Advertisement
০৬ নভেম্বর ২০২৪

“এখন শুরু করলে মুখ বন্ধ রেখে ক্রিকেট খেলতাম”

বৃহস্পতিবার দুপুরে একুশের মঞ্চ যখন মুখ্যমন্ত্রীর বক্তৃতায় সরগরম। তখন লেক রোডের চারতলার ফ্ল্যাটে তিনি— গোপাল বসু ক্রিকেটীয় জীবনের পুরনো ব্যালান্স শিটটা একান্তে ঝেড়েমুছে বার করছেন। কথা বললেন আনন্দবাজারের সঙ্গে।বৃহস্পতিবার দুপুরে একুশের মঞ্চ যখন মুখ্যমন্ত্রীর বক্তৃতায় সরগরম। তখন লেক রোডের চারতলার ফ্ল্যাটে তিনি— গোপাল বসু ক্রিকেটীয় জীবনের পুরনো ব্যালান্স শিটটা একান্তে ঝেড়েমুছে বার করছেন।

কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ জুলাই ২০১৬ ০৩:১৯
Share: Save:

প্রশ্ন: শনিবার বিকেলে সিএবির লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট পুরস্কার পাবেন। নস্ট্যালজিক লাগছে খুব?

গোপাল: একেবারেই না।

প্র: কী বলছেন? এই সব মুহূর্তগুলোতে তো মানুষ দুদ্দাড়ে রিওয়াইন্ড করতে শুরু করে। ফিল্মের ফ্ল্যাশব্যাকের মতো এক নিমেষে তার কাছে গোটা ক্রিকেটজীবনটা এসে হাজির হয়।

গোপাল: ভাল লাগছে কিন্তু সে রকম কিছু হচ্ছে না। আমি বরঞ্চ সামনে তাকাতে চাই। আরও ভাল ক্রিকেট-লেখক হতে চাই।

প্র: মনে করুন আপনার ক্রিকেট কেরিয়ার শুরুর আগে সৌরভের আবির্ভাব ঘটে গেছে। কিছু তফাত হত?

গোপাল: অবশ্যই হত। সৌরভ ইজ এ হিউজ সিম্বল অফ হোপ। আমি কোচিং ক্যাম্পে আজও ছেলেদের বলি, ওকে দ্যাখো। অদ্ভুত একটা রেফারেন্স পয়েন্ট সৌরভ আমাদের দিয়েছে।

প্র: যেমন?

গোপাল: যেমন নাইন্টি সিক্সে যে বার ও দুটো হান্ড্রেড করল, তার মাসখানেক বাদে আমি টিম নিয়ে ইংল্যান্ডে গেছিলাম। এখনও মনে আছে হিথরো-র ইমিগ্রেশন অফিসার হাতে পাসপোর্ট নিয়ে বলেছিল, ওহ্ ফ্রম দ্য ল্যান্ড অফ গাঙ্গুলি! অসাধারণ লেগেছিল। এর আগে এত বার ইংল্যান্ড গেছি। লোকে বলত ওহ্ ক্যালকাটা? ইউ আর ফ্রম দ্য ল্যান্ড অব টেগোর। কেউ বলত ফ্রম দ্য ল্যান্ড অব রে। এই প্রথম শুনলাম ফ্রম দ্য ল্যান্ড অব গাঙ্গুলি। রোমাঞ্চিত হলাম যে আমাদের শহরের কোনও ক্রিকেটার বিদেশের এতটা কল্পনায় চলে এসেছে।

প্র: বিয়াল্লিশ বছর পিছিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। সালটা ১৯৭৪। মনে করুন আবার সব কিছু নতুন শুরু করার সুযোগ পাচ্ছেন। কী কী বদলাতেন?

গোপাল: আমার মনে হয় অন্য মাইন্ডসেট আনতাম। যে আই হ্যাভ গট টু ডু ইট। করতেই হবে। যদি না করতে পারি, কোটি কোটি টাকা হাতছাড়া হয়ে যাবে। এখনকার সময় এমন যে ইউ কান্ট অ্যাফর্ড টু ফেল। নতুন করে শুরু করলে আমি নিয়মিত জিমে যেতাম। অফ দ্য ফিল্ড জীবন অনেক পার্পাজফুল করতাম।

প্র: তখন পার্পাজলেস ছিল?

গোপাল: উত্তরটা লিখতেই হবে?

প্র: অফ কোর্স।

গোপাল: সত্যি কথা হল, তখন একমাত্র অফ দ্য ফিল্ড জীবন ছিল মদ খাওয়া। আর তাস খেলা। এখনকার দিনে এ সব বিলাসিতার ঝুঁকি নিতামই না।

প্র: অজিত ওয়াড়েকর আপনার স্টেট ব্যাঙ্ক টিমের ক্যাপ্টেন ছিলেন। আজও আপনার ব্যাটিংয়ের প্রশংসা করেন। হায়দরাবাদে মইন-উদ-দৌল্লায় আপনার ব্যাটিং জয়সিংহকে অসম্ভব ইম্প্রেস করেছিল। দুরানি আপনাকে পছন্দ করতেন। তবু ইন্ডিয়ান টিমের দরজা খোলাতে পারেননি কেন?

গোপাল: আমার মনে হয় না ওদের কোনও পাওয়ার ছিল বলে। পাওয়ার ছিল মাত্র দুটো লোকের। গাওস্কর আর পটৌডি। পটৌডির মতো ব্যক্তিত্ব আমি দেখিনি। রুংতা এসে আমদাবাদে আমাদের সামনেই ওকে বললেন, তোমাকে প্রথম দুটো টেস্টের জন্য ক্যাপ্টেন করা হয়েছে। সেটা লয়েডের ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে পাঁচ টেস্ট ম্যাচের সিরিজ। টাইগার জাস্ট ডান হাতটা এগিয়ে দিয়ে পাঁচটা আঙুল দেখাল। বলল, ফাইভ অর নান। সেই বোর্ডকে ওর কথা মানতে হল। এটাই পাওয়ার।

প্র: গাওস্করের সঙ্গে শ্রীলঙ্কায় বেসরকারি টেস্টে আপনার সেঞ্চুরি পার্টনারশিপ ছিল। তার পরেও আপনাকে গাওস্করের জুড়ি দেখা গেল না কেন?

গোপাল: আমি জানি না। কোনও দিন এটা নিয়ে ভাবিওনি। আমি নিশ্চয়ই গাওস্করকে সে রকম কনফিডেন্স দিতে পারিনি। প্লাস ওর নিজের ব্যাটিং নিয়েও তখন অসম্ভব ফোকাসড থাকত। মনে রাখবেন আমি রিটায়ার করার আগে সুনীল একবারই মাত্র ইন্ডিয়ান ক্যাপ্টেন্সি করেছে।

প্র: শোনা যায় কিছু সিনিয়রকে আপনি চটিয়ে দিয়েছিলেন।

গোপাল: আই এগ্রি আই মেড এ ফিউ মিসটেকস। রিটায়ারমেন্টের পরেও তো! এই যে জগমোহন ডালমিয়ার সঙ্গে ঝামেলাটা। যে কোনও বুদ্ধিমান লোক হলে এড়িয়ে যেত। ডালমিয়া তখন ভারতীয় ক্রিকেটের সর্বেসর্বা। কেউ ওঁর সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে যায়? অথচ আমি কোচিংকে কেন্দ্র করে একটা নীতিগত যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লাম। কত সব দরজা খুলে যেতে পারত আমার জীবনে। সব বন্ধ হয়ে গেল।

প্র: এটা তো খেলার পরে। আমি বলছি খেলোয়াড়জীবনের কথা।

গোপাল: হ্যাঁ খেলোয়াড়জীবনেও তো ভুল হয়েছে। আমার প্রবলেম ছিল চুপ করে থাকতে পারিনি। অন্যায় মনে হলে সরাসরি প্রতিবাদ করেছি। আজ মনে হচ্ছে সেগুলো না করলেই হত। আজ মনে হয় তুমি যদি সচিন তেন্ডুলকর না হও, তা হলে বাবা প্রতিবাদে যেও না।

প্র: সচিন কেন?

গোপাল: এ জন্যই যে, একমাত্র সচিন লড়াই করে জিততে পারবে। ওকে বাদ দেওয়ার ক্ষমতা কারও নেই। মোহিন্দর অমরনাথকে দেখুন না। অত বড় ক্রিকেটার অথচ সে ভাবে খেলতেই পারল না। সিলেক্টরদের ‘জোকার’ বলে বাদ হয়ে গেল। সিলেক্টর হিসেবে শ্রীনিবাসনের বিরুদ্ধে যেতে গিয়ে আবার বাদ পড়ল। ছেলেদের তাই বলব, মুখ খোলার দরকার নেই। ক্ষতিই ক্ষতি। বরং মুখ বুজে ক্রিকেট খেলো।

প্র: বোর্ড অফিশিয়ালদের সাহায্য পাননি?

গোপাল: ধুর। আজ মনে পড়ছে জয়পুরের একটা ঘটনার কথা। সে বার বোর্ডের ট্রেজারার আমাদের ম্যাচ দেখতে এসেছিলেন। নামটা মনে নেই। আমি ওঁকে বলি, আমাদের সেভেন্টি ফোর ইংল্যান্ড ট্যুরের টাকাটা তো এখনও পুরো পেলাম না। কবে পাব? উনি নালিশ করে দেন রুংতাকে। এর পর রুংতা আমাকে হুমকি দিলেন, তুমি বোর্ড অফিশিয়ালকে অপমান করলে? ইমিডিয়েটলি ক্ষমা চাও। আমি পাল্টা বলি, ক্ষমা? নিজের মৃতদেহের ওপর দাঁড়িয়েও চাইব না। তখন রুংতাকে চটিয়ে দেওয়া মানে ইন্ডিয়ান টিমে ঢোকার রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া। যে টিমটা নিউজিল্যান্ড আর ওয়েস্ট ইন্ডিজ যাচ্ছিল সেটা থেকে আমি বাদ পড়লাম।

প্র: অনেকে বলে সেই যুগ্ম সফরে বাদ পড়ার কারণ অন্য। নর্থ জোন ম্যাচে যথেষ্ট কারণ না থেকেও ইডেনে আপনার নিজেকে সরিয়ে নেওয়া নাকি ক্যাপ্টেন বেদীকে চটিয়ে দিয়েছিল।

গোপাল: দাঁড়ান দাঁড়ান এর কারণটা জানতে হবে (উঠে গেলেন। ফিরে এলেন, হাতে চারটে ইনহেলার)। দেখুন এটাই বহু ম্যাচ থেকে আমার সরে যাওয়ার কারণ। হাঁপানি— যা সারা জীবন আমাকে ভুগিয়েছে। কেউ বিশ্বাস না করলে আমি কী করব?

প্র: একটা গল্প শুনেছি। সত্যি কি না জানি না। পটৌডিকে নাকি সিগারেটের আগুন অফার করে আপনি চটিয়ে দিয়েছিলেন।

গোপাল: এটা থাক না। এটা আজও ভাবলে আমার লজ্জা লাগে। পরে আবিষ্কার করেছি টাইগার খুবই ভদ্রলোক ছিল। আমার উচিত হয়নি।

প্র: তা-ও বলুন।

গোপাল: আমরা আমদাবাদ থেকে ইরানি ট্রফি খেলে মুম্বই ফিরছি। ট্রেনে জোর আড্ডা হচ্ছে। হঠাৎ টাইগার সিগারেট ঠোঁটে নিয়ে তুড়ি মারল, এই দেখি আগুনটা দেখি। মুহূর্তে আমার মাথা গরম হয়ে যায়। তুড়ি মারবে কেন? আমরা তো বেয়ারাকেও তুড়ি মেরে ডাকি না। আমি ওর সিগারেটটা নিয়ে পা দিয়ে পিষলাম। তার পর নিজের সিগারেটটায় আগুন ধরিয়ে ওকে দিলাম। আজ ভাবলে নিজেরই লজ্জিত লাগে।

প্র: তার পর কী হল?

গোপাল: সবাই স্টান্‌ড। এ রকম কেউ কখনও দেখেনি। নবাবের সঙ্গে সেই সময় এ রকম ব্যবহার অবিশ্বাস্য।

প্র: পরের বছর চেন্নাই টেস্টে যখন ওপেনিংয়ে আপনাকে বাদ দিয়ে পটোডি সোলকারকে খেলালেন, তখন নিশ্চয়ই মনে হয়েছিল একটা সিগারেটের আগুন আমার টেস্ট ক্যাপ কেড়ে নিল!

গোপাল: মনে হয়নি। পরবর্তীকালে আমি বুঝেছিলাম, টাইগার মোটেই উঁচু-নিচু ভেদাভেদ রাখত না। আর আমাকে বাদ দিয়ে ওই টেস্টে সোলকারকে খেলানোটা আজ মনে হয় ওয়াজ অ্যান আউটস্ট্যান্ডিং ডিসিশন। আমি কী করতাম? বড়জোর ব্যাটে পঞ্চাশ। সোলকার সেখানে ব্যাটে কিছু রান করবে। বল করবে। সবচেয়ে বড় কথা, যেখানে তিনটে স্পিনার টিমে, সেখানে ফরোয়ার্ড শর্ট লেগে ক্যাচ ধরে দেবে। একটা রিচার্ডস বা লয়েডের ক্যাচ ধরলেই তো যথেষ্ট। তার নেট এফেক্ট সেঞ্চুরির মতো।

প্র: আজ ফিরে তাকিয়ে কী মনে হয়?

গোপাল: যথেষ্ট ভালই লাগে। আমি শুরু করেছিলাম স্পিনার হিসেবে। উইকেটও পাচ্ছিলাম রেগুলার। ইরানি ট্রফিতে একাত্তরে খেলি স্পিনার হিসেবে। তার পর হঠাৎ বজ্রাঘাত। চাকিংয়ের জন্য আমাকে ডাকা হল। ঠিক ক’দিন আগেই বোর্ডের চিঠি পকেটে পেয়েছি। যেখানে লেখা, প্রসন্ন-বেঙ্কটরা ওয়েস্ট ইন্ডিজ যেতে রাজি না হলে তুমি স্পিনার হিসেবে যাবে। এর পর মুম্বই থেকে ফেরার ট্রেনে গোটা রাস্তা কথা বলতে পারিনি। তখন এনসিএ ছিল না। কোনও ইনস্ট্রাকটর ছিল না। সব একা একা। কলকাতা ফিরে ঠিক করি, নতুন দরজা খোলাতে হবে। হোয়াইট বর্ডারে মিডিয়াম পেসার থেকে যদি রেস্ট অব ইন্ডিয়ার অফস্পিনার হতে পারি, ব্যাটসম্যানও হতে পারব। ব্যাটিংয়ে মন দিলাম। তিন বছরের মধ্যে ইরানি খেলি ওপেনার হিসেবে।

প্র: সেই ইরানিতেই মুম্বইয়ের বিরুদ্ধে দুর্ধর্ষ ১৭০ করলেন।

গোপাল: (কিছুটা আনমনা) থাক সে সব কথা। আজ ভাবলে মনে হয় দুটো ফরেন ট্যুরে গেছি ইন্ডিয়ান টিমের সঙ্গে। ওয়ান ডে খেলেছি। অনেক লাকি। কেউ কেউ তো যথেষ্ট যোগ্য হয়েও পায়নি। তার পর আন্ডার নাইন্টিন ওয়ার্ল্ড কাপে বিরাট কোহালির টিম নিয়ে যে বার চ্যাম্পিয়ন হলাম, তখন প্রাইজের সময় দেখলাম আমার নামটাও ডাকছে। হাঁ হয়ে যাই কারণ জানতাম না, ম্যানেজারকেও যে পদক নিতে ডাকা হয়। যখন বিশ্বজয়ীর পদকটা গলায় ঝুলছে, তখন মনে হয়েছিল এই মেডেলটা তো সৌরভ পায়নি, দ্রাবিড় পায়নি, কুম্বলে পায়নি। তুমি কোথাকার কে গোপাল বসু তো পেয়ে গেলে। তা হলে কি জীবনের ব্যালান্স শিট কোথাও এসে মিলে গেল? হয়তো!

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE