্ষ ডলারের একটিও বেশি অর্থ তিনি দেবেন না। নেমারের বাবা রাজি হয়ে যান। সোন্দার সঙ্গে নেমারের পরিবারের সম্পর্কও ভাল হয়। ম্যাচের পর সোন্দা নেমারের বাড়ি গিয়ে বিলিয়ার্ডস খেলতেন। একসঙ্গে পরিবারের সঙ্গে পিজ়‌া খেতেন।

মায়ের সঙ্গে আদালতে নেমার।

মায়ের সঙ্গে আদালতে নেমার। ছবি রয়টার্স

২০১১ থেকে হঠাৎই সম্পর্কের অবনতি হতে শুরু করে। নেমারের বাবা এক দিন সোন্দাকে বলে বসেন, আর্থিক স্বত্ব ফিরিয়ে দিতে। ব্রাজিলের ব্যবসায়ী অবাক হয়ে যান। শুধু তাই নয়, যে অর্থ তিনি নেমারকে দিয়েছিলেন, তার থেকে অনেক বেশি অর্থ দাবি করেন নেমারের বাবা। সোন্দা রাজি হননি। তত দিনে তাঁর চোখে পড়েছে রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনার মতো ক্লাবের খবর, যারা বিপুল দামে নেমারকে কিনতে আগ্রহী। স্যান্টোসও তখন বিভিন্ন ক্লাবের সঙ্গে দরাদরি করা শুরু করে দিয়েছে।

এর মাঝেই নেমারের বাবার সঙ্গে বার্সেলোনার গোপনে চুক্তি হয়ে যায়। স্যান্টোস বা সোন্দা কেউই ঘুণাক্ষরেও সে কথা জানতে পারেননি। সেই চুক্তি অনুযায়ী নেমারের বাবার তৈরি করা একটি সংস্থায় প্রথমে ১০ মিলিয়ন ইউরো এবং পরে ৩০ মিলিয়ন অর্থ ট্রান্সফার করে। পরে এই চুক্তির কথা জানতে পেরে সোন্দার সংস্থা চিঠি পাঠায় বার্সেলোনাকে। স্প্যানিশ ক্লাব তা অস্বীকার করে। সময়টা ২০১৩। স্যান্টোসও তখন অধৈর্য হয়ে পড়েছে। হাত থেকে সবচেয়ে মূল্যবান ফুটবলার বেরিয়ে যেতে পারে, এই ভেবে আর্থিক স্বত্বে অনেকটাই ছাড় দিয়ে বার্সেলোনাতে নেমারকে বিক্রি করে দেয় তারা। ডিআইএসের পাওয়ার কথা ছিল ৩ কোটি ৫০ লক্ষ ইউরো। বদলে মাত্র ৬৮ লক্ষ ইউরো জোটে তাদের কপালে।

সেই থেকেই আইনি লড়াই শুরু। ২০১৬-য় এক বার নেমার দাবি করেন, তিনি সোন্দাকে চেনেন না। সোন্দার আইনজীবী সেই দাবি খারিজ করে নেমার এবং তাঁর মক্কেলের পুরনো অনেক ছবি আদালতের সামনে পেশ করেন। সোন্দার এখন একটাই দাবি, প্রাপ্য অর্থ পাওয়া এবং জালিয়াতির দায়ে নেমার এবং তাঁর বাবার কারাবাস। মাঝে বার বার সোন্দার কাছে হাজির হয়ে এই মামলা ধামাচাপা দেওয়ার অনুরোধ করেছে বার্সেলোনা। অর্থও দিতে চেয়েছে। সোন্দা কোনও কিছুতেই রাজি হননি। তিনি সত্যিটা জানতে চান।

ব্রাজিল বিশ্বকাপ না জিততে পারলেও সোন্দার যায় আসে না। তিনি সাফ বলে দিয়েছেন, “নেমারের উপর কিছুই নির্ভর করছে না। ও তো আর পেলে নয়।”

অন্য বিষয়গুলি:

Neymar Fraud Court FC Barcelona pele
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy