রেফারির সঙ্গে তর্ক করছেন মেসি। ছবি: রয়টার্স
গ্রুপ পর্ব পর্যন্ত সবই ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু বিশ্বকাপ নকআউটে গড়ানোর পরেই দেখা গিয়েছে অদ্ভুত ব্যাপার। কোনও দল ম্যাচ হারলেই কাঠগড়ায় তুলে দিচ্ছে রেফারিকে। তাদের দাবি, রেফারির বিতর্কিত সিদ্ধান্তেই ম্যাচ হেরেছে তারা। এমনকি, ম্যাচ জিতলেও রেফারিকে তুলোধনা করতে ছাড়ছেন না অনেকে। ফলে শেষের দিকে এসে হঠাৎই বিতর্কের সম্মুখীন হচ্ছে ফিফা। প্রতি ম্যাচে সতর্ক হয়ে রেফারি নিয়োগ করতে হচ্ছে তাদের।
কয়েকটি উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটি বোঝা যাবে। কোয়ার্টার ফাইনালে প্রথম ম্যাচে নেদারল্যান্ডসকে টাইব্রেকারে হারায় আর্জেন্টিনা। সেই ম্যাচে রেফারির ভূমিকা এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে। স্পেনের রেফারি মাতেউ লাহোজের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছিলেন খোদ লিয়োনেল মেসি। দু’দল মিলিয়ে মোট ১৫ জনকে হলুদ কার্ড দেখান তিনি। অনেকেই মনে করেছেন, ম্যাচ তাঁর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল। মেসি ক্ষোভ দেখানোয় সেই রেফারিকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়! ফ্রান্স বনাম ইংল্যান্ড ম্যাচে ব্রাজিলের রেফারি উইল্টন সাম্পাইয়োকে নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক হয়। ইংরেজরা দাবি করে, সেই ম্যাচে একটি নিশ্চিত পেনাল্টি থেকে বঞ্চিত হয়েছে তারা। মরক্কোর কাছে কোয়ার্টারে হেরে পর্তুগাল বিদায় নেওয়ার পর পেপে এবং ব্রুনো ফের্নান্দেস অভিযোগ করেন, আর্জেন্টিনার রেফারিই তাঁদের হারিয়ে দিয়েছেন। প্রথম সেমিফাইনালে হেরে ক্রোয়েশিয়া রেফারির বিরুদ্ধে বঞ্চনার অভিযোগ তোলে। ফ্রান্সের কাছে অপর সেমিফাইনালে হেরে তো রেফারির বিরুদ্ধে ফিফার কাছে অভিযোগই জানিয়ে বসেছে মরক্কো।
কেন বার বার রেফারিদের কাঠগড়ায় তোলা হচ্ছে? নিরপেক্ষ রেফারি দিয়ে ম্যাচ খেলিয়েও এ ক্ষেত্রে লাভ হচ্ছে না। মেসিকেও দেখা গিয়েছে রেফারিং নিয়ে সরব হতে। আনন্দবাজার অনলাইন যোগাযোগ করেছিল একাধিক ডার্বি এবং আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলানো বাংলার রেফারি প্রাঞ্জল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তিনি বলেছেন, “বেশির ভাগ সময়েই হতাশার থেকে ফুটবলাররা এমন অভিযোগ করেন। পর্তুগালের ম্যাচে আর্জেন্টিনার রেফারি কেন থাকবে, এই নিয়ে প্রশ্ন তোলা অবান্তর। নিরপেক্ষ দেশের রেফারি থাকাই মূল ব্যাপার। তবে আমি সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছি নেদারল্যান্ডস ম্যাচে মেসির আচরণে। ওর মতো বড় ফুটবলারের কখনওই উচিত হয়নি প্রকাশ্যে রেফারির বিরুদ্ধে মুখ খোলা।”
এক ম্যাচে ১৫টি হলুদ কার্ড হয়তো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যই করা হয়েছিল। একমত প্রাঞ্জল। বললেন, “নেদারল্যান্ডস ম্যাচে রেফারি অতগুলি হলুদ কার্ড দেখিয়েছেন বলেই ম্যাচটা নিয়ন্ত্রণে ছিল। না হলে ম্যাচে একাধিক বার খেলোয়াড়দের ঝামেলা করতে দেখা গিয়েছে। সেখানে হলুদ কার্ড দেখানো হয়েছে বলেই বাকি সময়টা তাঁরা সতর্ক ছিল। কারণ, আর একটা হলুদ কার্ড দেখলে মাঠ থেকে বেরিয়ে যেতে হত। হলুদ কার্ড না দেখালে ম্যাচ বরং আরও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেত।”
এ বারে শুধু ভার নয়, এত রকমের প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রতি মুহূর্তে হাজার হাজার তথ্য জমা পড়ছে কম্পিউটারে। তার পরেও কি রেফারিকে দোষ দেওয়া যায়? প্রাঞ্জল বললেন, “যে ভাবে প্রযুক্তি এ বার সাহায্য করছে, তাতে আমার মতে রেফারিদের সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তোলায় কোনও জায়গাই নেই। রেফারি এখন আর খলনায়ক নন। আগে ভাল করে পরীক্ষা করছেন তাঁরা। তার পরেই সিদ্ধান্ত জানাচ্ছে। হেরে গিয়ে রেফারিকে কাঠগড়ায় তোলাই যায়। তবে সেটা নেহাতই হতাশা বহিঃপ্রকাশ।”
প্রসঙ্গত, গ্রুপ পর্বে উরুগুয়ে-ঘানা ম্যাচে রেফারি ছিলেন জার্মানির ড্যানিয়েল সিবার্ট। শেষ কয়েক মিনিট বার বার তাঁর উপর চাপ দিচ্ছিলেন উরুগুয়ের ফুটবলাররা। কিন্তু তাতে কার্যসিদ্ধি হয়নি। ম্যাচ শেষের বাঁশি বাজানোর সঙ্গে সঙ্গে সিবার্টকে ঘিরে ধরেন কাভানিরা। মাঠ ছেড়ে তখন টানেলের দিকে এগোচ্ছিলেন সিবার্ট। কিন্তু উরুগুয়ের ফুটবলাররা তাঁকে ঘিরে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন। সেই সময়েই আঘাত করেন জিমেনেজ। রেফারিকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসেন সেখানে উপস্থিত নিরাপত্তারক্ষীরা। বাকি সময়টা সিবার্টকে ঘিরে ছিলেন তাঁরা। সাজঘর পর্যন্ত সে ভাবেই রেফারিকে নিয়ে যান নিরাপত্তারক্ষীরা।
এর পর নেদারল্যান্ডস ম্যাচের মধ্যে মেসির সঙ্গে তর্কাতর্কি হয় রেফারি লাহোজের। ম্যাচ শেষে আর্জেন্টিনার তারকা ফুটবলার বলেন, “রেফারি সম্পর্কে আমি কিছু বলব না। কারণ সকলের সামনে যা বলব সেটা সত্যি হবে না। আমার মনে হয় ফিফার ভেবে দেখা প্রয়োজন, এ রকম ম্যাচে এই ধরনের রেফারিকে দায়িত্ব দেওয়া উচিত কি না। এমন রেফারিকে দায়িত্ব দেওয়া উচিত নয়, যে কাজটার যোগ্য নয়।’’ খেলতে নামার আগেই রেফারি নিয়ে প্রশ্ন ছিল মেসিদের মনে। সেটাও জানিয়েছেন তিনি। আর্জেন্টিনার অধিনায়ক বলেন, “রেফারির নাম দেখে ম্যাচ শুরুর আগেই আমরা ভয়ে ভয়ে ছিলাম। এমন গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে এই ধরনের রেফারিকে দায়িত্ব দেওয়াই উচিত নয়।”
মরক্কোর কাছে হারের পর আর্জেন্টিনার রেফারি সম্পর্কে ম্যাচ শেষে ফের্নান্দেস বলেন, ‘‘ওরা আর্জেন্টিনাকেই বিশ্বকাপ দিয়ে দিক। আমি কাউকে পরোয়া করি না। যেটা ভাবছি, সেটাই বলছি। তাতে যা হয় হবে।’’ পর্তুগাল-মরক্কো ম্যাচের রেফারি ছিলেন আর্জেন্টিনার ফাকুন্দো তেয়ো। তিনি ম্যাচে অনেক সিদ্ধান্ত পর্তুগালের বিপক্ষে দিয়েছেন বলে অভিযোগ ফের্নান্দেসের। বলেছেন, ‘‘ফিফা এমন একটা দেশের রেফারিকে দায়িত্ব দিল যারা গ্যালারি থেকে আমাদের শিস্ দেয়। ইচ্ছা করেই তেয়োকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। গোটা ম্যাচে ও কী রকম সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটা সবাই দেখেছে।’’ একই কথা বলেন পেপে। তাঁর কথায়, ‘‘অনেক ফাউল আমাদের বিপক্ষে দেওয়া হয়েছে। ওরা যখন ফাউল করছিল তখন রেফারি কার্ড দেখাচ্ছিল না। শেষে যখন লাল কার্ড দেখাল তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। রেফারি ওদের টেনে খেলিয়েছে।’’
ফ্রান্সের কাছে হারের পর মরক্কো ফুটবল ফেডারেশন একটি বিবৃতিতে লিখেছে, ‘‘ফেডারেশনের তরফে ফিফার কাছে অভিযোগ জানানো হয়েছে। ম্যাচে দু’টি পেনাল্টির সিদ্ধান্ত আমাদের বিরুদ্ধে গিয়েছে। শুধু রেফারি নন, ভার-ও বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখেনি। সেমিফাইনালে এই ধরনের রেফারিং আমাদের হতাশ করেছে। ফিফাকে পদক্ষেপের আবেদন জানাচ্ছি।’’ মরক্কোর অভিযোগ, প্রথমার্ধে বক্সের মধ্যে সোফানি বৌফালকে ফাউল করেন ফ্রান্সের থিয়ো হের্নান্দেস। কিন্তু রেফারি উল্টে বৌফালকেই হলুদ কার্ড দেখান। দ্বিতীয়ার্ধেও সেলিম আমাল্লাকে বক্সের মধ্যে ফাউল করা হয়েছিল বলে অভিযোগ মরক্কোর। দু’টি ক্ষেত্রেই রেফারির সিদ্ধান্ত গিয়েছে ফ্রান্সের পক্ষে। এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ তারা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy